“ভাষা বাঁচাতে গেলে ছেলেমেয়েদের বাংলায় পড়াতে হবে“

ভাষা দিবসের প্রাক্কালে ডঃ পবিত্র সরকারের সঙ্গে আলাপচারিতায় অশোক সেনগুপ্ত।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয় মেজরিটি, প্রথম নয় ডেবিউ, ফোন ধরে নয় ফোন রিসিভ করে, ধুয়েমুছে সাফ নয় ওয়াশআউট, সমীক্ষা নয় সার্ভে, ব্যবধান নয় মার্জিন,
লক্ষ্য নয় টার্গেট, মেধা তালিকা নয় মেরিট লিস্ট। এভাবেই আমরা গলা টিপে মুছে দিতে চাইছি অতি প্রচলিত বাংলা নানা শব্দ। কেবল মুখের বাংলা কথাই নয়, এফ এম থেকে পোর্টাল, চ্যানেলের অনলাইন বার্তা, বিজ্ঞপ্তির বাংলা ভাষা প্রায় সবেতেই। ক্রমেই কি ব্রাত্য হয়ে উঠছে বাংলা? রোজ বিকেলে একটি জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শো-র অংশগ্রহণকারীরা সকলেই বলেন, “একটা জব করছি“। আর সামাজিক মাধ্যমে তো বাংলা বানান এবং ব্যাকরণের শ্রাদ্ধ।

১) ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা নিয়ে আমাদের প্রাণ কাঁদতে থাকে। বছরের বাকি সময়টা এই বোধ বাঙালিদের মধ্যে আপনি কতটা দেখেন?
উত্তর— এই প্রাণ কাঁদার ব্যাপারটা ভন্ডামি। দ্বিমুখী আচরণ। ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াব, বাংলা ভাষার প্রতি নজর কমানোর চেষ্টা করব, আর বাংলা-প্রীতির কথা বলব। এটা অনেক বাঙালির অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২) অনেকে মনে করেন গত কয়েক দশকে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কমেছে। আপনার ধারণা কী? বাংলা মাধ্যমে পড়ার প্রবণতা কমে যাওয়া কি এর অন্যতম কারণ?
উত্তর— হ্যাঁ। অনেকের ধারণা, ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়িয়ে কী হবে? এর কোনও বাণিজ্যিক গুরুত্ব নেই। কিন্তু এই সরল সিদ্ধান্তটা ভিত্তিহীন। বিভিন্ন ভাষার শক্তির তারতম্য থাকে। ইংরেজির বাণিজ্যিক শক্তি বেশি। কিন্তু নীরদ সি চৌধুরী থেকে অশোক মিত্রের মত মানুষরা অনেকে বাংলা মাধ্যমের পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। মফস্বলে পড়া অনেকে নাম করেছেন।

৩) সরকারি কাজে বাংলার বহুল প্রয়োগের কথা গত কয়েক দশক ধরেই শোনা গিয়েছে। কিন্তু বাম ও তৃণমূল আমলে রাজ্য সরকার কতটা আগ্রহ দেখিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর— বরাবর আমলাদের একটা প্রভাবশালী অংশ রাজ্যের সরকারি কাজে বাংলা চালুতে বাধা দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা ইংরেজিতে বেশি অভ্যস্ত, এবং আমলাদের অনেকেই অবাঙালি। মুখ্যমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতেন, একমাত্র তবেই এদিক থেকে সুফল পাওয়া যেত।

