গৌরাঙ্গের খাদ্যকথা – তৃতীয় পর্ব

যাঁরে কৃপা কৈলা গোরা প্রেম রসরায় ।।
পরে করে তিনি ভাই কুলাইতে বাস ।
অগ্রদ্বীপ কৈলা যেহ প্রভুর প্রকাশ ।।”

অগ্রদ্বীপ ও হরীতকীর কথা না বললে মহাপ্রভুর ভোজন কথা অসমাপ্ত থেকে যায়। প্রভুর মুখশুদ্ধির জন্য হরীতকী অগ্রদ্বীপকে ইতিহাসে পরিণত করেছিল। অগ্রদ্বীপ মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত সাবডিবিসন কাঁদি র অধীন রোসড়া গ্রামে কায়স্থ বংশের গোপালচন্দ্র ঘোষ নামক জনৈক সৎ ও নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব মতালম্বী ব্যক্তির বসতি ছিল। তাঁর পুত্রের নাম ছিল ব্ল্ল্ভ।তিনি অত্যন্ত গুনবান ব্যক্তি ছিলেন ।ব্ল্ল্ভ কোনো অনিবার্য কারণবশত পিতৃক বাসস্থলী রোসড়া পরিত্যাগ করে বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কুলাই গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি পরম বৈষ্ণব অনুরাগী ছিলেন । পিতৃগুণসমূহ যেন বল্লভাশ্রয়ে যেন সমধিক গৌরবান্বিত হয়ে উঠেছিল। বল্লভের ধর্মপ্রাণতার আধিক্য নিবন্ধন গোপালচন্দ্রের ধর্ম গৌরবজনক আরো বর্ধিত হয়েছিল।


বল্লভ এর ছয় পুত্র ছিল যথা : গোবিন্দ ,বাসু ,মাধব, দনুজারী ,কংসারি, মীন।কায়স্থ কুলজী গ্রন্থ মুক্তকণ্ঠে গেয়েছেন….

“ধন্য রে গোপাল ঘোষ সকলি বৈষ্ণব।
যে কুলে জন্মিলা বাসু গোবিন্দ মাধব।।”

গোবিন্দ, বাসু , মাধবের ভক্তিতরঙ্গিনী তর তর স্রোতপ্রবাহ আর কুলাই এর সংকীর্ণ সীমায় বদ্ধ থাকলো না । তারা কুল পরিত্যাগ করে অকুলের কান্ডারী গোকুলবিহারী হরির করুনা লাভের জন্য নবদ্বীপে আগমন করে গৌরাঙ্গ আশ্রয় গ্রহণ করলেন । গোবিন্দ , বাসু, মাধবের বাকি তিন ভাই নিজের জায়গায় থেকেই কালাতিপাত করতে লাগলেন। গোবিন্দ , বাসু, মাধবের তিন ভাইয়ের বংশধর আজও কুলাই, দিনাজপুর, জগদানন্দপুর প্রভৃতি স্থান অলংকৃত করছেন ।দিনাজপুরের বৈষ্ণব অনুরাগী মহারাজ গিরিজানাথ রায় বাহাদুর ও কুলাই এর পরম বৈষ্ণব বাবু মাখন লাল ঘোষ ,ইন্দ্র নারায়ন ঘোষ গোবিন্দ, বাসু, মাধব এর ভ্রাতাগনের বংশধর।

গোবিন্দ ,মাধব , বাসু এই তিন ভাইয়ের ভাগ্য বর্ণ নিয়ে বৈষ্ণব কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয় তার চৈতন্যচরিতামৃতে লিখেছেন-
” গোবিন্দ মাধব বাসু এই তিন ভাই ।
যা সবার কীর্তনে নাচে চৈতন্য নিতাই।।”

শ্রীশচন্দ্র তাঁর “সাধুজীবন” গ্রন্থে বলেন যে গোবিন্দের বাস বৈষ্ণবতলা ছিল। চৈতন্যদেব তাঁর ভক্তমন্ডলী সহ অগ্ৰদ্বীপে আগমনের কথা শুনে সেই স্থানে এসে তিনি মহাপ্রভুর পদাশ্রয় গ্রহণ করেন।

কাশীপুর বৈষ্ণব তলা থেকে অগ্রদ্বীপ একক্রোশ মাত্র ব্যবধান এবং গৌরাঙ্গ দেব অগ্রদ্বীপের মাত্র একদিন অবস্থান করেছিলেন । কাশীপুর ,বৈষ্ণবতলায় যে ঘোষ বংশীয় উত্তররাঢ়ই বাস করেন, তাদের পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান কুলাই এ। এরা গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুরের বংশধর অর্থাৎ গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুর কুলাই থেকে নবদ্বীপ এসে গৌরাঙ্গ সঙ্গে লাভ করেন এবং সেখান থেকে গঙ্গার তীরবর্তী পথ অবলম্বন করে তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বহির্গত হন।

ভক্তবতার শ্রী গৌরাঙ্গদেব বৈষ্ণব মত প্রচারের উদ্দেশ্যে পুন্যতোয়া জানহবী কুলবর্তী পথ অবলম্বন করে হিমাদ্রি শেখর পর্যন্ত গমনের উদ্দেশ্য নিয়ে নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, হরিদাস প্রমুখ বৈষ্ণব মন্ডলীর পরিবৃত হয়ে নবদ্বীপ হতে বহির্গত হয়েছিলেন। হরি নাম অমৃত ছড়াতে ছড়াতে গৌরাঙ্গ অগ্ৰদ্বীপে এসে উপস্থিত হন । তখন অগ্রদ্বীপের কেবল গঙ্গার তীরবর্তী স্থান ব্যতীত, অন্য কোন রকমের খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল না।

ভক্তমন্ডলী পরিবৃত গৌরাঙ্গ সেদিন গঙ্গা স্নান করে আহারাদির ব্যবস্থা করলেন ।আহারান্তে মুখসুদ্ধি সামগ্রী সেদিন কিছুই ছিল না। তা দেখে তাড়াতাড়ি গোবিন্দ নিজের কাপড়ের খুঁটে সঞ্চিত হরীতকী বার করে চৈতন্য সুমুখে রাখলেন । প্রসঙ্গত বলে রাখি গোবিন্দ হরীতকী কুড়ানো ও তাকে বিক্রি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন মহাপ্রভু সান্নিধ্যে আসবার পূর্বে।

যা হোক, এই সমস্ত দেখে মহাপ্রভু বললেন, ” গোবিন্দ তুমি এত অল্প সময়ে হরিতকী খন্ড কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?”

