দেশভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট বিশ্বাসঘাতকতা

ভারত ছাড়ার আগে ব্রিটিশরা এই দেশের সর্বনাশের যে পরিকল্পনা করেছিল তার মধ্যে প্রধান হলো ভারতের পূর্ব-পশ্চিমে একটি অস্বাভাবিক দেশের জন্ম দিয়ে যাওয়া। যার জেরে ভারতবর্ষ আজও সন্ত্রাস কবলিত, দেশের বাইরে শত্রু, ভেতরে শত্রু নিয়ে স্বাভাবিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়ে অতীতের সম্পদশালিনী ভারতবর্ষকে তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হচ্ছে; ব্রিটিশের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদানের মর্যাদা ভারতবর্ষের মানুষ দিতে পারেননি, দেশভাগের নির্লজ্জ বাস্তবতাকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়েছে; ব্রিটিশ উদ্ভূত এই পরিস্থিতি এতটা সহজে তৈরি হতো না, যদি না ইংরেজরা নেহরুর মতো অনুগামী আর কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার মতো পরম মিত্র লাভ করতো।
আজ কমিউনিস্টরা কথায় কথায় হিটলারের জুজু দেখায় কিন্তু একদা এই কমিউনিস্টদের গুরুঠাকুর রুশ নেতা যোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে অ্যাডলফ হিটলারের দহরম মহরম ছিল। এমনকী হিটলারকে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামও দিত স্ট্যালিনের রাশিয়া। হিটলার- স্ট্যালিনের এই ভাবমূর্তি ভারতের আদি কমিউনিস্টদের যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করেছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এঁরা ক্রমশ মূল স্রোতের কমিউনিস্টদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। কারণ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল যা কমিন্টার্ন নামে পরিচিত, তার ঘোষিত নীতি ছিল যে রাশিয়ার স্বার্থরক্ষাই বিশ্বের সমস্ত কমিউনিস্টদের একমাত্র কর্তব্য।
কারণ জারের শাসন থেকে বেরিয়ে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউনাইটেড সোভিয়েত স্টেটস অব রাশিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তাই কমিন্টার্নের যাবতীয় কর্তৃত্ব এই দেশটির হাতেই চলে যায়। আর সমাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার মহান উদ্যোগে কমিউনিজমের নামে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির কমিউনিস্টদের ওপর খরবদারি চালায় স্ট্যালিনের রাশিয়া। ভারতের কমিউনিস্টরাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতবর্ষের আদি কমিউনিস্ট সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে কমিউনিস্টদের স্ট্যালিন আনুগত্যের কদর্যতা ধরা পড়েছিল এবং তিনি এর প্রতিবাদও করেছিলেন।
তবে হিটলার-স্ট্যালিন গোপন আঁতাত বেশিদিন গোপন থাকেনি। ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট জার্মানি-রাশিয়ার মধ্যে নন অ্যাগ্রেশন ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া-জার্মানি কখনোই পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণে যাবে না। এই চুক্তির একটি ‘সিক্রেট প্রটোকল’ও রাখা হলো, যা সেই মুহূর্তে প্রকাশিত হয়নি, প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যাতে করে রুশ-জার্মান সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি আরও পরিস্ফুট হয়। আন্তর্জাতিক এই পরিস্থিতিতে স্ট্যালিনের হাতের পুতুল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তিরিশের দশকে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তার প্রধান কারণ যত না ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল, তার থেকেও বেশি করে ছিল রাশিয়ার স্বার্থরক্ষা। ব্রিটিশরা রুশ-জার্মান বিরোধী, এই চিন্তাই তাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। পরবর্তীকালে বৃহত্তর সংখ্যক কমিউনিস্টদের মহাগুরু মাও-সে-তুংও ছিল জার্মান-রুশ ঐক্যের প্রবল পন্থী।
