তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের গোপালগঞ্জ জেলার খান্দারপাড়ার সন্তান R.C. Majumdar। জন্ম ১৮৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর গ্রামের বাড়িতে। উচ্চ জমিদার বংশের মানুষ হলেও তাদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র রমেশচন্দ্র সাফল্যময় শিক্ষাজীবন শেষ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। ইতিহাসের গবেষণায় তাঁর হাতেখড়ি হয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের কাছে। তারপর ইতিহাসের গবেষণায় ছিলেন আমৃত্যু সক্রিয়। তাঁর সুদীর্ঘ কর্মমুখর জীবনে আপোষহীন সত্যানুসন্ধান ব্রত এক ইতিহাস হয়ে আছে। দরবারী ইতিহাস চর্চার আজীবন বিরোধী ছিলেন তিনি। অথচ ভিনসেন্ট স্মিথের পরে তিনিই প্রথম ভারতীয় ইতিহাসবিদ, যিনি ধারাবাহিক ভাবে সর্বাধিক ভারতেতিহাস রচনা করেছেন।

১৯২১ সালের ১জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে রমেশচন্দ্র মজুমদার এতে যোগদান করেন। ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোষ্ট হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে প্রথম দু’দশকের কথা জানা যায় তাঁর স্মৃতিকথা ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ থেকে। তৎকালীন ঢাকা শহরের সামাজিক অবস্থার নানা খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। এছাড়া এসময় ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের আগমন ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে কবির অবস্থানের মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায়। ঢাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে রমেশচন্দ্রের বিশ্লেষণ এই সময়কালকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে তিনি -কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, সরোজিনী নাইডু, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার ফিলিপ হার্টগ, আচার্য যদুনাথ সরকার, স্যার আকবর হায়দারী, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, স্যার লিউনার্ড উলি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বদের সাথে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। স্মৃতিকথা গ্রন্থে অকপটে জানিয়েছেন তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা এবং তাঁদের বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য। যা আমাদের এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবায়।

ইতিহাসের সত্যের প্রতি অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের দায়বদ্ধতা কতটুকু ছিল তা জানা যায়, ভারত সরকার দ্বারা গঠিত স্বাধীন ভারতের ইতিহাস প্রণয়ন কমিটির সভাপতির পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্তে। দরবারী ইতিহাসচর্চার বরাবরই বিরোধী ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসের সত্যকে বদলে দেয়ার বা নির্বাচিত অংশ গ্রহণের বিষয়ে তিনি আপোষহীন ভাবে প্রতিবাদী ছিলেন। সত্যানুসন্ধানে অবিচল থাকার জন্য জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। তবুও তাঁর ঐতিহাসিক সত্যবদ্ধ একনিষ্ঠতা তাঁকে করে তুলেছে এক প্রবাদপ্রতিম ভারততত্ত্ববিদ।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধানে তাঁর গবেষণা এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে (Hindu Colonies in the Far East)। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত Corporate Life in Ancient India আজো সমাদৃত। এছাড়া Early History of Bengal, The Outline of Ancient Indian History and Civilization, Inscription of Komboza, The Sepoy Mutiny and the Revolt of ১৮৫৭, বাংলাদেশের ইতিহাস (চার খণ্ড) তাঁর কিছু বিখ্যাত গবেষণামূলক কাজ। “ভারতীয় বিদ্যাভবন” থেকে বহুপরিশ্রমে ও বহুখণ্ডে প্রকাশিত ইতিহাস গ্রন্থমালার সম্পাদনা করা অধ্যাপক মজুমদারের কর্মজীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ।

তাঁর স্মৃতিকথার পরিশিষ্টে উল্লিখিত একটি লেখা থেকে জানা যায়, ভারতের স্বাধীনতায় অবদান বিষয়ে অধ্যাপক মজুমদারের অভিমত। তাঁর মতে ভারতের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তি বা একক দলের অবদান নয়। এ এক যৌথ প্রয়াসের ফলশ্রুতি। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন, নেতাজী সুভাষের আজাদ হিন্দ বাহিনী, বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাঁর এই অভিমত আজ সমাদৃত হলেও সেই সময়ে তিনি এর জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। কারণ স্বাধীনতা উত্তর ক্ষমতাসীন সরকার স্বাধীনতা অর্জনে অবদানের শিরোপা দলীয়ভাবে নিজেদের কাছে রাখতেই যত্নবান ছিল।

