”মাছে ভাতে বাঙালি’ কোনও ইউনিভার্সাল স্টেটমেন্ট নয় । এটাকে যারা ইউনিভার্সাল করতে চেয়েছিল তারা কেউ আদতে কৃষ্ণানন্দআগমবাগীশ অথবা শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু -কারোরই ধার ধারে না ।
প্রকৃতপক্ষে বাঙালি গৃহস্থের ঘরে যেটা ছিল সেটা হল সর্বধর্মসম্ভাব। বুড়োবুড়িরা একাদশীর পারায়ন করলেও যুবরা দশমীর বাসী মাংস সাঁটায়। এটাই বাংলার সংস্কৃতি ।
খুব বেশি পুরানো কথা নয় যখন বালি বা উত্তরপাড়ার গঙ্গাতেও ইলিশ উঠত তখনও ইলিশ ছিল একটা সিজনাল ডেলিকেসি। সেটাকেও ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেলার পিছনে পদ্মাসেতুঅভিমুখী মিডিয়া হাউসের বড়ো সড়ো অবদান ছিল। অন্যথায় আশির দশক পর্যন্তও ইলিশ মাছ আর দেশি মুরগীর ক্রয়মূল্যও প্রায় সমান ছিল।
ইলিশ পরবর্তী স্টেপ হল হালালমাংস এবং তারও পরে বীফ। আপনারা খেয়াল করলেই দেখবেন আপনাদের এলাকার এককালের প্রসিদ্ধ বুধন বাগদী বা শরৎরুইদাসদের খাসীর মাংসের দোকানগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ।তার পরিবর্তে মাশরুমিং হয়েছে রেওয়াজি খাসী আর হাজি বিরিয়ানীর দোকানের । বাঙালির খাদ্যভ্যাস বদলেছে । যে বাড়িতে রম্যমোরগ ঢুকতো না সে বাড়িতেও আজ চিকেন চাঁপ সহ শিরাজ বা আর্সালানের বিরিয়ানী ঢোকা শুরু হয়ে গিয়েছে । এগুলো কেবল খাদ্যাভ্যাসের বদল নয় বাঙালির সংস্কৃতিকেই বদলে দেওয়ার নীলনকশা । কারণ আর্সালান , শিরাজ বা আমিনিয়ার সাফল্যটা কেবলমাত্র ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, সাফল্য হালাল নামক এক মধ্যপ্রাচ্যীয় নীতিকে বঙ্গীকরণ করে ফেলাতেও।
সেই সাফল্যের জোরেই একটা গোষ্ঠী ধর্মতলার মোড়ে বীফ খাওয়াটাকে এক বিরাট সার্বজনীন অধিকার বলে ঠাউরে থাকে । তারাই বিভিন্ন মানদণ্ডে বাঙালিকে বিচ্ছিন্নকরার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে । কখনও ভাষা ,কখনও সংস্কৃতি ,কখনও রবীন্দ্রনাথ ,কখনও নেতাজীকে সামনে রেখে বাংলাকে ভারতের থেকে আলাদা কিছু একটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে । তারা নিজেরাই এখনও বাংলাকেই ঠিকঠাক চেনে নি । পন্ডা , শতপথী , মহাপাত্র ইত্যাদি যে বাঙালিও হতে পারে , সবসময় যে ওড়িয়া নাও হতে পারে সেটাও তারা জানে না ।
আর মাছ যে সমস্ত বাঙালির স্টেপল ফুড নয় সেটাও তারা জানে না ।
অতএব যদি কেউ বাঙালি মানেই মৎস্যাহারী ধরে নেন তাহলে বুঝতে হবে তার জ্ঞান বুদ্ধি সীমিত । আর যারা এই মওকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বং সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তুলতে চায় তারা হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষতিকারক শ্রেণী । কারণ বাঙালী হয়েও বাংলাকে তারা একটাই আইডেন্টিটি হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে । মনে রাখতে হবে যে গতিতে হাজি বিরিয়ানী ব্যপ্তিলাভ করেছে তার চেয়ে বেশি গতিতে এই সময়কালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম বিস্তারিত হয়ে গিয়েছে। যা এককালে ছিল কতিপয় পাঠবাড়ির চৌহদ্দীতে আটক আজ তা আন্তর্জাতিক লেভেলে বিস্তারিত। সব বাঙালির যে মাছ নিয়ে সেন্টিমেন্ট থাকবেই – তার কোন মানে নেই !
✍️অভিজিৎ গোলুই