কিন্তু পরিস্থিতির মোড় ঘুরল ১৯৪১ সালে এসে। সমস্ত চুক্তি- সন্ধি নস্যাৎ করে ২২ জুন হিটলার আক্রমণ করে বসেন রাশিয়াকে। এই পিতৃ-আক্রমণ এদেশের কমিউনিস্টদের ভীষণভাবে নাড়া দেয়। অপছন্দের হলে হিটলারের সঙ্গে তুলনায় চলে যায়। কারণটা স্পষ্ট, পিতৃ-অপমানের জ্বালা কমিউনিস্ট পার্টিকে অনবরত বইতে হচ্ছে আজও। স্রেফ রাশিয়াকে আক্রমণ, একদা হিটলার প্রেমী কমিউনিস্টদের এখন হিটলার-বিদ্বেষীতে রূপান্তরিত করেছে এবং অপছন্দের সবকিছুতে হিটলারের ছায়া দেখাতে অভ্যস্ত করে তুলেছে।
এর উপরে ১৯৪১ সালেরই ১২ জুলাই রাশিয়া ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া সংক্রান্ত এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এতদিন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার যে রণনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে গগন বিদীর্ণ করা হচ্ছিল, এক লহমায় না হলেও আস্তে আস্তে পার্টি লাইন পাল্টে যাচ্ছিল। ১৪ ডিসেম্বর সিপিআই-এর পিসি যোশী ভারত সরকারের প্রতিনিধি রেজিনাল্ড ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জেলবন্দি কমিউনিস্টদের মুক্তি দেওয়ার কাতর আবেদন জানালেন। সঙ্গে ব্রিটিশদের নিঃশর্ত সমর্থনের আশ্বাস। ফলে একদা যা কমিউনিস্টদের কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই ছিল, তার পন্থা বদল হলো, ব্রিটিশ সহযোগী জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হলো তা। ভারতীয় কমিউনিস্টরা রুশ সহযোগী ব্রিটিশদের মধ্যেই খুঁজে পেল তাদের নতুন প্রভুকে।
১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট গান্ধী ভারত ছাড়ো’আন্দোলনের ডাক দিলেন। শুরু হলো কমিউনিস্টদের বেনজির বিশ্বাসঘাতকতা। কংগ্রেসের পূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলনকে অবদমিত করতে সুচতুর ইংরেজ কমিউনিস্টদের ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে এও দেখা যাবে ব্রিটিশের বিশ্বস্ত অনুগত হিসেবে কমিউনিস্টরা মুসলিম লিগের সক্রিয় সহযোগীরূপে দেশভাগের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিল। ওই বছরে ২২ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের মাধ্যমে একটি সনদ ভারতে পাঠানো হয়। সমস্ত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস, এমনকী সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগ পর্যন্ত এই ক্রিপস মিশন প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু কমিউনিস্টরা। রাশিয়া সহযোগী ইংল্যান্ড তখন তাদের প্রভু। সেই প্রভুর অনুগত সেবক হিসাবে ভারতীয়দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বলিদান দেওয়া উচিত, কমিউনিস্ট পার্টি তাদের মুখপত্রে তা প্রচার করল, অবশ্যই ‘জনযুদ্ধ’ নামক নয়া তত্ত্বের মোড়কে।
শুধু তাত্ত্বিক প্রচার করেই থেমে থাকল না, নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেরিলা কায়দায় লড়াই করার জন্য ‘বি-ক্যাটিগোরি’ সৈন্যদল গঠনের প্রস্তাব পর্যন্ত নেওয়া হলো কমিউনিস্ট পার্টির তরফে। এরপর শুরু হলো ব্রিটিশ-বিরোধী যাবতীয় আন্দোলনে ‘স্যাবোটেজ’ করার ছক। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়্যার’ সরাসরি ইংরেজদের পক্ষে তাত্ত্বিক অপযুক্তি শানাতে লাগল। তাদের মূল রাগ ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ওপর। ১৯৪৩ সালে পিপলস ওয়্যার -এর বিভিন্ন সংখ্যায় জাপানের সহযোগী হিসেবে নেতাজীকে চিহ্নিত করে নানারকম অশ্লীল ব্যঙ্গচিত্র আর কটু মন্তব্যে ভরে ওঠে কমিউনিস্ট মুখপত্রের পাতা। নেতাজীকে আখ্যা দেওয়া হয় জাপানি মার্শাল তেজোর কুকুর হিসাবেও।
