আচার্যবান পুরুষো বেদ তস্য তাবদেব চিরং যাবন্ন বিমোক্ষহথ সম্পৎস্য ইতি

যথা সোম্য পুরুষং গন্ধারেভ্যোহভিনদ্ধাক্ষমানীয় তং ততোহতিজনে বিসৃজেৎ স যথা তত্ৰ প্রাঙবোদঙবাহধরাঙ বা প্রত্যঙ বা প্রধ্ম‍্যা্যা্য়ীতাভিনদ্ধাক্ষ আনীতোহভিনদ্ধাক্ষো বিসৃষ্টঃ।।

উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বললেন, হে সোম্য , কোন ব্যক্তির চক্ষু বন্ধন করে তাঁকে গান্ধারদেশ থেকে এনে কোনো নির্জনস্থানে ছেড়ে দিলে সে যেমন কখনো পূর্ব, কখনো পশ্চিম, কখনো উত্তর ,কখনো বা দক্ষিণমুখী হয়ে চিৎকার করতে থাকে – কেন আমাকে চোখ বেঁধে এখানে এনেছ, কেনই বা চোখ বাঁধা অবস্থায় এখানে ফেলে গেছ?

তস্য যথাভিনহনং প্রমুচ‍্য প্রব্রূয়াদেতাং দিশং গন্ধারা এতাং দিশং ব্রজেতি স গ্রামাদ্ গ্রামং পৃচ্ছন্ পন্ডিতো মেধাবী গন্ধারানেবোপসসম্পদ‍্যে্যে্বেতৈবমেহাচার্যবান্ পুরুষো বেদ তস্য তাবদেব চিরং যাবন্ন বিমোক্ষহথ সম্পৎস্য ইতি।।

তখন যেমন কেউ তাঁর চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলেন , “এদিকে গান্ধারদেশ যাবার পথ চলে গেছে এই দিকে যাও,” এবং সেই বুদ্ধিমান ব্যক্তি সেই নির্দেশ মান্য করে গ্রাম হতে গ্রামন্তরে জিজ্ঞাসা করতে করতে গান্ধারদেশ গিয়ে পৌঁছন। তেমনি এই সংসারে যিনি গুরুর উপদেশ পেয়েছেন তিনিই আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন। যখন তিনি দেহমুক্ত হন তখন তিনি ব্রহ্মে লীন হন।

অর্থাৎ উপনিষদ বলছেন – দুরূহ আত্মতত্ত্বের কথা। সহজ করে বোঝানোর জন্য মন্ত্রদ্রষ্টা কিছু উপমার সাহায্য নিয়েছেন। যেমন ধর, তুমি একদল ভীষণ দস্যুর কবলে পড়েছ। তারা তোমাকে লুঠ করল কারণ তুমি আত্মরক্ষা কি বস্তু জানো না বা জেনেও আত্মরক্ষা কর নি।! এবার তারা তারই সুযোগ নিয়ে তোমার চোখ বেঁধে ও হাত বেঁধে গহীন অরণ্যে ছেড়ে দিয়ে গেল। সেই অরণ্যে হয়তো অনেক হিংস্র প্রাণীও আছে। তোমাকে এবার তো আত্মরক্ষা করতেই হবে তাই না? তোমাকে ওই অরণ্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে সভ্য লোকালয়। কিন্তু তোমার চোখ বাঁধা। তোমার চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার। তুমি জানো না কোথায় তুমি আছ? কি করবে তুমি? তুমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছুটবে, পড়বে, ভীষণ আহত হবে, তুমি যন্ত্রনায় চিৎকার করবে , বলবে : কোথায় কে আছ ? আমাকে বাঁচাও! আমি অমুক গাঁয়ে থাকি! আমি দস্যু দ্বারা আক্রান্ত, আমি লুন্ঠিত, পর্যুদস্ত, আমি চোখ এবং হাত বাঁধা। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দয়া কর আমাকে। এই গহীন অরণ্য হতে বাহির হবার পথ দেখাও।” তখন যদি দয়াপরবশ হয়ে কোনোজন তোমার হাত ধরেন , তোমার বাঁধন টুটে তোমাকে মুক্ত করে গহীন অরণ্য হতে বাহির হবার পথ দেখিয়ে দেখিয়ে দেন , তিনিই তোমার গুরু। তুমি যে অজ্ঞ । তুমি পথের হদিস জানো না। কিভাবে সত্য লাভ করবে , কিভাবে নিজেকে ভবিষতে এমন ঘটনা হবার থেকে রক্ষা করবে, কিভাবে দিব্যজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান একত্রে লাভ করবে তার তুমি কিছুই জানো না। কিন্তু যিনি সঠিক পথ জানেন , তাঁর যদি দয়া হয়, করুণা হয় তোমার উপর, তখন তুমক তাঁকে বলবে : ” আমাকে গৃহতে পৌঁছে দাও।” কিন্তু গৃহ কোথায়? আত্মায়। জীবাত্মা পরমাত্মার কাছেই ফিরে যেতে চায়।