গোবিন্দ বললেন ,” যার এক অংশ গতকল্য প্রভু সেবার জন্যে দিয়েছিলাম , এটি তার অপরাংশ । “

এ কথায় মহাপ্রভুর ওষ্ঠে মৃদু হাঁসি খেলে গেল । বললেন, ” গোবিন্দ ভক্তের ভক্তির সামগ্রী অবশ্যই গ্রহণীয় । দাও , তোমার হরিতকী আমি গ্রহন করলাম । কিন্তু গোবিন্দ আজ থেকে তোমাকে আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ , তোমার মধ্যে এখনো নিষ্কাম বৈরাগ্যেভাবের জন্ম হয়নি । এখনো তুমি পূর্ণ মাত্রায় কামনা বিরহিত হতে পারো নি। তা তোমার হরিতকী সঞ্চয় দেখেই উপলব্ধি করতে পারলাম ।”

মহাপ্রভুর এই কথা শুনে, গোবিন্দর মস্তকে বজ্রাঘাত হল। হৃদয় যেন জ্বালাময় শক্তি শেল বিদ্ধ হল। চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল । গোবিন্দ কাতর কণ্ঠে বললেন, ” মার্জনা করুন।”

গৌরাঙ্গ পুনশ্চঃ বললেন , “গোবিন্দ তুমি আমার পরম ভক্ত । হরি ভজনের সম্পূর্ণ অধিকারি তুমি হয়েছ। কিন্তু এখনো তোমার ভিতর হতে সংসার বাসনা যায়নি ।এখনো সঞ্চয় তোমার প্রবৃতি হয়ে আছে। তুমি গৃহে ফিরে যাও সংসারধর্মে লিপ্ত থেকে ভক্তিভাবে ভগবানের ভজনা কর ।তাহলে তোমার অভিষিত ফল লাভ হবে ।একথায় গোবিন্দ আবারও কাতর স্বরে নিবেদন করলেন , ” প্রভু আমি বিলক্ষণ বুঝেছি সংসারের কোন সুখ নাই, আপনার সঙ্গে থেকে আপনার সেবা করবো এই আমার বাসনা ।আমি সর্বত্যাগী হয়েছি ।স্ত্রী-পুত্র কেউ থাকলে অবশ্য তাদের মায়াময় চিন্তা আমার চিত্ত আকর্ষণ করত । কিন্তু প্রভু এই পবিত্র ভাগীরথীর পূর্ণক্ষেত্রে আপনার সমক্ষে বলছিসংসার জীবনে আমি ফিরব না ।দয়াময় , সাহস হয় না। আমি আপনাকে পুত্র স্নেহ করে ভালোবেসে প্রানে প্রশান্তি লাভ করে থাকি । অধমকে এ সুখে বঞ্চিত করবেন না । আপনার চন্দ্রের ন্যায় মুখমণ্ডল দেখে এই দাস সংসারের সকল সাধেই জলাঞ্জলি দিয়েছে । আর আমাকে নিগ্রহ করবেন না। আমাকে আপনার সঙ্গ লাভ বঞ্চিত করবেন না আমার অপরাধ মার্জনা করুন…”

পূর্ব দিনের হরিতকী সংগ্রহ করে গোবিন্দ বড় ভুল করেছেন। বারংবার অপরাধ মার্জনা করার জন্য শ্রী গৌরাঙ্গ কে অনুরোধ করলেন গোবিন্দ……মায়া মোহ
ত্যাগ না করলে সন্ন্যাস হওয়া যায় না…কিন্তু গোবিন্দ হরীতকীর মায়া ত্যাগ করতে পারে নাই। যে বড় অন্যায় কথা…

গোবিন্দের কাতর আবেদনে গৌর হেসে বললেন, ” গোবিন্দ তুমি আমার কথার ভাবর্থকে তো ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারোনি। বাস্তবিক তুমি কোন অর্থ সংগ্রহ করোনি বটে… কিন্তু ,গোবিন্দ এই হরিতকী টি সংগ্রহ তোমার পক্ষে বিষম হয়ে দাঁড়িয়েছে । নিষ্কাম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিকট সঞ্চয় ভীষন এক অপরাধ। আজ তুমি হরীতকী সঞ্চয় করলে ,কাল আবার অভিনব বস্তুর স্পৃহা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হবে। কামনাই গন্তব্যপথের কন্টক স্বরূপ হয়ে সর্বনাশ সাধন করে । তোমার সেই কামনা বহ্নি নিয়ে এখনো নির্বাপিত হয়নি । আমাদের ব্রতের পক্ষে যা ঘোরতর প্রতিবন্ধক স্বরূপ। গোবিন্দ, আমার বাক্য অন্ন্থা করো না, অগ্রদ্বীপ তোমার ভজন স্থান নির্ণীত হল ।নিষ্কামী হয়ে হরিভজন করো । ভিক্ষাবৃত্তি জঠরানল অগ্নি নির্বাপিত করে অন্য প্রবৃত্তি এককালে পরিত্যাগ করবে । আমি পুনরাগমন করে তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করব । আমার কথা অন্যথা করো না, তুমি যেমন আমাকে পুত্র ভাবে দর্শন করে থাকো, সেই ফলে তুমি এমন পুত্র পাবে যার তুলনা জগতে হয় না । সেই পুত্র হতে তুমি পুন্নাম নরক থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে । ভুবনে ধন্য হবে।”

গোবিন্দের আঁধার হৃদয় যেন আশার বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ছুটে গেল । ভগ্নহৃদয় যেন কতক পরিমাণে সংযোজিত হলো, কিয়দ পরিমানে প্রবধিত হল।

