আরাধ্যের সাকার রূপদর্শনের ইচ্ছা হল ভক্তের৷ কারিগর বিধান দিলেন পূর্ণাঙ্গ-মূর্তি নির্মাণ পর্যন্ত ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু ভক্তের সবুর সইল না।ধৈর্যচ্যুতিতে সময়ের আগেই মালব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা খুলে ফেলায়, কথার খেলাপে সূত্রধর বিশ্বকর্মাও কাজ অসম্পূর্ণ রেখে গেলেন চলে। ঘরে তখন পড়ে আছে তাঁরই তৈরি অসম্পূর্ণ, বিস্ময়কর তিন দারুব্রহ্মমূর্তি। এদিকে খুঁতযুক্ত মূর্তির পূজাপোচারের তো নিয়ম নেই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে!সমস্যা ঘোরতর, তবে সমাধানও পাওয়া গেল সহজেই। এই অসমাপ্ত মূর্তিই বুঝি আরাধ্যের বিশেষ রূপ। অন্যদিকে, নানামতের একটি মত, এই দেবতাই আদিতে শবরদের উপাস্য ‘নীলমাধব’। ফুল, পাতা, কাঠের প্রতীকপুজোই ছিল শবরীয় রীতি। তাই সবমিলিয়ে ঠিক হল এমন অর্ধসমাপ্ত অবয়বেই পূজিত হবেন দারুভূত ত্রয়ী; জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা। তরঙ্গ ওঠে, তরঙ্গ মিলায়। মিথ আর ইতিহাসের মিশেলে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেও সনাতন ধর্মের মূলধারার সঙ্গে এসে মেলে প্রান্তিক, বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, বৈষ্ণব ও তন্ত্রের এক সমন্বয়ী রূপ। অথচ এত বিবিধেও, অটল থাকে এক বিশ্বাস-অখণ্ডে যিনি ব্যাপ্ত, রূপে নয়, বরং গুণেই তাঁর প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়।
কয়েক শতক পেরিয়ে গেল। পরিস্থিতি আর সংস্কারের এমনই এক দোলাচল আবার তৈরি হল রানি রাসমণির দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে।নন্দোৎসবের দিন দুপুরে রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পূজারী ক্ষেত্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে বেখেয়ালে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল গোবিন্দমূর্তির।পণ্ডিতসমাজ বিধান দিল দেবতার অঙ্গহানি বড়োই অশুভ। ফলে নতুন পূর্ণাঙ্গ মূর্তির আশু প্রয়োজন।রানিমা ও তাঁর সেজো জামাই মথুরানাথের শেষ ভরসা মন্দিরের পুরোহিত ছোটো ভটচায। পরবর্তীতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মূল সুতোটি বুনে দেবেন যিনি, সেই ছোটো ভটচায শ্রীরামকৃষ্ণ, তখন এক সহজ সমাধান দিলেন। পড়ে গিয়ে পা ভাঙলে রানির জামাইরা যদি ত্যাজ্য না হয়, তবে এখানে অন্যথা কেন! ভাঙা মূর্তির পা মেরামত করেই তাই পুজো হোক। কারণ মূর্তিতে নয়, দেব-আবির্ভাব ভক্তহৃদয়ে।এ যেন সেই অসারকে ছেড়ে সারগ্রহণ। আর সহজ-বিনে হয় না সহজ সাধন। তাই পরে, প্রসঙ্গক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “অখণ্ডমণ্ডলাকার যিনি, তিনি কি কখনও ভাঙা হন?”। দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক বর্জিত হৃদয়ে ভারতবর্ষের সব উপাস্যই, চিরকাল এমনই সহজ, এমনই অখণ্ড। অর্ধ-অবয়বের এক টুকরো নিমকাঠ মূর্তিও, তাই, যুগ থেকে যুগান্তরে তাঁর আকর্ণ, দীর্ঘায়ত দৃষ্টি নিয়ে ভক্ত হৃদয় থেকে শুষ্কং-কাষ্ঠং গবেষক সকলের কাছেই সহজ ও সম্পূর্ণ। বহু মত সমন্বিত এই জগন্নাথ সংস্কৃতি প্রভাব ফেলেছে ভারতের সভ্যতায়, সমাজে। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রত্যেকেই নিজের নিজের চিন্তনে, যাপন করেছেন এই ভাব। ষোড়শ শতকের শ্রীক্ষেত্র পুরীতে চৈতন্যদেবের জগন্নাথ কেন্দ্রিক দিব্যজীবন তো বহুল আলোচিত। উনবিংশ শতকের আধুনিক কলকাতায় শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের জগন্নাথ অনুষঙ্গও সেই ধারারই বুঝি নতুনতর রূপ। দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন প্রতিদিন স্নানের পর শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগন্নাথের মহাপ্রসাদ (আটকে) একটু করে খেতেন।বিশ্বাস করতেন, ‘এতে দেহ মন শুদ্ধ হয়’। কেউ পুরীধাম দর্শন করে ফিরেছেন শুনলেই ভাবে আত্মহারা হয়ে উঠতেন তিনি। অথচ জীবদ্দশায় শ্রীরামকৃষ্ণের কখনও শ্রীক্ষেত্রে যাওয়া হয়নি। তাই প্রভু জগন্নাথ তাঁর কাছে নিজে যেন হাজির হলেন, এই কলকাতার বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে।শ্রীরামকৃষ্ণ এ বাড়িতে এসেছেন প্রায় শতাধিকবার।নিজেই তিনি বলেছেন এ বাড়ি তাঁর ‘কেল্লা’।