আত্মা যেন নিজেই নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। কিন্তু জীবাত্মা এবং পরমাত্মা পৃথক নয়। কেবলমাত্র একটি আবরণ রয়েছে। তাই মনে হয় দুয়ের মাঝে কত ব্যবধান। এই ব্যবধান মুছে ফেললেই তুমি আলোক দেখতে পাবে।

এখন প্রশ্ন হল তুমি বা আমি যদি অজ্ঞ হই তবে তা কেমন করে যাবে? একমাত্র গুরুর উপদেশেই তা সম্ভব হবে । কিন্তু গুরুকে অবশ্যই যোগ্য হতে হবে। অন্ধজনকে তো অন্য অন্ধ পথ দেখাতে পারবেন কি? সে চেষ্টা অনেকেই করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোলকধাঁধায় নিজেও ঘোরেন এবং আমাদেরও ঘোরান।

একজন ব্যক্তি , যিনি আত্মরক্ষা করতে জানেন না বা জানলেও করেন না এবং তাঁকে লুন্ঠন করে হাত, চোখ বেঁধে গহীন অরণ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে – এই উপমার সঙ্গে উপনিষদ এবং মন্ত্রদ্রষ্টা আমাদের অবস্থাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা সবাই অন্ধ ,অজ্ঞ। তুমি , আমি সবাই। অজ্ঞতার জন্যই তো আমরা দুঃখ কষ্ট পাই। অবিদ্যা স্বরূপ এই মায়ার সংসারটা তো গভীর এখানেই আসক্তি আমাদের দেয় বন্ধন। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ জানি না। সেই জন্যই তো সদগুরুর প্রয়োজন, যিনি পথের সন্ধান জানেন। তিনিই আমাদের হাত ধরে পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

শঙ্করাচর্যের মতে , মেধাবী শব্দের অর্থ যিনি বিচার করতে সক্ষম। হয়তো তুমি উপযুক্ত গুরুকে পেয়েছ। তিনি তোমাকে পথ দেখিয়েছেন, উপদেশও দিয়েছেন। কিন্তু তোমাকেও তোমার নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে।

ধরা যাক ,উপযুক্ত গুরুর আদেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে তুমি জ্ঞান লাভ করেছ। আত্মজ্ঞান হলেই মুক্তি। কিন্তু উপনিষদ বলেছেন যে এই মুক্তির পথে একটি বাধা আছে। বাধাটি কি ? সেটি হল তোমার বা আমার প্রারব্ধ কর্ম। কর্ম অর্থাৎ কর্মফল। সৎ কর্ম করলে, ভালো কর্ম করলে তুমি ভালো ফল পাবে। মন্দ কর্ম করলে সর্বনাশ হবে।

