গিরীন্দ্রশেখর তখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র। তখনই বছর সতেরোর গিরীন্দ্রের সঙ্গে ন’ বছরের ইন্দুমতীর বিয়ে হয়ে গেল। না, ডাক্তারি পড়া আটকায়নি। সে তো সাধারণ ব্যাপার।

কিন্তু অসাধারণ যা, এম বি ডাক্তার থেকেই এক দিন গিরীন্দ্রশেখর ‘মানুষের মনের ডাক্তার’ হয়ে গেলেন। হয়ে উঠলেন ভারত তথা এশিয়ায় মনোবিজ্ঞানের জনক।

যখন মনস্তত্ত্ব নিয়ে তাঁর জ্ঞান ও পড়াশোনার পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন, তাঁর আলাপ করতে ইচ্ছে হল বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে। চিঠি তো লিখবেন, ইংরেজিতে চিঠি লিখলে ফ্রয়েড যদি জবাব না দেন!

সঙ্গে সঙ্গে গিরীন্দ্রের সিদ্ধান্ত, জার্মান ভাষা শিখবেন। অসম্ভব মেধাবী ছাত্রটি দ্রুত কাজ চালানোর মতো জার্মান শিখে নিলেন। পরে সে ভাষার পাঠ পরিশীলিত করেছিলেন আরও।

গিরীন্দ্রের নাম তখন দেশের বাইরেও ছড়াচ্ছে। তাঁর লেখা পড়ে আর বিষয়বস্তু দেখে ফ্রয়েডও উত্তর দিতে দেরি করলেন না। শুরু হল পত্র বিনিময়, চলল বছর সতেরো। সেই সমস্ত অমূল্য চিঠিগুলি ছাপা হয়ে ‘বোস-ফ্রয়েড করেসপন্ডেন্স’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।

এখনও যা সারা পৃথিবীতে মনোবিজ্ঞানের ছাত্রদের পড়ানো হয় সে চিঠি পত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ। লন্ডনের ‘ফ্রয়েড আর্কাইভ’ -এ গিরীন্দ্রশেখরের নামে গ্যালারি আছে। তাঁর লেখা সব বইও সেখানে আছে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে কিন্তু গিরীন্দ্রের মতান্তরও হয়েছিল। সে কথা পরে।

তাঁর বাবা চন্দ্রশেখরের দেওয়ান পরিচয় আগেই বলা হয়েছে। তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী, অর্থবান ছিলেন। তার পাঁচ মেয়ে, চার ছেলের মধ্যে গিরীন্দ্র কনিষ্ঠ। সকলের শৈশবই দারভাঙ্গায় কেটেছে। সেখান থেকেই তাঁরা কলকাতার পার্সিবাগানে চলে আসেন।

এখান থেকেই গিরীন্দ্রের প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা, পরে ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়া। অন্য তিন দাদা হলেন শশীশেখর, রাজশেখর, কৃষ্ণশেখর। গ্রামের বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগরের কাছে বীরনগরে।

কৃষ্ণশেখর সেখানকার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এখানে ম্যালেরিয়া দূরীকরণের জন্যে গিরীন্দ্রের এমন পদ্ধতি প্রচলন করেছিলেন যা পরবর্তীতে অন্যান্য জায়গাতেও অনুসরণ করা হত।

শশীশেখর ছিলেন সাংবাদিক ও লেখক। আর অন্য ভাই রাজশেখর ছিলেন রসায়নবিদ, বাংলা অভিধান লেখক আর বিংশ শতকের সেরা রসসাহিত্যকার। লোকে তাঁকে বেশি চেনে ‘পরশুরাম’ নামে।

পার্সিবাগানে থাকার কথা হচ্ছিল। তখন স্কোয়ার ছিল, এখন লেন। সেখানকার বাড়ির লাগোয়া পাঁচিলের গা ঘেঁষেই ছিল অনুশীলন সমিতি। বিপ্লবের, স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের উত্তাপ অহরহ তাঁদের গায়ে লাগত।

১৯০৬ সালের ৭ অগস্ট তাঁরা বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। সে পতাকা দেখতে অন্য রকম হলেও তাতে ‘বন্দেমাতরম’ লেখা ছিল। অনুশীলন সমিতি-তে তাঁরা নিয়মিত চাঁদা দিতেন। কথিত, বোমা তৈরির মালমশলার পরিমাণ নাকি বলে দিতেন রাজশেখর! গিরীন্দ্র ছিলেন সেই কর্মকান্ডে সহযোগী।

অনুশীলন সমিতি ছিল পাঁচিলের ও পারে, আর এ পারে অর্থাৎ বাড়ির ভিতরে চার ভাই মিলে তৈরি করেছিলেন ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’। এখানে স্বাধীনতা আন্দোলন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সম্মোহন, এমনকী ম্যাজিক নিয়েও আলোচনা হত।

