গণতন্ত্রের রক্ষক

২০১৪ সালের লোকসভা ভোট। বেলুড় লিলুয়ার মাঝে এক স্কুলে ভোট নিতে গেলাম প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে।শুনেই গেছি ঝামেলার জায়গা। ভোটের আগের দিন বিকেল বিকেল গিয়ে ঢুকলাম। কাগজ পত্র নিয়ে বসেছি। গ্রুপের বাকি তিন সদস্য আনকোরা নতুন। মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে কাজ চলছে। বুথে এসে হাজির হলো একপাল লোক। আমাদের পাত্তা না দিয়ে ঘরের সব কিছু পরিদর্শন করতে লাগলেন।ঘরের দেয়ালে ছাত্ররা কিছু কাগজের জাতীয় পতাকা লাগিয়েছিল কোনো সময়।তার কিছু রয়েছে।তার মধ্যে একটা উল্টো ছিল।সেদিকে আঙুল তুলে হুংকার ছাড়লেন,উল্টো পতাকা,হবে না,সি পি এমের কুত্তা গুলো টিচার হলে আর কি শেখাবে? বুঝলাম আঙুল আসলে আমাদের দিকেই উঠলো।তারপর কোমরে হাত দিয়ে তাদের মধ্যে নেতা গোছের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, প্রিসাইডিং কে? মুখ তুলে বললাম আমি। তিনি অন্যদের বললেন, এই স্যারেরা কি খাবে লিখে নে তো।বিরিয়ানি, চিকেন, নাকি পাকা মাছ দেখ? আর এখন ভালো করে টিফিন চা এইসব দে। সন্ধ্যে বেলা কোল্ড ড্রিঙ্কস দিস। আর হ্যাঁ স্যার,কাল কাগজপত্র আপনারা সামলাবেন,ভোট আমরা করবো।এখানে এইরকমই হয়। তখন স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী পেছন থেকে এগিয়ে এলো রুক্ষ এক ছোকরা। জামা তুলে পিঠের একটা দাগ দেখিয়ে বললো, আগের আমলে ছাপ্পা আটকাতে গিয়ে চপার খেয়েছি,কাল যে আটকাবে তাকে আমরা চপার দেবো। নেতা আবার বললেন,স্যার কাল আমরা টাইম টু টাইম খাবার নিয়ে সাত আটজন ঢুকবো।গেটে সেন্ট্রাল ফোর্স আটকালে একটু বলে দেবেন। চলি নমস্কার। আমি সেন্ট্রাল ফোর্স নামক বস্তুটি খোঁজ করলাম।তারা দোতলায় আছে। সন্ধ্যের পর থেকে তারা ডিউটি শুরু করবে। একটু পর কোল্ড ড্রিংকস এলো।আমি বলে দিলাম খাবারের অর্ডার দিয়েছি।আপনাদের কিছু করতে হবে না। ফার্স্ট পোলিং বললো কাল সকালে কি হবে স্যার? বললাম দেখা যাক।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা।আমার ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন এক সাড়ে ছয় ফুটের দৈত্য।পাকানো গোঁফ কানে ঠেকেছে। হাতে একটি তেপায়া ছোট্ট স্ট্যান্ড। মোলায়েম গলায় বললেন,ইয়ে কাঁহা পর বৈঠানা হ্যায় স্যারজি।আমি বললাম ইয়ে ক্যায়া হ্যায়? উনি বললেন মেরা হিফাজত মে এক মেশিন গান হ্যায়। উসকা স্ট্যান্ড। দরোয়াজা কে বাহার বৈঠা দু স্যার? বললাম দিজিয়ে। তারপর বললেন, হাম ইহা পর রহুঙ্গা দিনভর।কই দিক্কত হো তো বুলা লিজিয়ে গা। কার্ড কে শিবা স্কুল মে কোই নেহি ঘুসেগা। মেইন গেট পর হামারা চার বান্দা হ্যায়। তারপর সারাদিন কার্ড ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিল না। একবার একজন বললো আপনাদের খাবার এনেছে গেটে আটকে আছে,স্যার গিয়ে একটু মিলিটারি কে বলে দিন। আমি বললাম খাবার দরকার নেই। দুপুরে সেই চপার বয় ভোট দিতে এসে আগুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো স্যার ভালো হচ্ছে না। আমি বললাম,ভোট দিন, কথা বাড়াবেন না। তার গলা চড়ল, তখন দরজা দিয়ে গলা বাড়ালো এক জোড়া গোঁফ। আমি ইশারা করলাম। ইঁদুর ধরার ভঙ্গিতে কলার ধরে তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে এলো মস্তানকে। তারপর সারাদিন নির্বিঘ্নে ভোট হলো।শেষ হবার পর সেই সেন্ট্রাল ফোর্স এর বীর কে বললাম, আপলোগ নেহি হোতে তো বহুত মুশকিল হোতা। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, যব হাম হ্যায়,হর মুসিবত কা জিমেদারি হামার হ্যায়। তারপর বারবার সেই কথাটা কতোটা সত্যি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি।

