বৌদ্ধযুগে বৌদ্ধ সাধকের দেহাবশেষের চিতাভস্ম সংগ্রহ করে তা কখনো একটি পাথরের পাত্রে, কখনো বা মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করে রাখা হতো। এই “চিতা” বা চিতাভস্মের স্মৃতিতে তৈরি এই সব বৌদ্ধ বিহার বা সংঘারাম পরিচিত হয়েছিল “চৈত‍্য” নামে।”চিতা” শব্দ থেকেই এসেছে “চৈত‍্য” শব্দটি। আর প্রাকৃত শব্দ “সংগ্রহম্” থেকে এসেছে “সংঘারাম” কথাটি। সংঘারামে সংরক্ষিত চিতাভস্মের নাম ছিল “ধাতু।”

বাঙালির পূর্ব পুরুষরা এক সময় অলৌকিক ধর্মগুরুর প্রতি আস্থাশীল ছিল। গুরুর মৃত্যুর পর তাঁর দেহ মাটিতে পুঁতে তার ওপরে মাটি বা পাথরের ঢিপি সাজিয়ে দিতো। এরপর সপ্তাহে একদিন সেই ঢিপি পরিস্কার করে ফুল দিত, ধূপ দিতো, প্রদীপ জ্বালতো। এই ঢিপির নাম ছিল “এড়ুক।” এই “এড়ুক” বৌদ্ধদের হাতে পড়ে হলো “চৈত‍্য” বা “স্তূপ।” এ থেকে হিন্দু সাধু-সন্তদের ক্ষেত্রে হলো “সমাধি।”

অনুসন্ধানে জানা যায়, বৌদ্ধ শ্রমণদের দেহভস্ম অস্তিকুম্ভে রেখে তার ওপর স্তূপ তৈরি করা হতো। শৈবধর্মের প্রাধান‍্যের বহু আগে থেকেই জৈন ও বৌদ্ধরা রাঢ়-বাংলায় প্রভুত্ব করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের বিবর্তনে এই ধর্মমত বজ্রযান, মহাযান, কালচক্রযান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বুদ্ধের পাঁচটি ধ‍্যানী পরিকল্পনা—লোকনাথ, অবলোকিতেশ্বর, ত্রৈলোক‍্যশঙ্কর, নীলকণ্ঠ ও বজ্রভৈরবরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে শিবসত্তাকে।

বিবর্তনও ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বীরভূম জেলার কোটাসুর গ্রামে মদনেশ্বর শিবমন্দির প্রাঙ্গণে বজ্রাসনে উপবিষ্ট রয়েছেন ছিন্ন মস্তক এক দিগম্বর মূর্তি, যা আসলে বজ্রভৈরব। বর্তমানে এটি ষষ্ঠী ঠাকরুণ নামে পুজো পাচ্ছেন গ্রামের মেয়েদের কাছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, এই মদনেশ্বর শিবমন্দির ও শিবলিঙ্গ হচ্ছে পালরাজ মদনপালের স্মৃতি সাক্ষ‍্য।

বর্তমান বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত স্থান হচ্ছে “চট্টগ্রাম।” এই নামকরণ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, একসময় এখানে অনেক চৈত‍্য ছিল এবং সেজন্য এর নাম হয় “চৈত‍্যগ্রাম” আর পরবর্তী সময়ে তা থেকে হয় আজকের “চট্টগ্রাম।” আবার কারো কারো মতে, কিছু বিদেশি বণিক এখানে অনেক চাটি বা সাটি অর্থাৎ প্রদীপ জ্বলতে দেখেছিলেন। তা থেকে স্থানটির নাম হয় “চাটিগাঁও বা চাটগাঁও বা চাটগাঁ।