ভক্ত বৈষ্ণব রাধামোহন বসুর সন্তান বলরাম অজীর্ণ রোগে ভুগতেন। স্বাস্থ্য উদ্ধারে বহুবছর তাই পুরীতে ছিলেন তিনি। এই সময়ই তাঁর জগন্নাথপ্রীতি পোক্ত হয়। তারপর নিজের বড়ো মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে বলরাম এগারো বছর পর কয়েক সপ্তাহের জন্য কলকাতায় আসেন। এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর ভাই হরিবল্লভ। সাধুসঙ্গ বর্জন করে সংসারে দাদার মন টেকানোর জন্য কলকাতার রামকান্ত বসু স্ট্রিটের ৫৭নং বাড়িটি কিনে দাদা বলরামকে ওই বাড়িতে বসবাসের অনুরোধ করেন তিনি। শ্রীশ্রীজগন্নাথের নিত্যদর্শন থেকে বঞ্চিত বলরামবাবু এ প্রস্তাবে বাধ্যত রাজি হলেও ঠিক করে ফেলেন, সুযোগ বুঝে ফিরে যাবেন নীলাচলে। কিন্তু সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গলাভের পর তাঁর সহজ-সরল সাধকজীবনের দুর্ণিবার আকর্ষণে সেই সংকল্প ত্যাগ করে কলকাতাতেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন বলরাম বসু। ধীরে ধীরে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন তাঁর এই গৃহীভক্ত বলরাম।পরমহংসদেব বলতেন ‘বলরামের শুদ্ধ অন্ন’।পরবর্তীতে এই বলরাম ভবনই হয়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশনের আঁতুড়ঘর। এই বাড়ির নিত্যপূজিত জগন্নাথদেবের রথযাত্রাতেই পরপর দুই বছর উপস্থিত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
প্রতিবছরই বাহ্যিক আড়ম্বর বর্জিত আন্তরিক রথযাত্রার আয়োজন করতেন বসু পরিবার।কথামৃতের দিনলিপি অনুযায়ী ১৮৮৪ সালের ৩ জুলাই উল্টোরথে এবং ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই রথযাত্রার দিন এই বলরাম ভবনেই শ্রীরামকৃষ্ণ রথ টেনেছিলেন। ফুল মালায় সাজানো বিগ্রহকে ছোটো এক রথে বসিয়ে চকমিলানো বাড়ির বারান্দায় রথ টানার সেসব দিনে আনন্দের হাট বসেছিল যেন। মধুর কণ্ঠে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন গেয়েছিলেন, ‘নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে’, ‘যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা দু’ভাই এসেছে রে’, স্বল্প পরিসরের সেই বাড়িই তখন তাঁর কাছে হয়ে ওঠে নীলাচল। ভোগরাগ, নামসংকীর্তনে মুখরিত বসুভবনের এই পরিবেশ দেখে কথামৃতকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের মনে হয়েছিল… যেন শ্রীবাস মন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তসঙ্গে হরিপ্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছে।”
জগতের নাথকে কেমন করে প্রণাম করতে হয়, কথামৃতকার মাস্টারমশাইকে তাও শেখাচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মেঝেতে খুচরো পয়সা ছড়িয়ে মন্দিরের পাণ্ডাদের ব্যস্ত করে দিয়ে এক দৌড়ে মাষ্টারমশাই আলিঙ্গন করেছিলেন পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহ। দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসতেই সেই মাষ্টারমশাইকেই আলিঙ্গন করে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ‘এই আমারও জগন্নাথকে আলিঙ্গন করা হল’। শত কোলাহলেও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আরেক নাম চৈতন্য। সেই চৈতন্যস্বরূপ জগন্নাথকে বুঝি এভাবেই অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন করে সকল অঙ্গ ভরেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মাঝেমধ্যেই তিনি গেয়ে উঠতেন ‘উড়িষ্যা জগন্নাথ ভজ বিরাজ জী!’ শিবজ্ঞানে সমস্ত চেতনকে সেবাপূজার যে পাঠ জীবনভর শেখাবেন শ্রীরামকৃষ্ণ, রথের রশি টেনে সেই সত্যের যেন অন্য এক রূপশিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। জগন্নাথ তো জগৎছাড়া নন, তাই বস্তুত জগতের সেবাই জগন্নাথের সেবা। শরীর-রূপী রথে চিরজাগ্রত চৈতন্য ও বুদ্ধিকে সারথী করে আমাদের যে মনোরথ সতত চলনশীল, সেই বোধেই বুঝি রথের রশি ছুঁয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রকৃত ভালোবাসায় আর ভক্তিতে জাতপাতের রঙ ধরে না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্পর্শ পেতে তাই যে দেবতা পথে নামেন, সেই বিরল দেবভাবনায় বিহ্বল শ্রীরামকৃষ্ণের অপূর্ব জগন্নাথপ্রেম, আজও যেন সচল রূপ ধারণ করে বলরাম ভবনের রথযাত্রায়।নিজেতে মত্ত তথাকথিত এই আধুনিক সমাজ আজও রথের রশি ছুঁয়ে যেখানে পায় আলোর পাঠ। যে আলোতে নয়নপথে উদ্ভাসিত হয় চৈতন্য, সত্তায় উদ্ভাসিত হন জগন্নাথ।
তথ্যঋণঃ
১. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (অখণ্ড); শ্রীম-কথিত
২.শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড); স্বামী সারদানন্দ
৩. প্রভু জগন্নাথ; সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৪. ভারতীয় সংস্কৃতির মূর্তপ্রতীক শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব; ড.বিষ্ণুপদ পাণ্ডা