বেদান্ত মতে কর্ম অর্থাৎ কর্মফল তিন প্রকার – সঞ্চিত কর্ম, আগামী কর্ম এবং প্রারব্ধ কর্ম।সঞ্চিত কর্ম মানে জন্মজন্মান্তরের কর্মফল সঞ্চিত আছে। কিন্তু এখনও ফল দিতে শুরু করেনি। আবার পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বর্তমানে যে কর্ম করছি তা হল আগামীর কর্ম। তার কিছু ফল এজন্মেই এই পৃথিবীর বুকে ভোগ করে যাব। বাকি সময়ে ফলবে। প্রারব্ধ কর্ম অর্থাৎ অতীতের যেসব কর্ম ইতিমধ্যেই ফল দিতে শুরু করেছে।

বেদান্ত বলছেন, আত্মজ্ঞান লাভ হলে সঞ্চিত ও আগামী কর্ম দুই – ই নষ্ট হয়। শঙ্করাচার্যের মতে , উভয় কর্মই জ্ঞানাগ্নিতে ভস্মীভূত হয়। কিন্তু জ্ঞানীকেও প্রারব্ধ কর্ম ফল ভোগ করতে হয়। প্রারব্ধের নিমিত্তই তাঁর জীবনটা চলতে থাকে। যেমন- আমার যদি ক্যান্সারের ন্যায় কঠিন রোগ হওয়ার থাকে তবে হবেই। তাকে খণ্ডন করা যাবে না। প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

প্রারব্ধ কর্মের দুটি উদাহরণ আছে । প্রথমটি হল – করাত দিয়ে একটি বৃক্ষ ছেদন হচ্ছে। কিন্তু পুরো বৃক্ষ ছেদন হয়ে গেলেও বৃক্ষটি পড়ে যায় না, কিছুক্ষণ দন্ডায়মান থাকে। তাকে ধাক্কা দিয়ে, দড়ি টেনে ফেলতে হয় বা জোরে ঝড় হলে পড়ে যায়। ঠিক তেমনি জ্ঞানলাভ হওয়ার পরেও প্রারব্ধের জন্যই জীবন আরো কিছুদিন চলতে থাকে।

দ্বিতীয় উদাহরণটি হল: একটি তীর ছোঁড়া হয়েছে। একটিবার জ্যা চুত্য হলে তা পুনশ্চ ফিরে আসে না। প্রারব্ধ কর্মও ঠিক তাই। যতদিন তাঁর শক্তি নিঃশেষ না হচ্ছে ততদিন প্রারব্ধ চলতে থাকে।

অবশ্য আত্মজ্ঞান লাভ হলে সেই ব্যক্তি আর পাঁচজনের মতো কাজ করেন না। তিনি যা কিছু করেন তা সকলই পরহিতার্থে। শঙ্করাচার্যের মতে জ্ঞানী ব্যক্তি বাসনাতাড়িত হয়ে কোন কাজ করেন না। বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য যে কাজ তা মানুষকে বদ্ধ করে , সে কাজ যতই ভালো হোক না কেন! নাম যশ প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোন স্বার্থে কত মানব ভালো কর্ম করে গেছেন। কিন্তু তা কেবল বন্ধন দিয়েছে, মুক্তি দেয় নি।

শঙ্করাচার্যের মতে , মুক্ত পুরুষ কখনো এমন কিছু করেন না যা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। শাস্ত্রবিরুদ্ধ অর্থাৎ নিজের নাম, অর্থলোভে , নিজেকে অমর করবে এমন বাসনায় কাজ করেন না। বেতালে তাঁর পা পড়ে না। কেবলমাত্র সৎ কর্ম করেন পরহিতার্থে ( লোকহিতার্থং) , ঈশ্বরের প্রীতির জন্য ( ঈশ্বরার্থং)।

গুরুপূর্ণিমায় ইহাই আমার গুরুকে উৎসর্গ করলাম।

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.