নিয়মিত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যতীন্দ্রনাথ সেন, সতীশ দাশগুপ্ত প্রমুখ; অনিয়মিতদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায়, বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথও নাকি দু-এক বার এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এই পরিবারের যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। ভিয়েনা গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে কথা বলার জন্য গিরীন্দ্রের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে গিরীন্দ্রের হৃদ্যতার কারণ ছিল রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক। প্রথমে সাধারণ অসুখের সূত্রে, পরে নজরুলের মানসিক রোগের প্রভাব বাড়লে তাঁকে লুম্বিনী পার্ক মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল।

সেখানেও গিরীন্দ্রশেখরই তাঁর ডাক্তার ছিলেন। গিরীন্দ্রশেখরের মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো বিজয়কেতু চিকিৎসা করেছিলেন কবি নজরুল ইসলামের। এখান থেকেই ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নজরুলকে।

গিরীন্দ্রশেখরই এই লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। জমিটি দান করেছিলেন রাজশেখর বসু। এর আগে কলকাতায় মানসিক রোগের চিকিৎসাও শুরু করেন গিরীন্দ্র। প্রথমে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এর আউটডোর খোলার জন্যে আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। তখন তিনি কারমাইকেল হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। কারমাইকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটি ঘরের খানিকটা অংশ, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা, কয়েকটি আসবাবপত্রও দেন।

গিরীন্দ্রের অধীনে সহযোগী ডাক্তার ছিলেন ভূপতিমোহন ঘোষ ও কামাখ্যাচরণ মুখোপাধ্যায়। সে কালে ভারত তথা এশিয়াতে এক মাইলস্টোন হয়ে ছিল এ‌ই ঘটনা। গিরীন্দ্র এর পরে একটি সম্পূর্ণ হাসপাতালের কথা ভাবেন। কিন্তু টাকা কোথায়, জায়গাই বা দেবে কে।

বাড়িতে আলোচনা করেন এই নিয়ে। রাজশেখর বসু তাঁর তিলজলার জমিটি দিয়ে দেন। এরপর অর্থের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০-এর ৫ ফেব্রুয়ারি।

এর আগে দু-একটি ‘লুনাটিক অ্যাসাইলাম’ ছিল। মোদ্দা কথায় সেগুলো ছিল কিছু মানসিক রোগীকে কড়া ডোজের ওষুধ খাইয়ে, একজোট করে এক জায়গায় রাখার বন্দোবস্ত। গিরীন্দ্রের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল একেবারে আলাদা।

১৯১০ সালে এম বি পাশ করে প্র্যাকটিসের শুরু থেকেই তিনি এমনটাই ছিলেন। প্রতিদিন সকালে বাড়িতে বেশ কিছু ক্ষণ বসতেন ফ্রি আউটডোর সার্ভিসে। পাশের পাড়া প্রতিবেশী থেকে বস্তির লোকেরা আসত তখন।

বেলা দশটার পর রোগী দেখতে বেরোতেন, তখন ফি নিতেন। লুনাটিক অ্যাসাইলামের বদলে মেন্টাল হসপিটাল তৈরি করে সেখানে রোগীদের নিজের বাড়ির লোক হিসাবে চিকিৎসা শুরু করলেন।

অ-স্বাভাবিক মনকে স্বাভাবিক মনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কাজ। তিনি মানসিক রোগীদের কম ওষুধ দিতেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা, বেড়ানো ইত্যাদির কাউন্সিলের ওপর জোর দিয়ে তাঁদের মানসিক ক্ষতটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন নিরন্তর।

তবে হাসপাতালে মানসিক রোগের বিভাগ খোলা, বা মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।

ডাক্তারি করতে করতেই তিনি বিশেষ অনুমতি নিয়ে ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসাবে ভর্তি হয়ে যান। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন! পরের বছর থেকেই মনোবিজ্ঞান বিভাগে আংশিক সময়ের জন্যে পড়ানো শুরু, পরে বিভাগীয় প্রধান, ‘প্রফেসর’ ও হয়েছিলেন গিরীন্দ্র।

১৯১৫ সালে যখন এমএ-তে ভর্তি হয়েছেন, তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এর পরপরই ফ্রয়েডের জার্মান ভাষায় লেখার কিছু অনুবাদ ভারতে আসতে আরম্ভ করে। সেগুলি তিনি পড়ছেন, তৈরি করছেন নিজস্ব মতও। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত মনোবিদ্যায় গবেষণাপত্র জমা দেন।

এরপর গিরীন্দ্র ডিএসসি হন। বিষয় ছিল ‘মানসিক অবদমন’। এর পরেই ফ্রয়েডের সঙ্গে যোগাযোগ। ১৯২২-এ নিজেদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মনঃসমীক্ষা সমিতি’।