গোবিন্দ বললেন, ” প্রভু এই অধমের সেই সৌভাগ্য কবে হবে? কবে অধমের চিত্তচোকর গৌরাঙ্গচন্দ্র দর্শন সুধা পান করে পরিতৃপ্ত হবে? কবে দাসের ভাগ্যাকাশে কালো আঁধার ঘুচে সূর্যদয় হবে? “

মহাপ্রভু বললেন, ” প্রিয়ভক্ত গোবিন্দ !কবে যে পুনরাগমন করব তার স্থির নেই ।তবে স্মরণ রেখ যেদিন তোমার জীবনে কোনো অভিনব অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হবে সেদিন জানবে আমার আগমনের বিলম্ব নয নেই। সেই অলৌকিক ঘটনার কোন সামগ্রী যদি প্রাপ্ত হয় তবে তা পরম যত্নে রক্ষা করবে। তার কোন পরিবর্তন করবে না । আমি এসে তাঁর কর্তব্য অবধারণ করব।”

” আশ্বাসি গোবিন্দে পঁহু সাঙ্গ পাঙ্গ লঞা।
তীর্থ পর্যটনে পর্যটনে যান হৃষ্ট চিত্ত হঞা।।

গৌরাঙ্গ বিদায় হলেন। অশ্রু ভারাক্রান্ত নয়নে গোবিন্দ গৌরাঙ্গ পানে চেয়ে চেয়ে রইলেন। একবার ভাবলেন আর একবার প্রভুর চরন ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করি যদি প্রভুর ভাব পরিবর্তন হয় আবার ভাবলেন না …. স্থির প্রতিজ্ঞ নিমাই পণ্ডিতের প্রতিজ্ঞা অটল। আমার মত অধম সঙ্গে থাকলেও প্রভুর ব্রত পালনের প্রতিবন্ধকতা ঘটবে । সুতরাং বিরত হলেন ……..

এরপর , গোবিন্দ চৈতন্যদেবের অনুমতি মত অগ্রদ্বীপের সুরধুনী তীরে একখানি পর্ণকুটির নির্মাণ করে এবং সেই স্থানে উপবেশন করে তীব্র ভক্তিযোগ সহকারে হরিসাধন প্রবৃত্ত হলেন। মনের আবেগে কল্লোলিনী সুরধুনীর কল্লোল শব্দে কণ্ঠস্বর এক করে গোবিন্দ প্রভুর গুনগানে সময় যাপন করতে লাগলেন। এই ভাবে কিয়দকাল অতিবাহিত হল । গোবিন্দ ভিক্ষা অন্নে জীবন ধারণ করে, প্রতিনিয়ত গৌরাঙ্গের কথা অলৌকিক ঘটনা অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। তার কোন সন্ধান না পেয়ে নিরাশার মেঘ গোবিন্দের হৃদয়কে তমসাচ্ছন্ন করে বার বার ।

আবার মহাপ্রভুর আশ্বাস বাক্য ক্ষণপ্রভার মত ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় আলোকিত করে। হর্ষবিষাদে ,আলোকে , আঁধারে এইভাবে দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস বছর কেটে গেল। চৈত্র মাস উপস্থিত হল ….. ভাগীরথী ক্ষীণকলেবরা অনুগামিনী শোকাকুল হয়ে কুলুকুলু শব্দ করতে করতে সাগর গামিনি হয়েছে।

গৌরাঙ্গ বাক্য প্রলভিত গোবিন্দ, আবক্ষ নিমজ্জিত গঙ্গা সলিলে নিমজ্জিত হয়ে হরি ধ্যান করছেন । এমন সময় কোন বস্তু তার পৃষ্ঠ স্পর্শ করল …..

গোবিন্দ আবক্ষ নিমজ্জিত পবিত্র গঙ্গায় নেমে হরিধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু কে কে বার বার তার পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করে তার ঈশ্বর ভজনায় ব্যাঘাত ঘটায় ? আবর স্পর্শ পেলেন গোবিন্দ। মুদ্রিত নয়নে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন বস্তুটি। আবার স্পর্শ করল। বড় ব্যাঘাত করছে তো…বিরক্ত হয়ে গোবিন্দ ফিরে দেখলেন…ওমা! এ যে একটা মরা পোড়ানোর কাঠ হবে…গোবিন্দ কাঠটিকে তুলে তীরে রাখলেন। কিন্তু , ওই কাষ্ঠ খণ্ডকে স্পর্শ করে গোবিন্দের শরীরে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হল।

ভাবে বিভোর হলেন গোবিন্দ। বিভোর গোবিন্দ পুনশ্চ কাষ্ঠ খন্ড উত্তলন করতে গেলেন। কিন্তু একি ? এ যে শতগুন ভার বিশিষ্ট হয়েছে। সন্দেহ হলো গোবিন্দর। বেলা বয়ে যায় যে। মধ্য আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্য গনগন করে জ্বলছে। দৈনিক সংকল্পিত ভজন সমাপ্ন্তে গোবিন্দে ঠাকুর গঙ্গা স্নান করে পর্ণ কুটিরে গমন করলেন । যথাকালে গোবিন্দ ভিক্ষান্ন দিয়ে ক্ষুননিবৃত্তি করে কুটিরে বসে বাইরে চৈত্রের আলোয় রাঙা ভাগীরথীর রূপ অবলোকন করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা হল। ধরণীর বুকে শেষ বিকেলের আলো টুকু মুছে অন্ধকার নামল। ক্লান্ত পক্ষীকূল কলরব করে নিজ বাসায় , পাতার আড়ালে ফিরে চলল।