৪) মুখের কথার মত এখন লেখাতেও অহরহ চালু বাংলা শব্দের বদলে ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এটা সার্বিকভাবে বাংলা ভাষার কতটা ক্ষতি করছে? এর প্রতিকারের পথ কী?
উত্তর— সমস্যাটা কমবেশি প্রায় সব ভাষার। যে কারণে বাংলিশ, হিন্দলিশ, তামলিশ প্রভৃতি কথা তৈরি হয়েছে। গত শতাব্দীর মাঝপর্ব থেকে গোটা বিশ্বে ভাষার অবলুপ্তির একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তবে, হারিয়ে যেতে বসা ভাষার পুনরুজ্জীবনের কিছু চেষ্টাও শুরু হয়েছে। ইংলন্ডের কর্ণওয়ালিশ অঞ্চলের চাষিরা একসময় কর্ণিশ ভাষা বলত। ইংরেজির দাপটে তা মুছে যেতে বসেছিল। তেমনই অষ্ট্রেলিয়ায় মাওরি ভাষারও একই হাল হয়েছিল। এগুলো বাঁচিয়ে তোলার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে।

ভাষার এই বাঁচামরা নিয়ে কতটা ভাবনাচিন্তা হয়?
উত্তর— লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি অব আমেরিকা তাদের
পত্রিকা এথনোলগ্-এ খুনি ভাষার দাপটের ওপর আলোকপাত করেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, মানুষ যখন কথা বলতে শেখে প্রায় ১৫ হাজার ভাষা ছিল। বিংশ শতকে তা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। একবিংশ শতকে আরও অর্ধেক হয়ে যাবে।

৫) বাংলাদেশ না থাকলে বাংলা ভাষার প্রচলন আরও কমে যেত বলে মনে করেন অনেকে। আপনার কী মত?
উত্তর— কিছুটা তো ঠিক। ওরা উদ্যোগী হয়েছিল বলেই বাংলাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছে। তবে ওদেশেও এখন এখানকার মত খিচুরি ভাষা বা বাংরেজি ছড়াচ্ছে।

৬) বাংলা ভাষার মানোন্নয়নে কোনও প্রস্তাব দেবেন?
উত্তর— গত বছর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিট্যুটকে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে আমি বলেছি শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় পড়াতে। পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি পড়াতে। কারণ, সমুদ্রে যেমন হাওয়ার ও স্রোতের গতি আছে, তেমনই জ্ঞানেরও একটা গতি আছে। সেটা আসে পশ্চিম থেকে। মাতৃভাষার গুরুত্বের সঙ্গে ইংরেজির গুরুত্বের প্রাধান্য দিতে হবে।

৭) কেন্দ্রীয় সরকার মাতৃভাষার উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা বলছে। সেটা কতটা বাস্তবমুখী?
উত্তর— না, ওরা হিন্দি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। হিন্দি শেখায় আপত্তি নেই। কৌশলে চাপিয়ে দেওয়াটা আপত্তির।

(পবিত্র সরকার নামক ঘটনাটির বর্ণনা করা খুব সহজ কাজ নয়। এক হল তাঁর শিক্ষাদীক্ষা ও অধ্যাপনার উজ্জ্বল র্জীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও এমএ-তে দু-বার প্রথম হওয়া, ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানে এমএ ও পিএইচ ডি করেছেন, যাদবপুরে পড়িয়েছেন প্রায় সাতাশ বছর, বিদেশে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-বছর, এবং এখনও লেখালেখি নিয়ে অক্লান্ত থাকছেন। রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সাত বছর, ছ-বছর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা সংসদের সহ-সভাপতি।

লেখাতেও অক্লান্ত ও বহুমুখী। ভাষাবিজ্ঞান ও ব্যাকরণ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, ইংরেজি শিক্ষা, রম্যরচনা, শিশুদের জন্য ছড়া গল্প উপন্যাস রবীন্দ্রসংগীত, আত্মজীবনকথা—সব মিলিয়ে তাঁর নিজের বই সত্তরের উপর, সম্পাদিত পঞ্চান্নটির মতো। গান তাঁর প্রিয় ব্যসন। এক সময়ে নান্দীকারে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয়ও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ এ ত্রিপুরা সরকারের একাধিক ভাষা-বিষয়ক কমিটি ও কমিশনের অধ্যক্ষ করেছেন।
— বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.