ফ্রয়েড ও আর্নেস্ট জোনস-এর সহযোগিতায় সমিতির ‘ইন্টারন্যাশনাল সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ -এর সদস্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া। সক্রিয় সেই সমিতি এখন শতবর্ষের পথে।

গিরীন্দ্রশেখরের গবেষণাপত্র ১৯২১ সালেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এই বইটি ফ্রয়েড ও আর্নেস্ট জোনসকে পাঠিয়েছিলেন। ফ্রয়েড তাঁর কাজের মৌলিকত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু তাঁর ‘অবদমন তত্ত্ব’ মানেননি। তিনি জানান, এটি তাঁর কাছে ‘ফ্ল্যাট, ল্যাকিং ইন থার্ড ডায়মেনশন’ মনে হয়েছে।

গিরীন্দ্রশেখর ফ্রয়েডকে যথেষ্ট সম্মান করলেও তাঁর কথা মানেননি। মনোবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে দুটি মতই পাঠ্য। দুজনের সম্পর্ক আদৌ গুরুশিষ্যের ছিল না। আশিস নন্দীর মতে, গিরীন্দ্রশেখরের আত্মবিশ্বাসের মুখোমুখি না হলে ‘ফ্রয়েড হয়তো এতটা সমাজ সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিশ্লেষণ নিয়ে ভাবতেন না।’

গিরীন্দ্র কোথাও কারও কাছে মাথা নত করেননি। তাঁর কথায়, আমি মাথা উঁচু করেই এ জগতে প্রবেশ করেছিলাম। তিনি ‘ব্রিচ বেবি’ ছিলেন। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তাঁর পা দুটি আগে, মাথা পরে বেরিয়েছিল। আরও একটা কথা বলতেন, ‘ ‘আমি পাঁচ বছর অবধি মায়ের দুধ খেয়েছি, আমাকে মারবে কে? ’ ’

খুব ভালো ম্যাজিক জানতেন গিরীন্দ্রশেখর। ছোটদের তো ম্যাজিক দেখাতেনই, রোগীদেরও বিভিন্ন ম্যাজিক দেখিয়ে, মজা করে রোগের কষ্টটাই ভুলিয়ে দিতেন। আবার অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠ, পরিচ্ছন্নতার বেলায় খুঁতখুঁতেও ছিলেন।

ভাইপো বিজয়কেতুর বিয়েতে ভোজের জন্যে বেশ কয়েকটি পাঁঠা কেনা হয়েছিল। বিয়ের ক’ দিন আগে সেগুলো বাড়িতে আসে। প্রতিষেধক জলে মিশিয়ে পাঁঠাগুলোকে রোজ স্নান করাতেন তিনি। শুধু তাই নয়, খাঁড়াটিকেও জীবাণুমুক্ত করা হয়েছিল।

তাঁর রোজকার রুটিন চলত ঘড়ির কাঁটা ধরে। চিকিৎসা করা থেকে নিজের খাওয়া, ঘুমোনো অবধি। রাত আটটায় খেয়ে শুয়ে পড়তেন। বিজয়কেতুর বিয়ে, বৌভাতের দিনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

এ দিকে রাশভারী, নিজের পরিমণ্ডলে আবার সেই তিনিই ভীষণ আমুদে ছিলেন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কখনও-সখনও লাগামছাড়া রসিকতাও করতেন। এক বার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে হিপনোটাইজ করে রাজভোগ বলে কাঁচা আলু খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হত ‘মাস্টার অব হিপনোটিজম’।

সম্মোহন তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির অঙ্গ ছিল। তাঁর আর একটি পছন্দের বিষয় ছিল যোগ। রোগ নিরাময়ে যোগাভ্যাসকে কাজে লাগাতেন। আবার মনোবিজ্ঞানের ওপর ভারী ভারী বই যেমন লিখেছেন, তেমনই ছোটদের জন্যও লিখেছেন বই ‘লাল কালো’। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল এই বই।

প্রায় দু’ দশকের যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও ফ্রয়েড আর গিরীন্দ্রশেখরের কখনও মুখোমুখি দেখা হয়নি। যোগাযোগ মানে ট্রাঙ্ক কল আর চিঠি বিনিময়। গিরীন্দ্রের বড় মেয়ে ও জামাই— দুর্গাবতী ও রবীন্দ্রনাথ ঘোষ— যখন জার্মানিতে গিয়েছিলেন, ফ্রয়েড তাঁদের তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ করে মধ্যাহ্ণভোজন করিয়েছিলেন।

গিরীন্দ্রশেখর বসু ৩০শে জানুয়ারি ১৮৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৩রা জুন ১৯৫৩ সালে ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। আজকের প্রয়াণ দিবসে উনাকে গভীর শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.