মসজিদ ভেঙেছিল মানুষের রোষ, অভিযুক্তরা উন্মত্তদের থামাতে গিয়েও ব্যর্থ হন। বাবরি মামলায় রায় দিতে গিয়ে এমনটাই জানাল সিবিআই বিশেষ আদালত। পাশাপাশি মসজিদ ভাঙার ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ষড়যন্ত্র ছিল এমনটাও সিবিআইয়ের দেওয়া তথ্যপ্রমাণ থেকে প্রমাণ হয় না।
বাবরি ধ্বংসের আঠাশ বছর পর এই রায়ের ফলে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলেন আডাবানি, যোশী, উমা ভারতীরা। বিশেষ সিবিআই আদালত আজ জানিয়েছে-
-বাবরি মসজিদ ধ্বংস পরিকল্পনা করে হয়নি।
-অভিযুক্ত ৩২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্বপক্ষে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
-ফোটো ও অডিয়োর সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি সিবিআই।
-যারা মসজিদের গম্বুজের ওপরে উঠেছিল তারা দুষ্কৃতী।
ঘটনার সময়য় নেতাদের দেওয়া বক্তব্যের অডিয়ো স্পষ্ট নয়।
কী অভিযোগ ছিল আডবানিদের বিরুদ্ধে
বাববি মামলায় ৩২ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং করসেবকদের উস্কানি দিয়েছিলেন।
অভিযোগ ছিল, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি ভাঙার সময়ে মসজিদ চত্বরে তৈরি মঞ্চে ছিলেন আডবানি, যোশী, উমা ভারতীরা। তদন্ত জানানো হয় মঞ্চ থেকে করসেবকদের উত্তেজিত করেছিলেন বিজেপি নেতারা।
ঘটনায় সময় উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ছিল কল্যাণ সিং সরকার। বাবরি ধ্বংসের পর কল্যাণ সিং সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। বাবরি ধ্বংসের পর দেশজুড়ে হওয়া হিংসায় ৩০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।
গত ২৪ জুলাই ভিডিয়ো কন্ফারেন্সের মাধ্যেম নিজের বয়ান রেকর্ড করেন আডবানি। সেখানে তাঁর ১০০ প্রশ্ন করেন সিবিআই বিচারক। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আডবানি। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সশরীরে হাজিরার পরিবর্তে ভিডিয়ো কন্ফারেন্স আদালতের কাজে যোগ দেন তিনি।

১৯৯২ সালে করসেবকদের হাতে বাবরি ধ্ংসের পর প্রথমিকভাবে ২টি মামলা হয়। পরে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৯। প্রাথমিক দুটি মামলার দ্বিতীয়টিতে আডবানি, যোশী ও উমা ভারতীয় নাম করা হয়। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন বিষ্ণুহরি ডালমিয়া, অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ সিং,স্বাধ্বী ঋতম্ভরা, বিনয় কাটিযার।
১৯৯৩ সালে বাবরি ধ্বংসের প্রথম চার্চশিট দেয় সিবিআই। সেই চার্জশিটে অভিযুক্তের তালিকায় নাম ছিল ৪৮ জনের। তালিকায় ছিল বাল ঠাকরে, কল্যাণ সিংয়ের নামও। অভিযুক্তদের মধ্যে ইতিমধ্যেই ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতকে নির্দেশ দেয় নিয়মিত শুনানি করে মামলার নিস্পত্তি করতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক এটাই যে সনাতন ভারতীয় হিন্দুর বংশোদ্ভূত হয়েও রামের মাহাত্ম নিয়ে চর্চা করতে দ্বিধাবোধ করি ও নিজেদের পিছিয়ে পড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শরীক বলে ভাবি ! অথচ শ্রী রাম চরিত্র বা জীবনী শুধু যে ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বা বাহক নয়, আপামর বিশ্বে মানবতার স্বার্থে, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে তার প্রভাব অনস্বীকার্য যার সীমারেখা উত্তরে অযোধ্যা থেকে সোনার লঙ্কা বা শ্রীলঙ্কার মধ্যে টানলে হয়তো ভূল হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই লেখাটা তুলে ধরার প্রয়াস করছি সকলের মতামতের জন্য।
