শিল্পী রবীন মণ্ডলের মুখেরা : চার দশকের অদেখা চিত্র প্রদর্শনী দেবভাষায়

Story image

১৯২৯ সালে হাওড়ার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম এই শিল্পীর। পড়েছেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। ১৯৬৮ সালে সাত-আট জন বন্ধু মিলে দিল্লির আইফ্যাক্স গ্যালারিতে ছবির প্রদর্শনী করেন, পরে উৎসাহিত হয়ে তৈরি করেন ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’। ১৯৬৯ সালে, মার্কেট স্কোয়ারের মুক্তাঙ্গনে কলকাতায় সর্বপ্রথম যে‘ আর্ট ফেয়ার’-এর শুভ সূচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সরাসরি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত ললিত কলা আকাডেমির সদস্য ছিলেন। পুরস্কৃত হয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ পুরস্কারে। সুন্দর নয়, ‘খ্যাঁচামার্কা’ ছবি আঁকতেই ভালবাসতেন। শিল্প চর্চায় রবীন্দ্রনাথ, রেম্ব্রান্ট-কে আদর্শ ভাবতেন, ভালোবাসতেন পিকাসো, মাতিস, রামকিঙ্কর, গনেশ হালুই-এর কাজ। শুধু ভারত নয়, নানা দেশেই তাঁর ছবি-ভাবনা পৌঁছেছিল।

২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী রবীন মণ্ডলের জীবদ্দশায় তাঁর শেষ চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছিল দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে। সে বছর জুনে প্রয়াত হন শিল্পী। প্রয়াণোত্তর তাঁর অদেখা কাজের প্রদর্শনী এ বার, ১১ মে থেকে দেবভাষার প্রদর্শনীকক্ষে শুরু হয়েছে নতুন চিত্রপ্রদর্শনী ‘ফেসেস’। আশির দশকের শেষ থেকে জীবনের অন্তিম পর্যায়ের মধ্যে আঁকা শিল্পীর কালি-কলমে একটি আত্মপ্রতিকৃতি সহ মোট তেইশটি ছবি রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। রবীন মণ্ডলের চিত্রকর্মের একটি বড়ো জায়গা জুড়ে আছে বিভিন্ন মুখাকৃতি—মুখোশ। তাঁর কাজের যে সময়কাল, সেখানে যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের যে চরম মানবিক বিপর্যয় তিনি তা চাক্ষুষ করেছিলেন ব্যক্তিজীবনে-শিল্পজীবনে; তার ছবিকে সেই চিন্তনই প্রভাবিত করেছিল। রবীন মণ্ডলের সে সব চিত্রভাষাই উঠে এসছে দেবভাষার এই সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে। 

শিল্পী লিখেছেন, “একটা বিষয়ে আমি সচেতন, আমার কাজ নয়নসুখকর নয়।” ২০১৮, ৩০ জুন প্রকাশিত এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি নিয়ে বলা খুব শক্ত। কে কী ফিলিংস নিয়ে করছে জানি না। ওরা বলেন এর মধ্যে দুঃখ আছে, হাসি-কান্না সবই আছে। একটা লোক ছবি দেখে একটা ইমপ্রেশন নিয়ে যায়। সে যোগ-বিয়োগ করে বলবে এটা দুঃখের ব্যাপার, কি আনন্দের ব্যাপার অত কিছুর দরকার নেই। ছবি দেখে যদি সে পেয়ে যায় তাহলে ঠিক আছে। তা নাহলে তারা বলে এ রঙ নিয়ে খেলা করেছে ভালো। যেমন জ্যাকসন পোলক। জ্যাকসন পোলকের যন্ত্রণাটা আমরা যারা ছবি আঁকি তারা বুঝতে পারি কত যন্ত্রণার মধ্যে সে ছবিগুলো করেছে। অন্যের কাছে ওগুলো অ্যাবস্ট্রাকট পেন্টিং, কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।” প্রকৃত রসিকের চেতনায় তাঁর কাজ যে নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়, বলার অপেক্ষা রাখে না তা।

ভবিষৎ নয়, ‘আর্ট’-এর ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই সাম্প্রতিক, এমনটাই ভাবতেন। প্রতি কালেই এটা হয়ে এসেছে যে, যাঁরা আর্ট বোঝেন তাঁরা সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যাঁরা বোঝেন না তাঁরা দেননি, এই অঘোর সত্যিও তিনি স্বীকার করেছেন। চাইতেন বিশাল বিশাল ছবি তৈরি করতে। দেশের শিল্প সংক্রান্ত অর্থনৈতিক তথা মানসিক মন্দা তাঁর মত সত্যিকারের শিল্পীসত্ত্বাকেও ব্যথিত করেছিল।

প্রসঙ্গত, এই প্রদর্শনীর বিশেষ প্রাপ্তি, ১৯৯২-এ দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর রচনা ‘আমার কথা’, যা দেবভাষা থেকে এবার প্রকাশ পেল গ্রন্থাকারে। প্রদর্শনী ২২ মে পর্যন্ত, রোজ ২টো-৮টা, রবিবার বাদে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.