কুটিরে টিমটিমে সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালিয়ে গোবিন্দ হরি নামের মালা হাতে হরিনাম করছেন , কিন্তু বারবার অলসতায় তার শরীর অবসন্ন হয়ে যাচ্ছে ।অসময়ে গোবিন্দ নিদ্রাভুত হয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন দর্শন করলেন । দেখলেন তাঁর আঁধার পর্ণ কুটির এক স্বর্গীয় আলোকে বিভাসিত ।সুগন্ধে চতুর্দিক আমোদিত। গন্ধবহ বাতাসে মন প্রাণ সুশীতল । গোবিন্দ যেন কোন এক রাগ, হিংসা, দ্বেষ বিবর্জিত আনন্দ নিকেতনে সমাসীন হয়েছেন । সেই জ্যোতির অভ্যন্তর থেকে শঙ্খ, চক্র ,গদা, পদ্মধারী , নব জলধর শ্যাম বর্ণ দিব্য মূর্তি আবির্ভূত হয়ে, মধুর স্বরে বললেন , “বৎস ! ত্রস্ত হয়েও না, মধ্যন্হ সময় কাষ্ঠ খন্ড ভ্রমে ভাগীরথী র কুলে যা রক্ষা করেছ, তা স্ত্তর কুটিরে নিয়ে এস। তোমার সৌভাগ্যের সীমা নেই। গৌরাঙ্গদেব আগত প্রায়…”

এ কথা বলে দেব মূর্তি অন্তর্ধান করলেন ….সেই সঙ্গে গোবিন্দর চমক ভাঙল। গোবিন্দ উঠে দেখলেন যে দৈব জ্যোতি তাঁর কুটির থেকে অন্তর্হিত হয়েছে, কুটির অন্ধকার, প্রদীপ টি কখন নিভে গেছে। কিন্তু সেই অনৈসর্গিক সৌরভরাশিতে চতুর্দিক পরিপূর্ণ। সেই স্বপ্ন শ্রুত দৈববাণী কুটিররর মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ” গোবিন্দ ভ্রান্ত হয়েও না ….গোবিন্দ ভ্রান্ত হয়েও না…”

গোবিন্দ ভ্রান্ত হলেন না। কুটিরের বাইরে আগমন করে দেখলেন রাতের আঁধার ঘন। মাথার উপর অনন্ত প্রসারিত সুনীল আকাশের বুকে অগনিত তারকা উজ্জ্বল হিরের খণ্ডের মত প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে । গোবিন্দের কুটিরখানি ভাগীরথীর পুন্য সলিলে নক্ষত্রালোকে প্রতিভাত হচ্ছে। ঝিল্লিরবে রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হচ্ছে। রাতের জোয়ারের জলে কুল ভেসেছে। হরির নাম জপে গোবিন্দ আঁধার রাতে জলে নামলেন …..

গোবিন্দ কিছু খুঁজতেই সেই কাষ্ঠ খন্ডকে পেয়ে গেলেন। কাষ্ঠ উত্তোলন করে দেখলেন, তেমন গুরুভার সম্পন্ন নয় …তখন তিনি কাষ্ঠ খন্ডকে স্কন্ধে স্থাপন করে কুটিরের মধ্যে আনয়ন করলেন এবং পরম যত্নসহকারে ভক্তি আপ্লুত অন্তরে তাকে সংস্থাপন করলে । মন প্রফুল্লতায় পরিপূর্ণ । আশা সৌদামিনীর কিরনে হৃদয় উদ্ভাসিত । অর্ধ নিদ্রিত , অর্ধ জাগরিত অবস্থায় সে রজনী অতিবাহিত করলেন। প্রভাত হল ,গোবিন্দ দেখলেন যাকে কাষ্ঠ ভ্রমের কারণে দূরে নিক্ষেপ করেছিলেন ,তা আদৌ কাষ্ঠখন্ড নয় ….সেটি একটি সম্মুজ্বল কৃষ্ণশিলা। ঘোষ ঠাকুর চমকে উঠলেন ।

চৈতন্যদেবের আশ্বাস বাক্য তার হৃদয় সঞ্চারিত হয়ে যেন আনন্দ সাগর উথলিয়ে উঠল ।

অলৌকিক বস্তু !!!

জলে পাথর ভেসে আসছে …এর অপেক্ষা অলৌকিক কি হতে পারে? গোবিন্দ বিশ্বাস হলো তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। প্রভুর আগমনে আর বিলম্ব নেই।

এবার ওই শীলার কথা বলি ..

ভগবান চৈতন্যদেব তীর্থ ভ্রমণ করতে করতে উপস্থিত হলেন গৌড়ে। সেখানে দেখলেন সমস্ত রাজভবন প্রস্তর গ্রথিত। তার বহির দ্বারে শীর্ষ স্থানে একটি কৃষ্ণপ্রস্তর প্রদর্শন করে চিনতে পারলেন যে তা ব্রহ্মশীলা। তখন গৌড় আর সনাতনী দখলে নেই। মহাপ্রভু সেই ব্রহ্মশীলা পাবার জন্য বহু লড়াই করলেন ( এটা বাক, বুদ্ধি ও মানসিক লড়াই)। অবশেষে জয়ী হলেন। ওই প্রস্তরখন্ড তিনি নিজের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন এবং ভাগীরথীর জলে নিক্ষেপ করেছিলেন । গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুর সেই শীলাই প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

ব্রহ্মশীলা পরীক্ষার নিয়ম হস্তলিপি। এটি একপ্রকার তান্ত্রিক আরাধনা। শীলা পরীক্ষা মহাপ্রভু কি ভাবে করেছিলেন এ প্রশ্ন যদি কারুর মনে আসে , তার জন্য বলে রাখি তিনি সর্ব জ্ঞাত ছিলেন। তিনি সর্ব শাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। প্রসঙ্গত নবদ্বীপের কুলদেবী পোড়া মা , যেটি নীল সরস্বতীর মূর্তি ছিল ও তন্ত্র মতে পূজিত হতেন ও হন, তাঁকে মহাপ্রভু নিমাইচাঁদ সন্ন্যাসী হবার পূর্বে পূজা করতে যেতেন।

