মোদী ঝড়ে নীড় হারা একঝাঁক ভোটপাখি

সপ্তদশ লোকসভা শেষে ভারতের আকাশ আবারও গেরুয়া। আগের থেকে আরও গাঢ়। আরও বিস্তৃত, আরও ঘন। ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদী প্রায় ৪৮ বছরের ব্যবধান। পর পর দুটো লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের বিরল কৃতিত্ব। অন্যদিকে পরপর দুবার বিরোধী দলের স্বীকৃতি অর্জন করতে ব্যর্থ দেশের সব থেকে পুরানো রাজনৈতিক দল। এই লোকসভা ভোট পরিবর্তিত ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে খুব স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। ভোটের ফলাফল ঘোষণার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তে ভোট পাখিরা নানা কলরবে মত্ত ছিল। কেউ রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বিরোধী ঐক্যের সলতে পাকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, কেউ আবার সংবাদমাধ্যমের সামনে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি নিয়ে জোর দরবার করছিল। এমনকী ২২টা রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের দাবিপত্রের খসড়া সংবাদমাধ্যমে ঘুরছিল। দিনের শেষে দেখা গেল সলতে পাকানোই সার, প্রদীপটাইফুটো হয়ে গিয়েছে। দুই রাজ্যের দুই যাদব প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ল। বিজেপির হাত ছেড়ে বিরোধী জোটের মুখ হয়ে ওঠার চেষ্টায় রত চন্দ্রবাবু ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। আর বাঙ্গলাকে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে বসা দিদির সাধের ঘাসফুল বাগান আজ উজাড় হবার অপেক্ষায়। তোষণ আর পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করে দশকের পর দশক ধরে নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান চালানো তথাকথিত আঞ্চলিক দলগুলি আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। পরিবর্তিত ভারতবর্ষের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদী শুধু এই মুহূর্তে বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের জনমানসের রাষ্ট্রচেতনার নব দিগন্তের পথিকৃৎ। সপ্তদশ লোকসভা পরবর্তী ভারতবর্ষের পরিবর্তিত বৃহৎ প্রেক্ষাপটগুলি হলো—
১। এই ভারত নব যৌবনের ভারত, যাদের রাজনৈতিক চেতনা জাতিবাদ কিংবা আঞ্চলিকতাবাদের সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে রেখে জাতীয়তাবোধকে আপন করে নিয়েছে। তাই পারিবারিক প্রতিষ্ঠান চালানো আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ এই যুবকদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক, হাস্যস্পদ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। রাজনৈতিক কৌতুকের একটা বড়ো অংশ আবর্তিত হয় এঁদেরকে ঘিরেই আর দেশের সব থেকে প্রাচীন রাজনৈতিক দলের কাণ্ডারি তো দেশের যুবা প্রজন্মেরসব খেকে বড়ো কৌতুকের খোরাক।
২। বিগত পাঁচ বছরে হিন্দুত্বের যে নবজাগরণ হয়েছে, বিরোধী দলগুলো তাকে নস্যাৎ করে তাদের পুরনো ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর রাজনীতিতে মশগুল থেকেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যে সংখ্যাগুরু সমাজের প্রতি উদাসীন থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছের লোক হয়ে ওঠা নয়, এই বাস্তব চেতনাটি আমাদের প্রায় সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে এই রাজ্যের শাসক দলের কাছে অপ্রিয় ছিল। আজ জয় শ্রীরাম বললে এই রাজ্যে তিরস্কৃত হতে হয়, কিন্তু আসাউদ্দিন ওয়াইসি কিংবা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মতো লোকমুখ্যধারা রাজনীতিতে থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে পুরোদস্তুর ধর্মীয় মৌলবাদের প্রচার করলেও কেউ টু শব্দ করে না। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উদারতার সুযোগে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো ঘৃণিত কাজকে এই রাজ্যে তথা সমগ্র দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩| দেশের ভোটররা আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন, তারা ক্ষণস্থায়ী পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বোঝেন এবং তার কুপ্রভাব সম্পর্কে অবহিত। তাই ন্যায়-এর থেকে জিএসটি যে দেশের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনেক বেশি লাভজনক তা তাঁরা বোঝেন। এখনকার যুবক-যুবতীরা সরকারি চাকরির লোভে দাদা-দিদিদের দলদাস হয়ে নিজেদের যৌবন বিসর্জন দেওয়ার থেকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বদ্ধ পরিকর। এই যুবসমাজ নিজেদের এই দেশের একজন স্বতন্ত্র নাগরিক হিসেবে ভাবতেই বেশি ভালোবাসে, কোনো জাতের বা কোনও আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে নয়। তাই তাদের মসিহা সেজে সরকারি চাকরির টোপ দিয়ে তাদেরকে নিজেদের ভোটেব্যাঙ্কে পরিণত করার দিন শেষ।
৪| জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মহিলারা বিগত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে যেভাবে নিজেদেরকে গুরুত্ব পেতে দেখেছেন তা অভূতপূর্ব। নারী সশক্তিকরণ মানে যে শুধু রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নয়, একেবারে গোড়া থেকে পরিবারের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসাবে চিহ্নিত করে তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আজ দেশের কোটি কোটি মহিলার দ্বারা স্বীকৃতি।
৫| শক্তিশালী দেশের বুনিয়াদ হলো আপোশহীন জাতীয়তাবোধ জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা। ভারতকে জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন দিতে যে একমাত্র নরেন্দ্র মোদীই পারেন তা এ দেশের মানুষ জানে। বিগত পাঁচ বছরে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ভারত-সিংহের গর্জন শোনা গিয়েছে, যা আগামীদিনে আরো বেশি করে অনুভূত হবে।
তাই আগামী পাঁচ বছর নিজের ব্যক্তিস্বার্থের কথা না ভেবে একটু দেশের কথা ভাবতে হবে, অন্তত দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নিজেদের উপস্থিতিটুকু জানান দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে, নচেৎকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সোমনাথ গোস্বামী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.