বৈদিক যুগে আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে ত্রেতা যুগে বাল্মীকি মুনি রচিত রামের ঐতিহাসিক অস্তিত্ত্ব নিয়ে যে গবেষণা চলছে সেটা চলুক। তবে আবহমানকাল ধরে সেই অযোধ্যা, বয়ে চলা সরয়ূ নদী, চিত্রকূট, দন্ডকারন্য, রামসেতুর ভৌগলিক অবস্থান ও অস্তিত্ত্ব, সেই সোনার দ্বীপ লঙ্কা আজও স্থানমাহাত্বে অপরিবর্তিত হয়ে রয়েছে। কোনো মহম্মদ, খিলজি, তুঘলক বা আরংজেব তার নাম পরিবর্তনে সফল হন নি। মহমেডান প্রভাবে বাবর যে রামমন্দির ধ্বংশ করেই সেই ভিতএর উপরেই মসজিদ গড়ে রাম মাহাত্বকে খর্ব করার অপপ্রয়াস করেছিলেন সেটা এখন পুরাতাত্ত্বিক খননে প্রতীয়মান হয়েছে যার পুরোধা ছিলেন বিশেষজ্ঞ কে কে মহম্মদ যিনি এই নিরীক্ষনে বহূসংখ্যক মুসলমান লেবার নিযুক্ত করেন ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে। খননে যে মন্দিরের কমপক্ষে চৌদ্দটি থাম পাওয়া গিয়েছে শুধুু তাই নয়, রাবন বধের কাহিনীর ফলকের পূনরুদ্ধার করা গিয়েছে। মন্দিরের মকরমূখী পয়ঃপ্রনালীর অবস্থান বাবরি মসজিদের মধ্যে নজর করা গিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ অযোধ্যার বাবরি মসজিদের নীচে খননকার্য চালানোর সময় এক প্রাচীন শিলালিপি উদ্ধার করে। বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সেই শিলালিপির নাম বিষ্ণুহরি শিলালিপি। কার্বন টেস্ট সহ আরও নানাবিধ পরীক্ষা চালিয়ে ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদরা বুঝতে পারেন শিলালিপিটি 1154 থেকে 1193 সালের মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বিষ্ণুহরি শিলালিপির বর্ণনা অনুসারে পূর্বে বাবরি মসজিদের স্থানে এক বিশাল আর সুরম্য রাম মন্দির ছিল। কনৌজের তৎকালীন রাজা গোবিন্দ্রচন্দ্র গাহারওয়ালের নির্দেশে তাঁর সামন্তরাজ তথা সেনাপতি অনায়াচন্দ্র সেই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। শিলালিপিতে সামন্তরাজ অনয়াচন্দ্র আর কনৌজের গাহারওয়াল রাজাদের রাজবংশের তালিকা দেওয়া রয়েছে। সেই তালিকা অনুসারে রাজা গোবিন্দ্রচন্দ্রের পরে কনৌজের রাজা হয়েছিলেন বিজয়চন্দ্র। বিজয়চন্দ্রের পর কনৌজের রাজসিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন রাজা জয়চন্দ্র। তারপর আর কোন রাজার নামের তালিকা নেই।
এমনিতে গাহারওয়াল রাজবংশের তালিকা অনুসারে রাজা জয়চন্দ্র ওরফে জয়চাঁদ সমগ্র উত্তরপ্রদেশের অন্তিম শক্তিশালী ভারতীয় শাসক ছিলেন। ১১৯৪ সালে চান্দেরওয়ারের যুদ্ধে তুর্কি সর্দার মইজুদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি পরাজিত আর নিহত হবার সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশের প্রায় সিংহভাগ অঞ্চল তুর্কিদের অধীনস্ত হয়ে পড়ে। ১১৯৭ সালের মির্জাপুর শিলালিপির বর্ণনা অনুসারে চান্দেরওয়ারের যুদ্ধে রাজা জয়চন্দ্রের বিজয় তখন প্রায় সুনিশ্চিত। রাজার পরাক্রম আর শৌর্যের সম্মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ম্লেচ্ছ তুরস্ক বাহিনী। ঠিক এহেন সময় দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এক যবন তিরন্দাজের নিক্ষিপ্ত শর এসে বিদ্ধ হলো রাজার চোখে। আহত রাজার পতন হলো তাঁর হস্তীপৃষ্ঠ থেকে। পতনের সাথে সাথে হাতির পদতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হলো রাজার। রাজা জয়চন্দ্রের মৃত্যু দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত কনৌজ বাহিনী মুহূর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। আসন্ন বিজয় পরিণত হলো করুন পরাজয়ে। যবন সেনাধক্ক্য কুতুবউদ্দিনের নির্দেশে এক তুর্কি সিপাহী এসে মৃত রাজার মস্তক ছেদ করে সেটি তার বর্শার ফলায় গেঁথে নিয়ে গিয়ে সমর্পণ করলেন ঘোরীর পদতলে। তুর্কি দস্যুদের দ্বারা তছনছ হলো কনৌজের আসনি কেল্লা আর মন্দির নগরী কাশী।