ব্রহ্ম শীলা প্রাপ্ত করে গোবিন্দের সেই মহিমাপূর্ণ রাত্রি কোনো ক্রমে অতিবাহিত হল । পর দিন প্রভাত হলে গোবিন্দ দৈনন্দিন সাধনা সমাপন্তে ভিক্ষায় বহির্গত হয়ে শ্রবন করলেন তার ভজন কুটিরে বহু সংখ্যক অতিথি সমাগম হয়েছে । এই কথা শ্রবণ মাত্র গোবিন্দের অধর প্রান্ত হাস্যরেখায় বিস্ফারিত হলো। অনবরত দক্ষিণ অঙ্গ স্পন্দন এবং নানাবিধ শুভ লক্ষণ দর্শনে ধারণা হলো যে প্রভুর আগমন হয়েছে। গোবিন্দ দ্রুতপদে কুটিরে গিয়ে দেখলেন মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেব তাঁর ভাঙা পথের ধূলো রাঙা করে , ভাঙা ঘর আলো করে বসে আছেন। গোবিন্দ আনন্দ বিহল হয়ে বললেন –

গৌরাগং গৌর দীপ্তগং পাঠং স্ত্রোতং কৃতান্জলিং।
নন্দগোপ বৈষ্ণব নমস্যামি গদাগ্ৰজম।।

বলে প্রভুর চরণ তলে পতিত হলেন ।ভক্তগণ অমনি গগনবিদারী স্বরে, “হরি বোল ,হরি বোল ” করে হরিধ্বনি করে উঠলো । সেই ধ্বনি সুরধুনীর কলকল ধ্বনির সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে অন্ততে মিশে গেল ।

চরণপ্রান্তে পতিত গোবিন্দকে গৌরাঙ্গ দেব আলিঙ্গন করে জিজ্ঞাসা করলেন , “গোবিন্দ , তোমার সঙ্গে কি কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে? তোমার জীবনে কোন অলৌকিক ঘটনা দেখেছ ?

গোবিন্দ বললেন – ” প্রভু এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। আমার জীবনে সৃষ্টি কাল হইতে রাহু চন্দ্র গ্রহণ করে থাকে।আজ চন্দ্র রাহুকে গ্রহন করলেন। আর এক অলৌকিক ঘটনা …ওই দেখুন আমার কুটির এর মধ্যে বিদ্যমান….” এই বলে গোবিন্দ সেই শীলা প্রাপ্তির ঘটনাবলী আমূল নিবেদন করলেন।

ব্রহ্ম শীলা দর্শন করে হাস্যমুখে শ্রী চৈতন্যদেব বললেন, ” গোবিন্দ তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে । আর চিন্তা নাই।তোমার মঙ্গলের জন্য ঈশ্বর কর্তৃক ওই প্রস্তরখানি প্রেরিত হয়েছে। আমি ওই শীলা হতে একটি শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ নির্মাণ করে এই স্থানে প্রতিষ্ঠা করব এবং তোমাকে তার সেবায়েত করব। তুমি মনস্থির করো, কালিই জনৈক ভাস্কর আগমন করে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ নির্মাণ করবেন ।”

ভক্ত দল পরিবৃত গৌরাঙ্গদেবের সেবার নিমিত্ত গোবিন্দ ভিক্ষায় বের হলেন। পরমানন্দে প্রাপ্ত ভিক্ষান্ন দ্বারা অতিথি সেবা করে, হরি কথা আলোচনা করে যামিনী অতিবাহিত হল…

প্রভাতে কোথা হতে দেবপ্রতিম ভাস্কর এসে উপস্থিত হলেন । আহা তার কিরূপ !তার কি মুখের হাসি ! এক যেন মহাপ্রভু চন্দ্র , আর সে শিল্পী যেন সেই চন্দ্র কলার ন্যায় শোভা পাচ্ছেন।গৌরাঙ্গ ভিন্ন অন্য কেউ তাকে চিনতে পারলেন না …যেন দেবশিল্পী নরদেহ ধারন করে নরকান্তধারী গৌরের প্রীত্যর্থে আগমন করেছেন।

হাস্য বদনে চৈতন্যদেব নিয়ে ভাস্কর কে গোবিন্দ কুটিরস্থ ক্ষুদ্র শিলাখণ্ড হতে একটি শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি নির্মাণের অনুমতি করলেন। ভাস্কর মধ্যে প্রবেশ করে অর্গল বন্ধ করে দিলেন । দিন রাত্রি অতিবাহিত হলেও প্রস্তর যেমন তেমন রইলো। কিন্তু পরদিন প্রাতে সকলে স্নান আহ্নিক করে এসে দেখলেন কুটিরে কেউ নেই, কোথায় ভাস্কর , কোথায় বা তার যন্ত্র? কুটিরের দুয়ার খোলা। কেবল বেদী আলো।করে দাঁড়িয়ে আছেন মোহময় শ্রীকৃষ্ণ…..ভক্ত বৃন্দ মহানন্দে হরি ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। গোবিন্দ গলবস্ত্র হয়ে স্তব করলেন:

নব জলধর বর্ণয়ং
চম্পকোয়াসি কর্নয়ং
বিকশিত নলিনাস্যং
কারু বহান চুলং
কিমপি নিখিল সায়ং
মৌনী গোপী কুমারং।।

এ কথা বলে ধরণীতলে পতিত হলেন। হাস্য বিস্ফারিত মুখে ভগবান শ্রী চৈতন্যদেব গোবিন্দ কে বললেন, ” বৎস !এই মূর্তি তোমার ও পরাত্রিক সকল কার্য সম্পন্ন করবে। তুমি জীবিত অবস্থায় এই কৃষ্ণমূর্তি সেবা করবে আর যখন ইহলোক ত্যাগ করবে তখনই ইনি তোমার ঊর্ধ্ব দৈহিক শ্রাদ্ধ ক্রিয়া সম্পাদন করবেন। জীবনান্তে নরক অবশ্যম্ভাবী, লোকে নিজের সন্তান দ্বারা সেই নরক হতে পরিত্রাণ পেয়ে থাকেন। তোমার জীবনে এই বিগ্রহ তোমার সন্তানের কার্য সম্পন্ন করবে । “

বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আরম্ভ হল । যেন কোনো জাদুমন্ত্রে কোথা থেকে প্রতিষ্ঠার উপযোগী সমস্ত দ্রব্যসমূহ আহূত হতে লাগলো। নানাস্থান থেকে আহুত, অনাহুত , রবাহুত হন আহত ব্যক্তিগণ উপস্থিত হলেন। তদদেশিয় ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ নানাবিধ ও উপহার ও উপাচার সহ আগমন করলেন। শুভদিনে, শুভক্ষণে শ্রী গৌরাঙ্গ দেব অভিষেক করে গোপীনাথ নামে শ্রী শ্রীকৃষ্ণমূর্তি ঘোষ ঠাকুরের সংকল্পে স্থাপিত করলেন। গোবিন্দ পরিণত হলেন ঘোষ ঠাকুরে এবং অগ্রদ্বীপ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হল । মহাপ্রভুর কৃপায় অনেকে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।

অখ্যাত অগ্রদ্বীপ মহাপ্রভুর প্রাসাদে গোবিন্দের গোপীনাথের তীর্থে পরিণত হল। হরি ভক্তিতে সুরধুনী কুলে বান ডাকল। ভক্ত গোবিন্দকে গোপিনাথের সেবায় নিযুক্ত করে যথাসময়ে মহাপ্রভু শিষ্য সমভিব্যহারে বিদায় গ্রহণ করে মানব কুল উদ্ধারের পথে ব্রতী হলেন।

গোবিন্দ গোপীনাথের সেবা করে অন্তিম দিনে মৃত্যুর কয়েক দন্ড পূর্বে শিষ্যগণকে আহবান করে বললেন ” শিষ্যগণ। আমি চললাম প্রভু সেবা তোমরা করিও। যদিও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রাদ্ধের নিয়ম নেই । কিন্তু মহাপ্রভুর আজ্ঞায় গোপীনাথ আমার শ্রাদ্ধ করবেন ।আমার মৃতদেহ দাহ না করে দেবাঙ্গনের এক পাশে সমাহিত করিও। ” কথা শেষ হলে গোবিন্দ হরি নাম ও গোপিনাথের পাদপদ্ম দর্শন করতে করতে প্রাণ ত্যাগ করলেন ।

গোবিন্দের পবিত্র দেহ সমাহিত হল । শ্রাদ্ধ দিনে পূর্ব মধুমাস বারুনীর পূর্ব কৃষ্ণা একাদশীতে তাহার গোপীনাথ শ্রাদ্ধয়েয় উত্তরীয় পরিধানে হস্তে কুশ অঙ্গুরী ধারণ পূর্বক তদবধি ভক্ত শ্রেষ্ঠ গোবিন্দর পুত্রবৎ শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পাদন করছেন।

এই শ্রাদ্ধ উপলক্ষে অগ্রদ্বীপে এই চৈত্র মাসে মহামেলা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং তার চার শতাব্দীকাল হতে অক্ষুন্ন ভাবে চলে আসছে।

গোবিন্দ কাহিনী সমাপ্ত হল ।গোপীনাথ স্থাপন সম্বন্ধে অগ্রদ্বীপ অঞ্চলে আরেকটি প্রবাদ প্রচলিত আছে তা পরে প্রকাশ করব।

পূর্বে অগ্রদ্বীপ পাটুলির নারায়ণপুরের ভূমধ্যকারী গনের অধিকারভুক্ত ছিল। সে সময় মহারাজা রঘুরাম রায় নবদ্বীপের অধিপতি ছিলেন। সেই সময়ে অগ্রদ্বীপের মেলায় একটি দুর্ঘটনা ঘটে। বেশ কিছু যাত্রী পদ পিষ্ট হয়ে। সে সংবাদ মুর্শিদাবাদে পৌঁছয়। নবাব ওই সময় জমিদারের উকিলদের অগ্রদ্বীপ কার অধিকারভুক্ত জিজ্ঞাসা করলে তার প্রভুর অধিকারভুক্ত একথা অস্বীকার করেন।

ঐদিকে মহারাজ রঘুরাম রায়ের উকিলরা তখন বলেন যে অগ্রদ্বীপ তাঁর অধিকার ভুক্ত। তাঁরা বলেন যে , ” রাজামশাই চেষ্টা করেছিলেন বলে এত কম পরিমাণে অঘটন ঘটেছে। যে জনসমাগম হয়েছে তার তুলনায় ওই অঘটন খুব সামান্য। নবাব বললেন , “আচ্ছা এবার মার্জনা করলাম…. এর পর হলে ক্ষমা নেই..” এই হতে গোপিনাথের অগ্রদ্বীপ কৃষ্ণনগরের রাজবংশের সম্পত্তির মধ্যে গণ্য হলো। বিপদ হতে রক্ষা পেয়ে মহাসমারোহে রাজা রঘুনাথ শ্রী গোপীনাথ এর পুজো দিলেন এবং দেবসেবায় ব্যয় হিসাবে তাঁর অধিকারস্থ নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া প্রভৃতি কয়েক খানি গ্রাম দেবত্তর করে দিলেন। এখন থেকে কুষ্টিয়ার নাম পরিবর্তিত হয়ে গোপীনাথপুর নাম প্রবর্তিত হলো।

গোপীনাথের স্থাপন কালব্ধি এখানে মহাসমারোহে বারুণীর মেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং তদ্ উপলক্ষে দূর-দূরান্ত স্থান থেকে নানাবিধ পণ্য দ্রব্যের বিপণি এবং গৌরাঙ্গ সম্প্রদায় যাত্রীগণের সমাগম হয়ে থাকে।
দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে ঘোষ ঠাকুরের প্রয়াণতিথি অনুসারে ‘চিঁড়ে মহোৎসব’-এর মধ্য দিয়ে মেলার শুরু। ওই দিন মন্দির থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় গোবিন্দ ঘোষের সমাধি মন্দিরে, দেবতার হাত দিয়ে মানব পিতার কুশ ও পিণ্ডদানের উদ্দেশে। দেবতাকে কাছা পরিয়ে তাঁর মানবপিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের এমন বিরল নমুনা চাক্ষুষ করতে হলে আসতে হবে গ্রামবাংলার এই মেলা প্রাঙ্গণে। প্রচলিত নিয়ম মেনে আগত পুণ্যার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাংলার মানুষও এ দিন অরন্ধন পালন করেন। দ্বিতীয় দিনে অন্ন মহোৎসব, তৃতীয় দিন গঙ্গা স্নান, চতুর্থ দিন স্থানীয় ভাবে পালিত গোপীনাথের দোলের মধ্য দিয়ে মেলা শেষ।