২০১৯ লোকসভা। পড়লো হাওড়ার পাঁচলার এক গ্রামে। মেশিন নেবার সময় নামটা শুনেই রিটার্নিং অফিসার চমকে উঠলেন। হাই সেনসেটিভ বুথ স্যার। পঞ্চায়েত ভোটে রিপোল হয়েছিল,খুব ঝামেলা হয়েছিল। তারপরেই চোয়াল শক্ত করে বললেন, এবার সেন্ট্রাল ফোর্স থাকছে।সিকিউরিটির ফুল গ্যারান্টি দিচ্ছি,কেউ দাঁত ফোটাতে পারবে না। গেলাম বুথে। ঘরের মধ্যে পঞ্চাশ জনের বেশি লোক এসে ঢুকলো।হইচই হট্টগোল, কাজ করবো কিভাবে ভাবছি। মিনিট পনেরো পরে ফোর্সের গাড়ি ঢুকলো। ঢুকেই চার জন জাস্ট মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ঘর ফাঁকা করে পজিশন নিলো। পরদিন অনেক ঠেলাঠেলি হইচই হলো,কিন্তু সব বুথের বাইরে।ঘরের মধ্যে কাউকে কার্ড ছাড়া ঢুকতেই দিলো না। বিকেলের দিকে এক এজেন্ট ঘরের ভেতর আরেকজন কে বলছেন,ওই মাঠে দেখ কি হচ্ছে।তাকিয়ে দেখি এলাকার এক নেতা মাঠের মাঝে কান ধরে উঠবোস করছে,আর এক জোয়ান ভিডিও করছে।নেতাকে ঘিরে রেখেছে সাত আটজন সেনা। সারা মাঠের লোক দেখছে সেন্ট্রাল ফোর্সের সাথে টক্কর নেবার পরিণতি।

এই বিধানসভা ভোটে ডিউটি উলুবেড়িয়া। CISF এর টিম নিরাপত্তার দায়িত্বে। সারা দিন বিক্ষিপ্ত ঝামেলার মাঝেও আমাদের গায়ে কোনো আঁচ লাগতে দেন নি ওরা। ভোটের পর যিনি আমাদের খাওয়ানোর দায়িত্বে ছিলেন তিনি বললেন,আজ যে এজেন্টরা স্যার স্যার করলো। সেন্ট্রাল ফোর্স না থাকলে ওরাই তখন বাঘ।পারলে আপনার চেয়ারে বসে পড়ে। কিন্তু ওই ছাপা জামার লাঠি আগে খেয়েছে।তাই ওদের কাছে সব শান্ত।

এবার আমার দুই বন্ধুর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা শোনাই। দুটোই ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত।সেই মীরা পাণ্ডের সাথে ফোর্স নিয়ে দ্বন্দ্ব। সেবার বুথে সেন্ট্রাল ফোর্স ছিল না,তারা এলাকায় টহল দিচ্ছিল। যেখানে গোলমালের খবর সেখানেই তারা দ্রুত পৌঁছে যাবে।