নেতাজীর পাশাপাশি আরও একজন যে মানুষটি কমিউনিস্টদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন, আজ তাঁর প্রেমে এদের গদগদ দেখায়, তিনি হলেন মোহনদাস করমচঁাদ গান্ধী। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর ঠিক আগে কমিউনিস্টদের মুখপত্রে গান্ধীজীকে কটু আক্রমণ করে দেশবাসীকে রাশিয়া ও চীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে উপদেশ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৩ সালের ২৩ মে-১ জুন বোম্বেতে (এখন মুম্বই) কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো কমিউনিস্ট আক্রমণের হাত থেকে আশ্চর্যজনকভাবে রেহাই পেয়ে গেছেন। জওহরলাল নেহর। কারণ কমিউনিস্টরা মতাদর্শগতভাবে নেহরুকে তাদের বন্ধু মনে করত। তাছাড়া কট্টর সুভাষ-বিরোধী জওহরলালের আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরোধিতা তাকে কমিউনিস্টদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।
স্বাধীন ভারতে ক্ষমতায় আসার পরও কমিউনিস্টদের সঙ্গে নেহরুর সখ্য বজায় থাকে। লোকদেখানি নিষিদ্ধ ঘোষণা হলেও কমিউনিস্ট নেতাদের গায়ে তার আঁচ লাগতে দেননি তাদের পরম মিত্র নেহরু। আজ যারা ‘নেহরুর ভারতে’র শোকে মুহ্যমান, তাদের মতাদর্শ ঠিক কী, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এদের সাংস্কৃতিক পূবপুরষদের বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ বুঝতে পারা যাবে এদের দেখলে। ব্রিটিশরা যেদিন বুঝতে পারল ভারত শাসন করা আর যাবে না, সেদিন তারা জন্ম দিতে চাইল এমন এক সন্ত্রাসদীৰ্ণ দেশের যারা ভবিষ্যতে ভারতের উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হবে। আর একাজে ইংরেজদের দিকে অকৃত্রিম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক প্রবক্তা সাজ্জাদ জাহির পাকিস্তানের সমর্থনে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি ন্যায্য, প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে ইতিবাচক ও গণতান্ত্রিক একটি বক্তব্য। মুসলিম লিগের দ্বিজাতি তত্ত্বকে কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।
মুসলিম লিগকে দিয়ে ইংরেজরা ভারতকে দুর্বল করতে দেশ-বিভাজনের যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাতে কিছু পক্ষের প্রত্যক্ষ মদতের প্রয়োজন ছিল। একদিকে কমিউনিস্টদের পাশে পেয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরা, অন্যদিকে লেডি মাউন্টব্যাটেনের প্রতি আসক্ত নেহরুকেও প্রধানমন্ত্রিত্বের টোপে বন্দি করে ফেলেছিল ইংরেজরা। পাকিস্তানের দাবির পক্ষে কমিউনিস্ট মুখপত্র স্রেফ তাদের সমর্থনই জানায়নি পূর্ব পাকিস্তানের নকশা তৈরি করা থেকে শুরু করে বাঁটোয়ারাও করে দিয়েছিল, যার পেছনে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদত অবশ্যসম্ভাবীই ছিল।
পরিশেষে বলা চলে ইংরেজদের উদ্দেশ্য একপ্রকার সফলই হয়েছে। কাশ্মীর সমস্যা থেকে শ্যামাপ্রসাদ হত্যা, ভারতকে দুর্বল করতে নেহরুর অসামান্য সব কুকীর্তি, আর স্বাধীন ভারতকে চীনের তাবেদারিতে এখন পাকিস্তানের হয়ে ওকালতিতে কমিউনিস্টদের অক্লান্ত প্রয়াস ভারতবাসী মাত্রেরই ভোলা অসম্ভব। আরও দুর্ভাগ্যের, ইতিহাসের মূল ধারা এখন কমিউনিস্টরাই কুক্ষিগত করে রেখেছে। অথচ কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহিতাকে কুনকে করে আমাদের প্রকৃত ইতিহাসের প্রকৃত পরিমাণ ঠিক করা উচিত ছিল। সেটা যে করা যায়নি তার জন্যও নেহরুর কাছে কমিউনিস্টরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তাই এই দেশদ্রোহী মতাদর্শের লোকেরা আজও নেহরুপন্থী ভারতের শোকে মূহ্যমান থাকে, আর দেশের খেয়ে-পরে দেশবাসীরই দাড়ি ওপড়ায়। মোদীর শক্ত সমর্থ ভারত’ দেখলে আর্তনাদ তো এদের ক্রোমোজমিয় বৈশিষ্ট, জিনে লেখা।
তথ্য ঋণ :
(১) কমিউনিস্ট পার্টি : মুখ ও মুখোশ—জাবালি। (২) ওরা শুধু ভুল করে যায়—শান্তনু সিংহ।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.