রমেশচন্দ্র মজুমদার কলকাতা, নাগপুর ও কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে College of Indology -র গোড়াপত্তনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। BHU -তে অধ্যাপনাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির যে চিত্র তিনি দেখেছিলেন, তা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির জন্য সংকটজনক ছিল। দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ শিক্ষাঙ্গনের অগ্রগতির পথে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি এর বিরোধিতা করে গেছেন।

স্মৃতিকথায় পূর্ববঙ্গের বাস্তুহারা শীর্ষক পরিশিষ্টে ভারতভাগের বিশেষ করে বাংলা ভাগের মর্মান্তিক পরিণতি এবং পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে তাঁর সুগভীর বিশ্লেষণ মনকে নাড়া দেয়। দুই বাংলায় সঠিকহারে জমি ও জনসংখ্যা বিনিময়ের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। যদিও সরকার এ বিষয়ে তাঁর কোনো সদুপদেশ গ্রাহ্য করেনি। স্মৃতিকথা থেকে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্য ভাষণের এক টুকরো উল্লেখ করা যাক; “যে কারণে তারা তখন (১৯৪৭) হিন্দুদের দূর করে দিতে ব্যস্ত ছিল সে কারণ আজও বর্তমান আছে এবং বহুদিন পর্যন্ত থাকবে। সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত স্বার্থ। অর্থাৎ হিন্দুদের তাড়াতে পারলেই তাদের বাড়িঘর জমিজমা নগদ টাকা পয়সা সব অনায়াসে দখল করা যাবে, চাকরি বাকরি সম্বন্ধে মুসলমানদের সুবিধা ইত্যাদি। যে সব বাড়িঘর জমিজমা মুসলমানেরা দখল করেছে আজ মুজিবর রহমানের নির্দেশে তারা তা স্বেচ্ছায় বা সহজে ছেড়ে দেবে -এ আশা করা যায় না। কারণ মনুষ্যত্বের দাবিতে নিজের স্বার্থের দাবি বলি দেবে এরুপে মানুষের সংখ্যা সব দেশে সব সম্প্রদায়েই খুব কম। আইন করে শতকরা নব্বই জনের স্বার্থের হানিকর কোন ব্যবস্থা চালু করাও সম্ভব নয়। সুতরাং পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থাকবে।” (জীবনের স্মৃতিদীপে : পৃ.১৯০)

জীবনের স্মৃতিদীপে পাঠ করে অনেকেরই হয়তো অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারকে সংকীর্ণ ও রক্ষণশীল মনে হতে পারে। সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানে তাঁর মতামত হয়তো সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাঁর এসব যুক্তিপূর্ণ চিন্তা আমাদেরকে ইতিহাসের নানান দিক নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে। তাঁর লেখায় জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীলতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যে তাঁকে গোঁড়া প্রাচীনপন্থী বলে মনে হতে পারে। তবুও তিনি সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক। তাঁর কাজে তিনি সত্যের অপলাপ কখনোই হতে দেননি। যদিও তাঁর ঐতিহাসিক সত্যের ব্যাখ্যা সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। Organizer ও পাঞ্চজন্যে নিয়মিত লিখতেন তিনি। একবার পাঞ্চজন্যে প্রকাশিত একটি লেখায় -তাজমহলকে হিন্দুমন্দির বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তা পড়ে অধ্যাপক মজুমদার এর সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং প্রতিবাদ স্বরূপ তাতে লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইতিহাসের তথ্যগত সত্যের প্রতি তাঁর এমনই অবিচল নিষ্ঠা ছিল। ১৯৮০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ৯১ বছর বয়সে কলকাতার নিজ বাসভবনে তিনি প্রয়াত হন।

আজ জন্মদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

সূত্রনির্দেশ:

  • জীবনের স্মৃতিদীপে – রমেশচন্দ্র মজুমদার,
  • ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার : জীবন ও কর্ম – মিলটন কুমার দেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.