আমি মফস্বলের মেয়ে বেহালা চৌরাস্তা ছাড়িয়ে শিলপাড়া ছাড়িয়ে আরো ভিতরে আমার বাড়ি ছিল । এখনো গেলে প্রাচীন মফস্বলের সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে। আমার জন্মের ঠিক এক বছর আগে ১৯৮৮ সালে আমার কাকা, বাবা ,বড় পিসি মিলে কেনারাম গাঙ্গুলীর শেষ প্রান্তে দের কাঠা জমি কিনে নিজেদের স্বপ্নের বাড়িতে তৈরি করেছিলেন। বাড়িতে তৈরি হয়েছিল কিন্তু বাড়ি কতটা সুখের হয়েছিল আমি জানিনা।

যখন আমি হই তখন ও বাড়ি তৈরি হচ্ছে বাড়ির একটা দিক কোনরকমে তৈরি করে ঠাকুমা, কাকা ,পিসি ,বাবা, মা সবাই একসঙ্গে বাস করত। তার সঙ্গে ছিল একটা কুকুর ভূতো। ভূতো অ্যালসেশিয়ান কুকুর হলেও শোনা যায় বাবা ছিল নেকড়ে। অন্যন্য এলসিসিয়ানের থেকে একটু বড় একটু বেশি হিংস্র ছিল। তবে বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসত।

যাক, সে গল্প অন্য একদিন হবে। তো যে জমিতে বাড়ি হয় তাতে কিছু বাস্তু দোষ ছিল। আমার বড় পিসি ছিল ঘোর নাস্তিক। মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে নার্সিং এর চাকরি নিয়ে মালদায় থাকার জন্য খুব ডাকাবুকো ছিল। অনেক বারণ করার পরেও সেই জমিই কিনল। ঠাকুমা বারণ করতে গিয়েছিল জমি রেজিস্ট্রির দিন। বড় পিসি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল ” এলাকার লোকের ওই জমিতে লোভ, অমন পুকুর পাড়ে নিরিবিলিতে জমি, শান্ত পরিবেশ , সামনে আমাদেরই আত্মীয়ের অত বড় জমি, বাগান করা যাবে ভালো, তাই ওই সব গুজব রটাচ্ছে।”

জমি কেনা হল । শুনেছি ভূমি পুজোর দিন নাকি ঘট উল্টে গেছিল। ঠাকুমা তারপর তিন রাত গুরুদ্বারায় গিয়ে পড়ে ছিল ভয়। চার দিনের দিন বড় পিসি ট্যাক্সি ডেকে ঠাকুমাকে চ্যাঙ দোলা করে বাড়ি ফিরত আনে।

বাড়ি তৈরির সময় অনেক বাঁধা এসেছিল। কখনো জিনিস গায়েব হয়ে যেত নিজে থেকেই। কখনো ভাড়া খুলে পড়ত। অগত্যা একটা দিক কোনো রকমে করে সবাই চলে আসে। এখনো আমাদের বাড়ি কিন্তু পুরো হয় নি। আমি জানি কোনো দিন পুরো হবে না।

নিঝুম প্রান্ত ছিল তখন কেনারাম গাঙ্গুলি শ্মশান কালি তলা এলাকা। বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ।আমি যখন চার বছরের তখন ইলেকট্রিক আসে ওখানে। রাত হলেই শিয়াল ডাকত দিক বিদিক বিদীর্ন করে। বড় বড় ভাম, খটাস, উদবেড়াল, গন্ধ গোকুল রোজ রাতেই উৎপাত করত। সবাই ভয়ে মোটামুটি ৮ টার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়ত। শীতকালে তো মনে হত আমাজনের নিস্তব্ধ জঙ্গল, যেখানে পশু ছাড়া মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই।

এহেন জায়গায় বাড়ির পিছনে একটা বিশাল পুকুর।এখনো আছে।যদিও সেই আভিজাত্য আর নেই তার। তখন হওয়ায় ভূতের গন্ধ ভাসত। কি শীত কি গ্রীষ্ম কি বর্ষা আমাদের কুপি, হ্যারিকেন, লন্ঠন ই ভরসা ছিল। কারণ লোডশেডিংও আমাদের পরিবারের একজন সদস্য ছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হত। গাছগাছালির মাথায় ভর করে অন্ধকার না তো একটু একটু করে বাইরে পুকুর পাড়ে চালতা গাছ আমড়া গাছ সামনের ফাঁকা জমিতে আম গাছ দূরে তালগাছ গুলোর মাথায় রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটা দিয়ে উঠত। গুমগুম গুমগুম করে কোন গাছের কোটর থেকে প্যাঁচা ডেকে উঠত। গিরিধারী বুড়ির বাড়ির ভাঙা খাঁজ দিয়ে তক্ষক সাপ ডাকত। তক্ষক, তক্ষক। অন্ধকারে পশ্চিম দিকে বাঁশ ঝড়ের সামনে একটা বুড়ো বেল গাছ ছিল। সেই গাছের পাতাগুলো , বাঁশ ঝাড় গুলো কেমন দ্রুত নড়ে উঠত।

জোনাকিতে জোনাকিতে চারিদিকে ভরে উঠত। মনে হত কোনো অলৌকিক পুরীর আবির্ভাব ঘটেছে। লণ্ঠনের সামনে ঘিরে কাকা আমি পিসিরা বসে সন্ধ্যেবেলা গল্প করতাম । দেয়ালে গিয়ে আমাদের বড় বড় ছায়া পড়তো। সেগুলোর দিকে ভয়ে আমি তাকাতাম না ।চোখ পড়লেই গা ছমছম করে উঠত।