এরপর রাজা হরিশচন্দ্রের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা মির্জাপুর শিলালিপিতে লেখা নেই। কিন্তু ১৯৩৭ সালে মধ্যপ্রদেশের নাগরের (রাজস্থানের নাগর নয়) রাজা অদক্ষমাল্লার দ্বারা স্থাপিত এক শিলালিপির বর্ণনা অনুসারে জয়চন্দ্র পুত্র রাজা হরিশচন্দ্র গাহারওয়াল নতুন রাজা হয়ে কুতুবউদ্দিন আইবকের তুর্কি বাহিনীর নাগপাশ থেকে সাময়িকভাবে কনৌজ আর কাশীকে মুক্ত করলেও পরে ইলতুতমিশ ওরফে আলতামাস দিল্লির নতুন সুলতান হয়ে পুনরায় ১২১৯ থেকে ১২২০ র মধ্যে রাজা হরিশ্চন্দ্রের হাত থেকে ফের ছিনিয়ে নেন কনৌজ আর কাশীর স্বাধীনতা। নাগর শিলালিপিতে রাজা অদক্ষমাল্লা নিজেকে গাহারওয়াল রাজবংশের একটি শাখা বলে দাবিও করেছেন। বিষ্ণুহরি, মির্জাপুর আর নাগরের শিলালিপির বর্ণনায় রাজা জয়চন্দ্রের কোন কন্যাসন্তানের উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র পুত্রসন্তান হরিশচন্দ্রের উল্লেখ রয়েছে।

অপরদিকে চাঁদ বারদাইয়ের লেখা কাব্যগ্রন্থ পৃথ্বীরাজ রাসোতে রাজা জয়চন্দ্রের কন্যাসন্তান হিসেবে সংযোগীতার নামে এক রাজকুমারীর বিবরণ রয়েছে, যাকে বিবাহ করবার জন্য কনৌজের রাজপ্রাসাদ থেকে অপহরণ করে এনেছিলেন সমসাময়িক দিল্লির অন্তিম ভারতীয় শাসক রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। এদিকে পৃথ্বীরাজ রাসোর বর্ণনায় সমকালীন চালুক্যরাজা তথা কায়দারা যুদ্ধের নায়িকা রানী নাইকিদেবীর পুত্র ভীমদেব সোলঙ্কির বিষয় সহ একাধিক ঐতিহাসিক ভুল পাওয়া গিয়েছে। রাসোর বর্ণনায় মেবারের রাজা রাওয়াল সমর সিংহকে পৃথ্বীরাজের মিত্র আর তাঁর বোন রাজকুমারী পৃথার স্বামী হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সমর সিংহের শাসনকাল পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর আরও ১০০ বছর পরে ছিল। অতএব এর থেকে অনুমান করা যায় রাজা জয়চন্দ্রের কোন কন্যাসন্তানের অস্তিত্ব ছিল না। এছাড়াও রাসোর বর্ণনা অনুসারে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে রাজা জয়চন্দ্রের বিরুদ্ধে ঘোরী বাহিনীকে সাহায্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগও সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওইসব শিলালিপি আর মেরুতুঙ্গার প্রবন্ধ চিন্তামনি, প্রবন্ধকোষা সহ একাধিক প্রাচীন পুস্তকের বিবরণ অনুযায়ী অনৈক্য আর নিজ নিজ রাজ্যের সীমান্ত সংক্রান্ত বৈরিতার ফলেই তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কনৌজের রাজা জয়চন্দ্র আর গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় ভীমদেব সোলঙ্কি। অপরদিকে ১১৯৪ সালে চান্দেরওয়ারের যুদ্ধেও রাজা জয়চন্দ্রের সামরিক সাহায্যের আর্তিতে কর্ণপাত করেননি বঙ্গের সমকালীন রাজা লক্ষণ সেন। বলাই বাহুল্য এর কিছুকালের মধ্যেই নিজের নিষ্ক্রিয়তার উচিত শিক্ষা পেয়েছিলেন রাজা লক্ষণ সেনও। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় তিনিও অন্যকোন ভারতীয় রাজাকে তাঁর পাশে পাননি।
চান্দেরওয়ারের ধর্মযুদ্ধে রাজা জয়চন্দ্রের পরাজয়ের সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশের ভাগ্যাকাশ ছেয়ে গেছিল নিকষ আঁধারে। আরও কখনও বিদেশি শাসকদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি উত্তরপ্রদেশ। তুর্কিদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দিল্লির সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশের দখল নিয়েছিল জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরের চুগতাইজাত তুর্কি-মঙ্গোল বাহিনী। ইতিমধ্যে তুর্কিদের দ্বারা বেশ কয়েকবার ধস্ত হওয়া প্রাচীন রাম মন্দির এবারে পুরোপুরি ধ্বংস করে সেখানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করলো বাবরের বাহিনী। তারপর বক্সারের যুদ্ধের পরে সরকারিভাবে উত্তরপ্রদেশ আর দিল্লির দখল এসেছিল ব্রিটিশদের নিকটে। শেষে ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেই অবশিষ্ট ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতা এসেছিল ভারত সরকারের হাতে। অদূরদর্শী ভারতীয় রাজারা যদি নিজেদের অনৈক্য আর বৈরিতা মিটিয়ে নিয়ে রাজস্থান বা ভারুচের মহাযুদ্ধের মতো তরাইন আর চান্দেরওয়ারের রণাঙ্গনে একত্রিত হয়ে লড়তেন তাহলে হয়তো আজ আর ভারতীয়দের এইভাবে ওয়াকফ বোর্ডকে আলাদা পাঁচ একর জমি উৎকোচ দিয়ে নিজেদের রাম মন্দিরের স্থানের অধিকার ফিরে পেতে হতো না।