​‘আপনি এখানে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছেন । আপনার কোন সহযোগীতা লাগবে ? ’ ঝকঝকে বাংলায় প্রশ্নদুটো করতে করতে ঘাটশিলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে একটি সুনসান গ্রামে সকালের মুখে স্কুল চত্বর থেকে সহাস্য মুখে বেড়িয়ে এলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক ।

এরপর সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন ভিতরে । ১৯৯৬ সালে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয় তৎকালীন বিহার সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রকের অনুমোদনে স্কুলের বার্ষিক খরচের ৫০ শতাংশ সরকারী অনুদান পাওয়ার ভিত্তিতে । প্রচারের অভাব আর সরকারের সদিচ্ছা এই দুইয়ের ফলে শুরুর তিন বছরের মধ্যেই বন্ধ হতে বসেছিল এই বিদ্যালয়টি ।

২০০২ সালে বিদ্যালয়টির দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ । সরস্বতী শিশু বিদ্যামন্দিরের যাত্রাপথও প্রাথমিকভাবে সহজ ছিল না । গ্রামের দুস্তর দারিদ্র , পুরুষদের মদিরাসক্তির পাশাপাশি নকশাল প্রভাব শিশুদের শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বারবার । ভেঙে দেওয়া হয়েছিল স্কুলবাড়ি, অপহরন করা হয়েছিল শিক্ষক এবং স্বয়ংসেবকদের । খুন করা হয়েছিল কিছু স্বয়ংসেবককে ।

অতি বাম রাজনীতি কোথায় পৌঁছয় জানিনা । কিন্তু এইসব অঞ্চলে অন্য কিছু ঘটার খুব কি কারণ ছিল ? এত বছরের স্বাধীন হওয়া দেশে জঙ্গলআশ্রয়ী মানুষ ম্যালিরিয়াতে কাঁপবে প্রতিবছর , মাইলের পর মাইলের মধ্যে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকবে না —- এটা কোন কথা হল ?
অক্ষরজ্ঞান নেই , কারন ভাষার লিখিত হরফ নেই , ভবিষ্যৎ নেই কারণ স্কুল নেই । সমৃদ্ধি নেই , কারণ এত হতদরিদ্র যে মুদ্রার চল নেই তেমনভাবে ।
শুধু আছে নাকি একবুক সারল্য —- কোন সভ্যতার সারল্য , তা অবশ্য এখনও জানা হয়নি আমার । নিশি বা কনিয়াক নাগারা পরবে -উৎসবে করোটির মালা আর ধনেশের পালকে সাজবে , সেটা মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু বাধ্যতই যদি মেয়েদের পুঁতির মালায় লজ্জা নিবারন করতে হয় , তখন !! শুনতে শুনতে নিজেকেই মনে হচ্ছিল স্বার্থাণ্বেষী , হিপোক্রিট — কার চিতার ছাই গায়ে মেখে আমি ethnic ব্রাত্যভূমি দেখতে এসেছি ?

স্বয়ংসেবকরা পিছু হঠেন নি শত প্রতিকুলতাতেই । গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিক্ষার উপযোগিতা বুঝিয়েছেন । গ্রামে গ্রামে হাতেকলমে কাজ শিখিয়ে সেই সব সামগ্রী আবার নিজেরাই বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে বিক্রয়মূল্য তুলে দিয়েছেন পরিবারটির হাতে । স্কুলের বাচ্চাদের ফি বছর দুবার স্কুল ইউনিফর্ম ব্যবস্থা করেছেন আর গ্রামের প্রতিটি মানুষ পিছু দুবার বস্ত্র । সরকারী প্রকল্পগুলো গ্রামে নিয়ে এসেছেন ।

এই স্কুল থেকে পাশ করে দূরের কলেজে আইন পাঠরত একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল । ছুটির সময় বাবার পেশা ফুচকা বিক্রয়ে সহায়তা করছে । কিন্তু কি প্রত্যয় মেয়েটির চোখেমুখে , কি দীপ্তি । বলছে আইন পাশ করে এসে গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের মহাজনদের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা দেবে ।

স্কুল কমপাউন্ডে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম একটি দুটি করে বাচ্চা ছেলেমেয়ে ইউনিফর্ম পরে স্কুল বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে আসছে । সকালের সূর্যের আলোয় ওদের মুখ ঝলমল করছে — ওরা গাইছে , নাচছে , খেলছে , হাসছে । ধীরে ধীরে স্কুল প্রাঙ্গন ভরে ওঠে । চারিদিকের ছোট পাহাড় ঘেরা স্কুলটিতে দাঁড়িয়ে দেবশিশুগুলোর সঙ্গে সন্মিলিত প্রার্থনায় অনন্ত অপার হিমালয়কে স্পর্শ করার অনুভব হচ্ছিল । অলৌকিক এক প্রার্থনা সংগীতের সুরে ভেসে যাচ্ছে স্কুল প্রাঙ্গন:

Amazing Grace ! How sweet the sound
That saved a wretch like me !
I once lost , but now am found ;
Was blind , but now I see

বেড়িয়ে আসার সময় স্কুলের প্রধানশিক্ষক গেট অবধি এগিয়ে দিলেন । দেখলাম ওনার মুখে তখনও সুর্যোদয়ের রক্তিমা লেগে রয়েছে । অনির্বচনীয় আনন্দে সে মুখ উদ্ভাসিত । আমি অটো করে ফিরতে ফিরতে মানসচক্ষে দেখতে থাকি এই সব স্বয়ংসেবকদের হাত ধরে এই ধরনের গ্রামীন স্কুলগুলোর কথা ঘাটশিলার সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ছে শুধু রাঁচী নয় , কলকাতা নয় দেশের প্রতিটি কোনায় ।

​সৌভিক বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.