আমার বন্ধু ভোট নিতে গেলো হাওড়ার এক গ্রামে। ভোট শুরুর পর এক নেতা এসে ঘরে এক চেয়ার পেতে বসে ঘোষণা দিলো কারোর আই কার্ড দেখবেন না। হাতে কালি দেবার দরকার নেই।আর রোজা চলছে।সারাদিন আমরাও খাবো না,আপনারাও খাবেন না। বন্ধু সেক্টর অফিসারকে ফোন করলো। তিনি বলছেন এজেন্টরা আপত্তি না করলে মানিয়ে নিন।কাগজপত্র ঠিক রাখুন। সারা দিন সেই নেতা যাচ্ছেতাই করলো ভোট নিয়ে।ঘরের মধ্যে একদল লোক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতি ক্ষেত্রেই সেক্টর অফিসারের একই বুলি, মানিয়ে নিন। বিকেলে পোল ক্লোজ হবার সময় বন্ধু যখন লাইনের স্লিপ দিতে যাচ্ছে তখন নেতা বললেন এখন ওসব হবে না। যতক্ষণ লোক আসবে ভোট নিতে হবে। বন্ধু আর মানিয়ে নিতে না পেরে স্লিপ দেওয়া শুরু করতেই নেতার নির্দেশে তার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো।দুই ধাক্কা দিয়ে বন্ধুর হাত থেকে সিল,স্লিপ সব কেড়ে নিলো। বন্ধু আস্তে আস্তে বাথরুমে গিয়ে সেক্টর অফিসারকে বললো,অনেক হয়েছে।১৫ মিনিট দেখবো ফোর্স না এলে কমিশনে মেসেজ পাঠিয়ে আমি বুথ ছেড়ে চলে যাবো।সেক্টরের টনক নড়লো। মিনিট ১৫ পর, দুখানা টাটা সুমো ঢুকলো। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো সিআরপিএফ।ঘরে সেই একপাল লোক।ফোর্স এজেন্ট পাশ আর ভোটার স্লিপ দেখতে চাইলো। কারোরই প্রায় নেই।শুরু হলো ফাইবার স্টিকের ব্যাটিং।যে খাচ্ছে আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নেই। নেতা গর্জন করে উঠলো আমি কমপ্লেন করবো। কথা শেষ হবার আগেই একটি লাথি পড়লো তার বুকে আর চেয়ার নিয়ে তিনি মেঝেতে। তারপর দুই তিনজন মিলে আদর যত্ন করে টেনে ঘরের বাইরে দিয়ে এলো। ১৫ মিনিটে খেলা শেষ।ওরা দাঁড়িয়ে থেকে মালপত্র গুছিয়ে সেক্টর অফিস পৌঁছে দিলো।

সেই বছরই আরেকজন স্যার খুব কড়া হাতে সামলে ভোট করিয়ে ফিরছেন অটো করে। পঞ্চায়েত ভোট,তাই অন্ধকার হয়ে গেছে।মাঠের মাঝখান দিয়ে রাস্তা,দুদিকে শুধু ধানক্ষেত। অটো চলছে। হঠাৎ স্যারের মোবাইলে সেক্টর অফিসারের ফোন।” স্যার আপনাদের ব্যালট বাক্স লুঠ হতে পারে।বুথ থেকে ১০/১৫ টা বাইকে জনা ৩০ লোক আসছে। আপনি অটো কে প্রাণপণে চালাতে বলুন। আমি সেন্ট্রাল ফোর্স পাঠাচ্ছি। অটো যতটা পারে স্পিড বাড়ালো। একটু পরে দূরে দেখা গেল অন্ধকারে বেশ কিছু হেড লাইট আসছে। দূরত্ব কমছে ক্রমশ।যখন ২০০ মিটার দূরে সামনে থেকে হুস করে দুটি সুমো। অটো কে ক্রস করে রাস্তায় আড়াআড়ি দাঁড়ালো। মুহূর্তে নামলো ফোর্স।পলকে পজিশন নিয়ে চিৎকার দিলো। তারপর কেউ বাইক ঘোরালো,বেশির ভাগই বাইক ফেলে ধান জমির কাদায়।যদি গুলি চালিয়ে দেয়। সেন্ট্রাল ফোর্স কে বিশ্বাস নেই।

সেই বিশ্বাসটাই আছে আমাদের। তাইতো লোকসভা ভোটে সেন্ট্রাল ফোর্সের নিরাপত্তা চেয়ে ভোট কর্মীদের অতো উত্তাল বিক্ষোভ।তাইতো প্রতি জনের ভোটের ছবি আর গল্পে মেন ক্যারেকটার ওই সেন্ট্রাল ফোর্স। তাদের দেখে বুঝি ডিউটি কাকে বলে,বুঝি অতন্দ্র প্রহরী বলতে কি বোঝায়, বুঝি ক্লান্তিহীন জীবন কাকে বলে।সেই বিশ্বাস আছে সাধারণ মানুষের। ভোট লুটেরাদের ডান্ডা মারার ক্ষমতা আর কার আছে? তাই ভোট এলেই তাদের মুখ চেয়ে থাকি। তাদের কাছে গনতন্ত্র সবচেয়ে নিরাপদ। ভারতমাতার বীর সন্তান কেন্দ্রীয় বাহিনী।🙏

পার্থ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.