শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে খাবারের মেলবন্ধন করার ক্ষেত্রে এদেশ অনেক এগিয়ে ছিল। পিত্তের প্রকোপ বাড়লে পিত্ত-নাশক তেতো রসবিশিষ্ট শুক্তো, তিথি বিশেষে চন্দ্র সূর্যের আকর্ষন-জনিত পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থের জলীয় অংশ বৃদ্ধি হয়, এজন্য যে যে খাদ্যদ্রব্য খেলে শরীরে রসের আধিক্য হয়, তিথি বিশেষে সেসব ভোজন নিষেধ করে আর্য ঋষিগণ খাদ্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞানের চরম পরিচয় দিয়ে গেছেন। কিন্তু, বাঙালি আর কবে বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করেছে! বাঙালিদের মধ্যে যেমন চব্য, চুষ্য, লেহ্য, পেয় প্রভৃতি নানাবিধ উপাদেয় খাবার ব্যবহারের প্রথা দেখা যায়, পৃথিবীর মধ্যে আর কোনও জাতির তেমনটা দেখা যায় না। একুশ শতকে যেমন লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়, সে কালে তেমন আকস্মিক ভাবে প্রাণ কেড়ে নিত ওলাওঠা, কালাজ্বর, সান্নিপাতিক, যক্ষ্মা, হাম, বসন্ত। চিকিৎসাশাস্ত্রে তখন সব রোগের জন্য জুতসই অস্ত্র ছিল না। ইনফ্লুয়েঞ্জাও দিন দুয়েকেই যমালয়ে পৌঁছে দিত। ভরসা ছিল শিঙি-মাগুর, কাঁচকলা-পেঁপের ট্যালট্যালে অথচ রুচিবর্দ্ধক ঝোল, আমিষ/নিরামিষ স্টু বাটি বাটি সাবু-বার্লি। এই সব উপকারী পথ্য পেটরোগা, সর্দিজ্বরে রুগ্ণ বাঙালি যুগে যুগে আরোগ্য-পথ খুঁজে পেয়েছে।

ইউরোপীয় চিকিৎসা ও পথ্য পদ্ধতি এ দেশে কাজে দিত না। যেমন, এই পদ্ধতিতে আমাশয় রোগীর গায়ের জোর বাড়ানো হয়। তাই রোগীকে পোলাও, কালিয়া, মুরগির কাবাব, চিকেন ব্রথ, পাকা ফল দেওয়া হত। সঙ্গে ওষুধ ও ব্র্যান্ডি। যদি কোনও মতে রোগী রাতটা পেরোত, তবে সকালে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানো হত। ক্যাপ্টেন আলেকজ়ান্ডার হ্যামিলটন জানিয়েছেন, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ১২০০ ইংরেজ ছিল। কিন্তু পরের জানুয়ারির মধ্যে অন্তত ৪৬০ জনের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। সতর্কবাণী প্রচারিত হয়েছিল, গরমের মধ্যে প্রচুর মদ্য-মাংস খাবেন না।

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক-প্রণালি’তে আছে, জনৈক এক ইংরেজ একবার নাকি বলেছিলেন, “হিন্দু ও ইংরাজজাতির ভোজন স্থান দর্শন করিলে ইংলণ্ডবাসীদিগের ভোজনস্থল মহাশ্মশান বলিয়া বোধ হয়।” ইউরোপিয়ানরা যদি আচরণে, খাদ্য, পানীয়, পথ্য প্রকরণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উপযোগী জীবনযাত্রা মানতেন, তবে হয়তো এত প্রাণহানি হত না। বেশির ভাগ রোগেরই টিকা ছিল না। সময়মতো ডাক্তার-ওষুধের বালাই ছিল না। তাই বঙ্গসন্তানরা স্বাস্থ্যকর খাবার আর পথ্য খেয়ে এ সব বিপদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। চিঁড়ের মণ্ড, লেবু-ছানা, মুড়ি-বাতাসা, ডাবের জলেই থাকত প্রতিরোধের বর্ম। এ সব পথ্যে যে আরোগ্য-পথ নিশ্চিত, তা নয়। কিন্তু রোগের বাড়াবাড়িটা কিছুটা হলেও ঠেকানো যেত। ঠিক্টহাক হজম আর রুচি ফেরানো, পথ্যের সারকথা এই।

জ্বরে হজমশক্তি ফেরাতো জল বার্লি বা দুধ বার্লি। সেকালের সিনেমা-সাহিত্যে বারবার খুঁজে পাওয়া যায় বার্লির প্রসঙ্গ। তখন ধারণা ছিল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেলে দ্রুত কাজ হয়।