অগ্রদ্বীপের মেলা উৎসব এর মধ্যে চারন পালের মোহৎসব প্রসিদ্ধি অর্জন করে থাকে। সেই মোহৎসবে উচ্চ নিচ সকল জাতিই একত্রে ভোজন ও ভজন করে থাকেন। সেখানে কেউ অপাঙতেও নন।

চরণপাল এর জন্ম পল্লব গোপ বংশে নিবাস নদীয়া জেলার খড়িয়া নদীর তীরে লক্ষণগাছা গ্রামে। চরনপালের বিস্তর শিষ্য । অনেক কঠিন অসাধ্য পীড়া চরনের চরনার্শ্রয়ে রোগমুক্ত হয়েছিল এই প্রবাদ অনেকের মুখে শোনা যায়। তবে বহুদিন চরনপাল দেহ রক্ষা করেছেন। তার বংশাবলী কর্তৃক অগ্রদ্বীপ আখড়া মোহৎসব একই ভাবে নির্বাহিত হয়ে আসছে । এছাড়াও আরো গোস্বামী মহান্তের দ্বারা খুব ধুমধামের সঙ্গে চিঁড়া ও অন্নমোহৎসব সমাহিত হয়ে থাকে।

অনেক বছর, তা প্রায় ৭০ – ৮০ বছরের আরো অনেক পূর্বে অগ্রদ্বীপের বস্ত্রাদি বোনার একটি কারখানা ছিল। এখন আর নেই ।অগ্রদ্বীপের পটেয়া নামক স্থানের জঙ্গলে অনেক হিংস্র বন্য বরাহ, ব্যাঘ্যের দৌরাত্ম্য ছিল। এই জঙ্গলে ১৭৭১ সালে গভারমেন্ট ব্যয় পরিষ্কৃত হয়। ১৮৩২ সালে প্রবল বন্যায় অগ্রদ্বীপ নিম্ন বাহিনী ভাগীরথী সলিলে নিমজ্জিত হয়েছিল , তবুও গোপীনাথের কৃপায়, মহাপ্রভুর মহিমায় অগ্রদ্বীপ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি বহির্ভূত হয়নি ।

হাওড়া-কাটোয়া লাইনে কাটোয়ার তিনটি স্টেশন আগে অগ্রদ্বীপ। গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা অগ্রবর্তী গ্রাম হিসেবে এই নামকরণ। গ্রামটি স্টেশন থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে গঙ্গার অপর পারে। বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও জায়গাটি নদিয়া ঘেঁষা। গঙ্গা এখানে অপ্রশস্ত খালের মতো।

বেশ কিছু দোকান বসলেও বেশির ভাগই হরেক মাল ১০ টাকা গোছের। ব্যতিক্রম শুধু কাটোয়ার বিখ্যাত কাঠের পুতুল। গ্রাম বাংলায় এখনও এই পুতুলের ভালোই চাহিদা। শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারও উপস্থিত থাকে এই মেলায়।

সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়। কারও কারও মতে সংখ্যাটা ৫-৬ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে ততই নতুন করে জনজোয়ারে ভাসছে অগ্রদ্বীপের মেলা। তবে গঙ্গার ভাঙনের করাল ভ্রূকুটি এই মুহূর্তে মেলার ভবিষ্যতে প্রশ্নচিহ্ন রেখে দিয়েছে।

শ্ৰী কৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং শ্ৰী ভক্তিরত্নাকর ( খ্রিষ্টীয় ১৭ শর প্রথম পাদে) প্রণেতা নরহরি চক্রবর্তী অর্থাৎ ঘনশ্যাম দাস দুজনেই ছিলেন মহাসাধক , দার্শনিক সাহিত্যবেত্তা, শাস্ত্রজ্ঞ , রন্ধন বিদ্যা, সংগীত বাদ্য , নৃত্য ,গীত , সকল কলায় সুপারদর্শী ছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের গ্রন্থে তৎকালীন বৈষ্ণব খাদ্যাভ্যাস এবং রন্ধন প্রণালী বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু নরহরি ঠাকুরের রচনায় সেসব আলোচনা পাওয়া যায় না। অথচ তিনি একজন প্রসিদ্ধ সূপাকার ছিলেন।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের রচনায় শ্রীকৃষ্ণের সেবা ও ভোগের কথা সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। কেমন ছিল সে খাদ্য, কেমনি বা ছিল সেই রন্ধন প্রণালীর দ্রব্য সমূহ?

মাতা যশোদা রন্ধন শালায় গিয়ে মাতা রোহিনী এবং শ্ৰীরাধিকাকে প্রশ্ন করছেন , ” কি কি ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছ আমাকে দেখাও। তখন তাঁরা জানালেন –

