বৈপরীত্যের বছর, বিক্ষোভ আর প্রতিবাদেরও

“ইয়া তো বরবাদ কর দো
ইয়া ফির আবাদ কর দো”

সুমন ভট্টাচার্য

বলিউডের বাঙালি পরিচালক অনুরাগ বসুর লুডো সিনেমায় আরেক বাঙালি অরিজিত সিংহের গাওয়া এই গানের মুখরাটাই কি আসলে ২০২০ কে বোঝায়?? হয়তো বা। ২০২০ বরবাদই করেছে বেশিরভাগ মানুষকে, কিন্তু ধনকুবেরদের আবাদও করে গেছে। না হলে এই অতিমারির বছরে আমাজনের মালিক জো বেজো বা ভারতীয় শিল্পপতি আম্বানি,আদানিদের সম্পদবৃদ্ধিকে কি ভাবে ব্যাখ্যা করব?? লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে বাসস্থান বা অন্ন খুঁজে নেওয়ার পাশাপাশি ২০২০ যে এই ধনীদের আবাদ করে দিয়ে গিয়েছে,এটাও তো সত্যি।

আসলে ২০২০ এইরকমই বৈপরীত্যের একটা বছর গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এইরকম ভয়াবহ সংকট হয়তো মানব সভ্যতা আর দেখেনি,আবার দেখবে এহেন আশঙ্কাও আমরা হয়তো করব না। কিন্তু কে কোনদিন ভেবেছিল, বিশ্বের ব্যস্ততম সব বিমানবন্দর শ্মশানের মতো চেহারা নেবে আর খাস নিউইয়র্কে গণকবর খুঁড়তে হবে করোনায় মৃতদের অন্তিম সংস্কারের জন্য। নিউইয়র্ক টাইমস তাই বাধ্য হয়েই লিখেছিল,এই অতিমারি আমাদের সমাজ এবং যাবতীয় অভ্যাসকে এমনভাবে বদলে দিয়ে যাচ্ছে,যা গত এক শতাব্দীতে কেউ ভাবেনি। যুদ্ধে তবু মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার রীতি ছিল,আকুলিবিকুলি শোকপ্রকাশের চল ছিল। এখানে সেইসব শোকপ্রকাশ তো কোনছাড়, করোনায় মৃতদের শেষ দেখার সুযোগও ছিল না।

আসলে যেটা হওয়ার কথা ছিল শারীরিক দূরত্ব, অতিমারি মোকাবিলায় সেই শব্দটা যে সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং হয়ে আমাদের সামাজিক জীবনকে এইরকম ওলটপালট করে দেবে কে জানত?? বছরের শেষে সালতামামি গুনতে গিয়ে তাই শবযাত্রার মিছিল যেমন ভারাক্রান্ত করে, তেমনই মনে করিয়ে দেয় অহেতুক ভয় এই শহরেই অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীকে নামাতে সাহায্য না করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এটাই বোধহয় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শব্দের ভয়াবহতা বা আমাদেরকে বিপন্ন, রিক্ত করে দেওয়ার বাস্তব চিত্র। কোভিডের এই বছরে মৃত্যুর এই অবিরাম,অবিরত তালিকায় যেমন প্রিয় অভিনেতা ইরফান খান থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, তেমনই চির বিদ্রোহী মারাদোনা বা বাঙালি আইকন পিকে ব্যানার্জি বা চুনী গোস্বামীর মতো খেলোয়াড়রাও ছিলেন| এবং কোভিড যে আতঙ্কের হিমেল স্রোত আমাদের শিরদাঁড়ায় বইয়ে দিয়েছিল, তাতে অনেকের শেষ যাত্রায়, শেষ শ্রদ্ধা জানাতেও শরিক হওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যদি পৃথিবী এতবড় সংকট, এত ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মোকাবিলা না করে থাকে, তাহলে আমরা যাঁরা কলকাতায় থাকি, তাঁদের করোনার মতো অতিমারির পাশাপাশি আমফানের মতো ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবহবিদরা যেমন ঐতিহাসিক ভাবে গত ২০০ বছরে আর কোনো ঝড় এইরকমভাবে গঙ্গাতীরের শহরকে তছনছ করে দিয়ে যায়নি বলে দাবি করছেন, তেমনই আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও হয়তো সেইরকমটাই বলে| তাই ২০২০ করোনা,আমফান দিয়ে বাঙালির শরীরে এবং মনে যে ক্ষত রেখে গিয়েছে,তাতে হয়তো চট করে প্রলেপ লাগবে না। রাজনৈতিকভাবে বাঙালি যদি একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে অনেকবেশি করে এটা সত্যি যে এই বঙ্গের শরীরে গভীরে ক্ষত, মনে তীব্র যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা নিজের প্রাপ্য বুঝে না পাওয়ার।

বাঙালি হৃদয়ের এই প্রাপ্য না পাওয়ার ক্ষোভ হয়তো ২০২০ র মুড বা সামগ্রিক মেজাজের সঙ্গে মানানসই। এই বছরটা তো আর একদিক থেকে প্রতিবাদ,প্রতিরোধ আর বিক্ষোভের বছর। আমেরিকা যদি মহামারিকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে থাকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের জন্য, গত শতাব্দীর ৬ এর দশকে মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের জন্য যে প্রতিবাদের সূচনা করেছিলেন, তারপরে যদি মার্কিন মুলুক এইরকম বিক্ষোভ না দেখে থাকে, তাহলে ভারতও বছরটা শেষ করবে রাজধানী দিল্লির উপকন্ঠে হাজারো কৃষকের বিক্ষোভ আর পাঞ্জাবি প্রতিবাদী গান, স্লোগানের মধ্যে দিয়ে। স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছরের ইতিহাসে রাজধানী দিল্লিকে এইভাবে ঘিরে রাখার, এক মাসেরও বেশি কৃষকদের ধর্নায় বসে থাকার নজিরই বা আমরা কবে দেখেছি ??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.