শরীর গরম হলে বাঙালি ভরসা ছিল ঝরঝরে সাদা ভাতে। শ্রমজীবী মানুষের কাছে আবার ভাতের কদর আলাদা। পেঁয়াজ, লঙ্কা বা শুধু নুন দিয়ে সে ভাত খেয়ে রোদ-জলের সঙ্গে যুঝবার শক্তি খোঁজে। যে কোনও অসুখে ধনী-গরিব সকলেরই গতি সহজপাচ্য গলা ভাত। ভাত যত ফোটানো হয়, তার উপাদান, গ্লুকোজ় চেন ভেঙে ছোট হয়ে যায়। তাই সহজপাচ্য হয়। আবার, বাঙালির ‘ঐতিহ্যবাহী’ ডিসপেপসিয়া, উদরাময়, পেট ফাঁপার পথ্য হিসেবে, শরীরের জলের ভারসাম্য রাখতে নুন চিনির জল, ডাবের শরবত। অবস্থার উন্নতি হলে ভাত, আলু সিদ্ধ, টক দই। খই বা চিঁড়ের মণ্ড মাখা যেন অমৃত। রোগের প্রকোপ কমলে দেহে বল ফেরাতে লাগত প্রোটিন। এক্ষেত্রে চলত মসুর ডালের জল, মৌরলা-শিঙি-মাগুরের মাছের পাতলা ঝোল। কলেরা-আন্ত্রিকের ভরসা গোলমরিচের সঙ্গে কাঁজি (পান্তাভাতের টোকো জল)।

অজীর্ণ অম্বলের জন্য মহিলারা হেঁশেলে মজুত রাখতেন বয়াম ভরে বেলের মোরব্বা, জারকলেবুর আচার। হুপিং কাশির জন্য ছিল আদা-লেবু বাটার উপাদেয় মিশ্রণ। আমাশয় আর বায়ুবৃদ্ধি রোগে দুপুরে ভাতের পাতে উপাদেয় ছিল ডুমুর দিয়ে কাঁচকলার ঝোল। ডায়েরিয়া সামলাতো কাঁচকলা আর ভাতে ভাত পথ্য।

জ্বরে হজমশক্তি ফেরাতো জল বার্লি বা দুধ বার্লি। সেকালের সিনেমা-সাহিত্যে বারবার খুঁজে পাওয়া যায় বার্লির প্রসঙ্গ। তখন ধারণা ছিল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেলে দ্রুত কাজ হয়। বার্লি খাঁটি স্টার্চ। মাছ-মাংস মূলত পাকস্থলীতে পরিপাক হয়। স্টমাক যদি ভারী খাবারে বোঝাই থাকে, তবে তার দরজা খুলবে না। ওষুধ-সিরাপ খেলেও কষ্ট বাড়বে। তাই পাকস্থলীর বদলে পরের ধাপে, অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়, এমন খাবারের চল ছিল। আলু, পেঁপে, গাজর, গোটা পেঁয়াজ দিয়ে সুস্বাদু মুরগির লেগ-জুস, আনাজের উপাদেয় সুপ, ডিম স্টু থাকত। মধুমেহ, কিডনির রোগে আলু, বিশেষ আনাজ বা দানাদার ফল বাদ দিয়ে পথ্য তৈরি হত। খেজুরের রস, আমলকী বা জলপাই ভাতে, পোস্ত বাটা, ক্ষারণি (এক রকম হজমি) ভাত, ছানার নাড়ু খাওয়ানো হত। স্বাদ ফেরাতে ওল বা কচুর ভর্তা দেওয়াও হত। এতে নাকি প্লীহা আর কফ সারে। মুখশুদ্ধি থাকত আমআদা বাটা, খল-হামানদিস্তায় গুঁড়ো করা লবঙ্গ-দারচিনির মিক্সচার। কৃমিরোগে নরম দানার পটোল পোড়া খাওয়ানো হত। স্নায়ুদৌর্বল্য, যকৃতের অসুখ, পিত্তরোগের জন্য যত্ন করে মাখা হত মিষ্টি মিষ্টি পেঁয়াজ পোড়া।

দুঃখের বিষয় এইসব পথ্যগুলি ক্রমাগত রান্নাঘর থেকে বাদ দিয়েছে বাঙালি। আজ এইসব পথ্য আমাদের কাছে ‘নস্ট্যালজিয়া’ ছাড়া কিছু নয়। অথচ, যা দিনকাল পড়েছে শুধু রোগভোগের সময় নয়, নিয়মিত ডায়েট-তালিকায় ‘পথ্য’ রাখতে পারলে ভালো। তাতে রোগের প্রকোপ কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকের আচার ব্যবহার, রুচির পরিবর্তন হয়। একথা মাথায় রাখতে হবে রুচি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসছে অনেক কিছুতেই। খাদ্য উপাদানের গুণমান, মূল্যবৃদ্ধিও এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিঙি-মাগুর মাছের দামে ছ্যাঁকা খায় সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। মুরগির মাংসের দামও আকাশছোঁয়া। কীটনাশকযুক্ত হাইব্রিড দানা শস্য, সবজি দিয়ে পথ্য বানিয়ে খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তা কি আমরা জানি না! তাহলে?উপায় অনেক আছে। আজকাল কীটনাশকমুক্ত চাষ পদ্ধতিতে দেশিয় ধান, সব্জি চাষ হচ্ছে – অরগানিক পদ্ধতিতে চাষ বেড়েছে। সময়, সম্বল, জায়গা-জমি থাকলে নিজেরাই বাড়িয়ে অল্প চাষাবাদ করতে পারেন। ছাদ-বাগানও এক্ষেত্রে উপযুক্ত। অবশ্য, যা অবস্থা আমিষ পথ্যের ক্ষেত্রে এরকম কোনও সুরাহা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সাধারণ মানুষের এক্ষেত্রে ‘ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই’ দশা। তাহলে, তাঁরা কি স্বাস্থ্যবর্ধক আহার থেকে ব্রাত্য থাকবেন? যাঁরা বাজার দর ঠিক করেন, তাঁরাই বোধহয় জানেন এর উত্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.