বৃহৎ মাটির পাত্রে সুগন্ধিত পায়েস রয়েছে। রয়েছে কলা নারকেল, ক্ষীর সহযোগে নানা প্রকার পিঠে। কর্পূরকেলি, অমৃতকেলি, মাসকলাই, মুগডাল, মুগডালের নানা রকমের বটক বা বড়া, তেঁতুল, আমড়া, আমারুল ও আমের সঙ্গে মুগডাল বড়া, অম্ল মধুর মাঝারি সময়নুসারে বারো রকমের টক, গর্ভমোচা, তার ফুল, মানকচু, শকরকন্দ বা মিষ্টিআলু, পানিকচু, মেটে আলু, চাল কুমড়ো, ঢ‍্যাঁড়শ ডাল বাটার মধ্যে দিয়ে ঘিয়ে ভাজা, ছোলা বাটা জায় ফল দারুচিনি দিয়ে বড়া, চালকুমড়ো-ঝিঙে- লাউ- দই দিয়ে পৃথক পৃথক রাইতা , বক ফুলের বড়া, ঘি ভর্জিত পটল, শর্করা এলাচ- গোলমরিচ দুধের সাথে লাউ, ঘি দিয়ে শূরনক অর্থাৎ ওল, কলমী- নলিতা মেথি – সলুফা মৌরী-বেতো-শুসনি-নটে ইত্যাদি শাক ও গোধূম গোলক, নারিকেল গোল মরিচ – ঘন দুধ- এলাচ- লবঙ্গ- দারুচিনি কর্পূর ঘিয়ে ভেজে পাক করে শ্রীরাধিকা নির্মাণ করেছেন অমৃত কোল নামক বড়া। ছানা দুগ্ধ নারিকেল – গোলমরিচ- চাল গুঁড়ো – দই – জাতী ফল- এলাচ- লবঙ্গ- কলা- ঘি- মধু- কর্পূর ইত্যাদি দিয়ে নানারকম পদ্ধতিতে অমৃত পালিকা, অনঙ্গগুটিকা, অনঙ্গবড়া, ক্ষীরসার ইত্যাদি প্রস্তুত করেছেন। ” এক্ষেত্রে বলে রাখি আজি হতে বহু বহু বৎসর পূর্বে পেরুর আলু পর্তুগিজদের হাত ধরে না ঢুকলেও ভারতবর্ষে আলুর অপ্রতুলতা ছিল না। মিষ্টি আলু, কান্দালু, খাম আলু , কুচো আলু ভারতে ব্যাপক এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই উৎপাদিত হত।

গোবিন্দলীলামৃতের আরো নানা স্থানে এই একই জাতীয় খাদ্য দ্রব্যের বিবরণ আছে। বারংবার এসব বলার দরকার নেই। এ ব্যতীত শ্ৰী কর্ণপুর গোস্বামীর অষ্টকালীন সেবার গ্রন্থ “কৃষ্ণাহ্নিককৌমুদি” ও শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর বা হরিব্ল্লভ শ্ৰীকৃষ্ণভাবনামৃতের ৫/৬ সর্গে শ্ৰীরাধিকা দ্বারা প্রস্তুত নানান প্রকার খাদ্য, অন্ন, ব্যঞ্জনাদির উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য শ্ৰীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মুর্শিদাবাদের দেবগ্রাম এবং শ্ৰীকৃষ্ণদাস কবিরাজ মুর্শিদাবাদের প্রান্ত সীমা ঝামটপুর বহরানের অধিবাসী ছিলেন।

বৈষ্ণবাচার্যরা সাহিত্য – সংগীত সমস্ত শিল্পকলাকে বেদের কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডের মাধ্যমে ঈশ্বর সেবা বলে প্রত্যয়ী। জীবন শৈলীর শিষ্টাচারের বহুল অংশও এই বৈষনবদের হাত ধরে এসেছে। শ্রুতিকটু , দৃষ্টি কাটব্য ইত্যাদি থেকে তাই সমাজ দূরে থাকে। বৈষ্ণবরা খাওয়াকে সেবা, ঝোলকে রসা , ভাত কে অন্ন, তরকারী কাটাকে তরকারী বা ব্যঞ্জন বানানো বলে, থামো বলতে বোঝান রসুনকে, আধসেদ্ধ কে আমান্ন বলেন ইত্যাদি। প্রসঙ্গত , পূর্ব পারিবারিক সংস্কারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসকল শব্দই ব্যবহার করতেন।

বর্তমানে ভোজসভায় অতিথি আপ্যায়নের আবির্ভাব ঘটেছে পেশদারি পুতুলের ভঙ্গিতে। অতি অধুনিক বুফে ব্যবস্থায় ” নাও – খাও- চলে যাও” এর মতো ব্যাপার। বর্তমান ভোজের সাথে শরীর বৃত্তের কোনো স্থান নেই। স্থান নেই আধ্যাত্মিকতার। আজকের দিনে কজন অন্ন গ্রহণের পূর্বে উচ্চারণ করি – অন্ন গ্রহণ করার আগের মন্ত্র

ওঁ অন্নপতেঃন্নস্য নো দেহ্যনমীবস্য শুষ্মীনঃ।

প্র প্র দাতারং তারিষ ঊর্জং নো

ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে।।

??? নিদেন পক্ষে শ্ৰী শ্রী ভগবানের নাম নিয়ে খেতে শুরু করি কি? আমার বাবাকে ছোট বেলায় দেখতাম মন্ত্র বলে প্রণাম করে , থালার পাশে মাটিতে ভাত রেখে জল দিয়ে ঠাকুরকে উৎসর্গ করে তবে খেতে শুরু করতেন। এখন সেসব কোথায়? ভোজবাড়িতে এখন কর্তার দেখা মেলে না। ভোজে সঙ্গে শরীর বৃত্তের কোনো যোগ থাকে না। সে আমিষ হোক বা নিরামিষ। আগেকার দিনে খাদ্য ও পরিবেশন মাধ্যম ইত্যাদিতে যথেষ্ট বিজ্ঞান সম্মত বিষয় নিহিত থাকত। ঘি ,নুন, লেবু, শাক, ডাল, পঞ্চ ভাজা, নানান তরিতরকারী , চাটনি, মিষ্টি ইত্যাদি, কলাপাতা, পদ্মপাতা বা শালপাতায় পরিবেশনের মধ্য দিয়ে প্রোটিন আয়োডিন, ভিটামিন, মিনারেল প্রভৃতি বিভিন্ন উপাদান শরীরে যেত। এখন তো পিৎজা, বার্গার, পাস্তা, বিরিয়ানির যুগ। পিৎজা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে কোল্ডড্রিংক দিয়ে কুলকুচি করে নিলেই চিত্তির। তাতে খাদ্য গুন বজায় থাকল কিনা বা পুষ্টি হল কিনা তাতে কার কি আসে যায়? অর্থের বিনিময়ে অতিসহজেই আজকাল মানুষ কুখাদ্য বিষ গ্রহণ করে চলেছেন। শ্ৰী চৈতন্যের সময়ের ভোজের সে আন্তরিকতা আজ আর নেই। তার সঙ্গে রন্ধন পটু এবং খাদ্য রসিক বাঙ্গালীও হারিয়ে যাচ্ছে।

সমাপ্ত

তথ্যঃ শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.