“…বাড়ছে বয়স বাড়ছে স্মৃতির পুঁজি/ছেলেবেলা আমি এখনও তোমায় খুঁজি/ খুঁজে যাই তবু বুঝি না খোঁজার মানে/ খুঁজেছ তুমিও দার্জিলিং এর গানে…”
দার্জিলিং মানেই কুয়াশার ওপার থেকে ছুটির হুইসল – নস্টালজিয়া; অনেকটা, অঞ্জন(অবশ্যই ‘দত্ত’)-কে উদ্দেশ্য করে কবীর সুমনের এই গান(উপরে উল্লিখিত)টির মতো। এই নস্টালজিক শীতের শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর ইতিহাস, যার মধ্যে অন্যতম বাংলার ‘মিনি’ তিব্বতের ইতিহাস। দার্জিলিং গিয়েছেন অথচ ‘মিনি’ তিব্বত দেখেননি, এরকম সচরাচর ঘটে না। যাঁরা বিষয়টির সঙ্গে এখনও পরিচিত নন, তাঁদের জন্য পরিষ্কার করে বলে নেওয়া দরকার যে, বাংলার ‘মিনি’ তিব্বত হল দার্জিলিং-এর তিব্বতি শরণার্থী স্ব-সহায়তা কেন্দ্র(Tibetan Refugee Self-Help Centre), যাকে অনেকেই সহজভাবে ‘তিব্বতি কার্পেট সেন্টার’ বলে থাকেন এবং তুলনামূলকভাবে পর্যটকরা এই নামটিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।
১৯৫৯ সালে, ১০ জন বিশিষ্ট সদস্যের কমিটির দ্বারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এই তিব্বতি শরণার্থী কেন্দ্রটি। বহুচর্চিত লাসা-অভ্যুত্থানের পর, সেসময় চিনের বর্বরতা থেকে বাঁচতে বহু তিব্বতি পালিয়ে আসেন এখানে, আর তাঁদেরকে আশ্রয় দিতেই এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল। দলাই লামার নেতৃত্বে ধর্মশালা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দার্জিলিং ও তার আশেপাশে বেশ কিছু শরণার্থী বসতি স্থাপন করে। শরণার্থীদের দুর্দশা আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপরও সম্পূর্ণ অন্য একটি পরিবেশে নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করতে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁদের। আর টিকে থাকার এই লড়াইয়ে নতুন পরিবেশের সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল তিব্বতি শরণার্থী স্ব-সহায়তা কেন্দ্রটি; শুধু হস্তশিল্প নয়, তাঁদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্যকে নতুন পরিবেশে প্রতিস্থাপিত করে নিজেদের মতো করে ছোটখাটো একটা তিব্বত বানিয়ে নেয় শরণার্থীরা। শরণার্থী কেন্দ্রের পরিচালক ডরজি সেটেন-এর কথায়, “তিব্বতে আমাদের যা ছিল, তার অধিকাংশই কমিউনিস্টরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।”
বর্তমানে, শরণার্থী কেন্দ্রটি গালিচা, কাঠের খোদাইকৃত দ্রব্য, ধাতব কারু দ্রব্যের পাশাপাশি তিব্বতি উল, চামড়ার পোশাক এবং আনুষাঙ্গিক ঐতিহ্যবাহী তিব্বতিয় সামগ্রী তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। শরনার্থী কেন্দ্র প্রাঙ্গণের একটি শোরুম থেকে আমাদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া যায়, এ ছাড়া প্রায় চল্লিশটি দেশে রপ্তানি করা হয়, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ রয়েছে।” বলেছেন সেটেন।
আজও, ঐতিহ্যবাহী নকশার নমুনাগুলি তিব্বত থেকে আসে, যার ভিত্তিতে শরণার্থী কেন্দ্রের কারিগররা সুন্দর এবং জটিল কারুকাজের পণ্যগুলি তৈরি করে থাকেন। বুনন কেন্দ্রটি রয়েছে প্রথম তলায় এবং তার নীচে রয়েছে স্পিনিং ইউনিট। উল ধোয়া, গোছানো, শুকনো করা, কাটা এবং সুতো বেঁধে বল তৈরি করা –এসবেই শরণার্থী কেন্দ্রে সারাদিন কাজের সময়টা বেশ ব্যস্ততায় কাটে।
এখনও পর্যন্ত, শরনার্থী কেন্দ্রে এই সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ লোক বসবাস করছেন। দার্জিলিংয়ে তিব্বতিদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩,০০০। কেন্দ্রের পুরনো কারিগরদের বয়স ৬৫ থেকে ৭০-এর কোটায় এবং বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেলেও কিছু না কিছু হালকা কাজ করে থাকেন তাঁরা। “কেউ বৃদ্ধ হলে আমরা তাঁকে বেকার হতে দিই না, কারণ এটা একটা মানসিক ধাক্কা” সেটেন। সেটেন আরও বলেন, “আমরা তাঁদের দিয়ে উল বাছাই এবং সুতোর বল তৈরি করার মতো হালকা কাজ করাই, যাতে খুব বেশি পরিশ্রম না হয়। এইভাবে আজীবন সক্রিয় থাকেন তাঁরা।”
শরণার্থী কেন্দ্র গড় মাসিক উত্পাদন করে থাকে প্রায় ২৬ বর্গফুট কার্পেট এবং ৮-১০ কেজি সুতো। “আমাদের সমস্ত পণ্যই হাতে বানানো এবং হাতে বোনা কার্পেটগুলি তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়। একজন শিল্পী প্রতিদিন প্রায় ৬-৭ ইঞ্চি কার্পেট বুনে থাকেন।” সেটেন।
এই হস্তশিল্পগুলিই শরণার্থী কেন্দ্রের একমাত্র আয়ের উত্স হিসাবে রয়ে গিয়েছে এবং এর যাবতীয় মুনাফা তিব্বতি সম্প্রদায়ের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য, বোর্ডিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। রাজ্য সরকারের তরফে বিদ্যুৎ ও জলে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, শরণার্থী কেন্দ্রে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা, যেটির সংস্কারের আবেদন এখনও বিচারাধীন রয়েছে। শরণার্থী কেন্দ্র ট্যাক্স দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের দেওয়া অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেয়।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ কথা বলাই যায়, যে স্বপ্ন নিয়ে শরণার্থী কেন্দ্রটি স্ব-সহায়তার পরিকল্পনাটি শুরু করেছিল, তা বাস্তবায়িত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠার ছ’দশক পরেও তিব্বতি শরণার্থী স্ব-সহায়তা কেন্দ্র তাঁদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের শিখাকে অবিচ্ছিন্নভাবে জ্বলিয়ে রেখেছে।
©ইন্দ্রজিৎ সেন