
ওই ‘লিটল বয়’-ই বুঝি লিখে দিল জাপানের ললাটলিখন। কেবল জাপান বলি কেন, গোটা বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল হিরোসিমার ওই বিস্ফোরণ। তারিখটা ছিল ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট ।
জাপানের হিরোসিমায় ‘জিরো পয়েন্টে’ দাঁড়িয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম সেদিনের সেই বীভৎসতার মাত্রা। মেলাতে পারলাম না। কারণ সেদিন যে শ্মশাণপুরি তৈরি হয়েছিল সেখানে, এখন সেই স্থানে এক অপরূপ সংরক্ষিত এলাকা। হিরোশিমায় যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল, মার্কিনীরা তার নাম দিয়েছিল ‘লিটল বয়।’ এটির শক্তি ছিল প্রায় ১২ হতে ১৫ হাজার টন টিএনটির বিস্ফোরণ ক্ষমতার সমান।
প্রতিদিন দেশ-বিদেশের মানুষ আসেন। শ্রদ্ধা জানান প্রয়াতদের স্মৃতির উদ্দেশে। আর হয়ত অনেকেই আক্রমণের মাত্রার নিরিখে ভাবেন, মানুষ এত নৃশংস হতে পারে। ২০২০-তে করোনাকালেই কেটে গিয়েছে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার ৭৫ বর্ষপূর্তি। ৭৬ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় শেষের পথে, তখন আগস্টের ৬ এবং ৯ তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে কত লোক মারা গিয়েছিল, তা মূলত আনুমানিক হিসেব। ধারণা করা হয় হিরোশিমা শহরের সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কেবল বোমার বিস্ফোরণেই মারা যায়। আর নাগাসাকিতে মারা যায় ৭৪ হাজার মানুষ।
বিশ্বে সেই প্রথম কোনও যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল এই গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র। পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলিতে আরও বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের ‘আসাহি শিমবুন’-এর হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ মানুষ।
হিরোশিমা জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর চুউগোকু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নগর। টোকিও থেকে দূরত্ব প্রায় ৮০৮ কিলোমিটার। জাপান সফরে গিয়ে আমরা একদল পর্যটক গিয়েছিলাম হিরোশিমায়। পাঁচ বর্গমাইল এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণে। সংরক্ষণ করা হয়েছে ধ্বংশের স্মৃতি। পরমাণু বোমা হামলার স্মারক হিসেবে এটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই গম্বুজটির অবস্থান হিরোশিমার শান্তি স্মারক পার্কে। এটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে ঘোষণা করেছে। একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ। ছোট ছেলেমেয়েরা আসছে প্রয়াতদের শ্রদ্ধা জানাতে। স্মরণসৌধে ফুল নিবেদন কছে। দল বেঁধে, সুলৃঙ্খলভাবে। অনেকে বসে ছবি আঁকছে।
আমরা গেলাম ওই চত্বরেই হিরোশিমা সংগ্রহশালায়। ছবি ও সামগ্রি— সব মিলিয়ে দেখতে ঘন্টা দুই সময় লেগে যাবে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় ইস্পাতের দরজা কীভাবে তুবড়ে গিয়েছে, তা দেখলাম। আছে হিরোশিমার ধ্বংসস্তুপে পাওয়া এক ঘড়ি, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক ৮ টা ১৫ মিনিটে। পুরো চিত্র পরিস্কার করার জন্য রয়েছে কিছু পুনর্নির্মাণ। ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে যা থেকে বোমা ফেলা হয়, সেই ইনোলা গে বিমানের ক্রুরা। আছে পাখির চোখে দেখা পরমাণু বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগরী, নির্দিষ্ট নানা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর প্রভৃতি।
ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াই থেমে গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৭ই মে। এরপর মিত্র বাহিনী ২৮শে জুলাই জাপানকে আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দেয়। এই সময়সীমার মধ্যে জাপান আত্মসমর্পণ করেনি। এই বোমা হামলার পর এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৪ই আগস্ট জাপান নিঃশর্তভাবে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। অনেকে দাবি করেন, এই বোমা হামলার আগে থেকেই আসলে জাপান আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরমাণু বোমার ভয়েই জাপান আত্মসমর্পণ করে বলে যে কথা বলা হয়, তা ঠিক নয়।
পাক্কা ৭৬ বছর পেরিয়ে গেল। কেবল ওই বিস্ফোরণের দৌলতে হিরোশিমা এখন বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। বিশ্বের শিল্পোন্নত শহরগুলোর অন্যতম। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ’১৬-র অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী মোট উৎপাদকের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৭৪। জনসংখ্যা ২৮ লক্ষ ৪৩ হাজারের মত (২০১৫-র হিসাবে)। ব্যস্ত শহর। আবাসিকরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বিস্ফোরণে প্রয়াতদের।
অশোক সেনগুপ্ত