এখানে একসময় ছিল পোর্তুগীজদের ঘাঁটি। তাঁরা অবশ্য চৈত‍্যগ্রাম, চাঁটগাও, চট্টগ্রাম কোনো নামই ব‍্যবহার করেন নি, তাঁরা নাম রেখেছিলেন “পোর্ৎ দ‍্য বাঙ্গালা।” সে সময় বাংলায় দুটি বড়ো বন্দর ছিল, একটি এই চট্টগ্রাম এবং অন‍্যটি হুগলী জেলার সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ। পোর্তুগীজরা এই দুটি বন্দরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম রেখেছিলেন “পোর্ৎ দ‍্য বাঙ্গালা” এবং সপ্তগ্রাম বন্দরের নাম রেখেছিলেন “পোর্ৎ দ‍্য গ্রাঁদি।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা উপজাতীয় মানুষজন বসবাস করছেন। এলাকাটি বৌদ্ধ প্রভাবিত।

চট্টগ্রামের বাংলা ভাষা কিছুটা অদ্ভুত ধরণের, যেমন, আমরা যদি বলি, ” আমি খাই না”, সেটা চট্টগ্রামের ভাষায় “আঁই ন খাই।”

আবার “আমি চলতে পারি না, ” চট্টগ্রামের ভাষায় হবে “আঁই চলিবারে পারি না।” সাধারণ বাংলার “আমি”, চট্টগ্রামের ভাষায় “আঁই।”

আরও উদাহরণ আছে, যেমন—কবুতর চট্টগ্রামের ভাষায় হচ্ছে “কৈতর।” সিমের বীজ হচ্ছে “চঁই।” আঠা হচ্ছে “লাসা।”

চট্টগ্রামের প্রসঙ্গে আসতেই হয় “ভরা বা ভারার মেয়ে”-র কথায়। বাঙলার উপকূলীয় অঞ্চল, যেমন, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বাখরগঞ্জ এলাকা থেকে পোর্তুগীজ জলদস্যুরা বিভিন্ন বয়সী ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতো। এর মধ্যে যে সব অবস্থাপন্ন বাড়ির লোক এইসব মেয়েদের কিনতো, তাদের বলা হতো “ভরার মেয়ে।”সে সময় উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন রাতের বেলা জেগে থাকতো, পাছে তাদের কোনো ছেলে-মেয়েকে হার্মাদরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এই সব পোর্তুগীজ জলদস্যুদের বলা হতো “হার্মাদ” ও “বোম্বেটে।”

চন্দননগরের “বিবির হাট”, তমলুকের “কেলো মালের বাজার” ও “রাধামণির বাজার” ছিল ভরার ছেলে-মেয়ের বাজারের জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে “বিবির হাট” ও ” রাধামণির বাজার ” ছিল ছেলে বিক্রির জন্য এবং “কেলো মালের বাজার” ছিল ছেলে বিক্রির জন্য বিখ্যাত।

মেয়ে সুন্দরী হলে তাকে ছেলের বৌ করা হতো আর ছেলে ভালো হলো সে হতো ঘরজামাই। আর ছেলে-মেয়ের চেহারা ভালো না হলে তারা হতো দাস-দাসী। তবে ছেলে ঘরজামাই হলেও তার সম্পর্কে উঁচু ধারণা ছিল না।

এ বিষয়ে একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে—

“বাইরের জামাই মধুসূদন, ঘরের জামাই মধো।

ভাত খাও’সে মধুসূদন, ভাত খেসে রে মধো। ।”

এ থেকে স্পষ্ট, ভরার বাজার থেকে কেনা ঘরজামাইয়ের সামাজিক মর্যাদা ততটা ছিল না। তবুও প্রচলিত ছিল ভরার ছেলে-মেয়ে নিয়ে উচ্চ বিত্তদের ঘর-সংসার করা।

বর্তমানে পোর্তুগীজরা না থাকলেও তাদের স্মৃতি রয়ে গেছে লোকসাহিত‍্য, লোকপ্রবাদ ও আঞ্চলিক ইতিহাসে। বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের পাশাপাশি এও এক ঘরোয়া ইতিকথা।

তথ‍্যসূত্র:

১) বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্য যুগ: ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার।

২) বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ও বাঙালি বৌদ্ধদের ক্রমবিবর্তন: সাধনকমল চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.