বাড়ির পাশে একদল সাঁওতাল থাকত। এখনো আছে। খুব ভালো ওরা। টারবাড়র পুজো করত রোজ । শনিবার করে শুয়র রান্না করত। টারবারোর পুজো করত। ওরা বেশ গল্প করত ওদের মুলুকের।

তো এই পুকুর পারের অন্য দিকে একটা প্রাচীন খাটা পায়খানা ছিল।তার কত কোটি বছর হবে তা কেবল বোধয় সেই জানত। সবাই বলত ওখানে নাকি ভূত আছে।

চিরকালই নাবাল এলাকা হিসাবে ওখানে বর্ষায় জল জমত। পুকুর ভেসে যেত। সেবার বর্ষায় খুব জল হল। জল হলে মাছ বেরিয়ে আসত। পুকুরে স্নানের সময় মাছ ধরা ছিল একান্ত কর্তব্য। তো সেবার ঘোষদের বড় নাতি তুমুল বর্ষায় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে তলিয়ে গেল। দুটো সাঁওতাল দেখেছিল তলিয়ে যেতে। তখন তারা বৃষ্টির হাত থেকে চুলো বাঁচাচ্ছিল। জলে সঙ্গে সঙ্গে ঝাপ দিয়েছিল। কিন্তু ওই প্রচন্ড বৃষ্টিতে খুঁজে পেল না। বিকালে সবাই বাঁশের লগি দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে এক কোণে লাশ খুঁজে পেল।অমন জল জ্যান্ত ছেলে চলে গেল। পাড়ায় সেদিন আর কেউ উনুন ধরাল না।

এবার আমি যে ঘটনা বলব এই ঘটনার প্রায় দু সপ্তাহ পরে। তখন ঘোর বর্ষা চলছে। ছোটবেলা থেকেই নাচ শেখার দরুন সামনেই রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী হিসাবে একটি গীতিআলেখ্য নৃত্য সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল নাচের স্কুল থেকে। বিকেলে মহড়া দেওয়ার জন্য দুপুর দুপুরে কাকা আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পিসিরা অনেক বারণ করেছিল ঠাকুরমা বলেছিল, “আজ আর গান নাচের আসরে যাওয়ার দরকার নেই। বৃষ্টি বাদলের দিন ।গেলেও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।”

কিন্তু দুঃখের বিষয় আসলে তা হলো না ।আমাদের নাচের যিনি শিক্ষক ছিলেন তিনি আসতে দেরি করলেন। ফলে বেরোতে দেরী হয়ে গেল। যখন বের হলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। দূরে বায়ুকোণে একটা বড় মেঘের চূড়া দেখা দিয়েছে । তাই দেখে কাকা বলল , “ওই মেঘটা বেশি সুবিধের নয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।” বেরিয়ে পড়লাম ।

আমাদের বাহন তখন দু চাকার একটা সাইকেল। খুব জোরে চালালেও কি হবে? তুমুল বর্ষার দরুন শীলপাড়া সখেরবাজার এর এলাকা সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন। সাইকেল আর যায় না ।খানিকটা যাবার পরেই দূরে বায়ু কোনটা জুড়ে আকাশের রং পাল্টে গিয়ে ধুলা ধয়াতে হয়ে উঠলো। মনে হলো সিঁদুর গুলে কেউ উল্টে দিয়েছে । হাওয়া ঝড়ের ধাক্কায় মেঘ তারা করে আমাদের মাথার উপরে আকাশ পার হয়ে গেল।

তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। মাথা বাঁচাতে কোন রকমের সাইকেলটা কাছাকাছি একটা চালায় রেখে ,আমি আর কাকা দাঁড়িয়ে পড়লাম । বৃষ্টি অল্প থামতে প্রায় তখন রাত ৯ টা বাজল ।চারিদিক নিঝুম হয়ে এসেছে । সাইকেলটায় কাকা আমাকে বসিয়ে নিয়ে হেঁটে হেঁটে জল দিয়ে পার হচ্ছিল ।

ঘটনাটা ঘটলো প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে ঠিক ঐ পুকুর পাড়ে খাটা পায়খানা কাছে। পুকুর ভেসে গেছে। আমরা যাচ্ছি পিছন দিকে কোন লোকের হেঁটে আসার আওয়াজ হল জলের মধ্যে ছপ ছপ ছপ করে। সাধারণভাবে ওই সময় রাত ন’টায় বৃষ্টির মধ্যে কেউ বের হতো না। কাকা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল কেউ নেই পিছনে। আবার আস্তে আস্তে সাইকেল ঠেলতে লাগল। আবার আওয়াজ হলো । কাকা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে আবার ঘুরে দেখল। কেউ নেই তৃতীয় বার যখন সেই ছপ চপ করে আওয়াজটা হলো। কাকা ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল “কেরে? এলাকার ছেলেকে রাতে ভয় দেখাচ্ছিস? সামনে আয় শালা, খাল খিঁচে নেব।”

বিশ্বাস করুন সাইকেল সমেত আমাদের কেউ যেন সজোরে ধাক্কা মারলো । টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল শুদ্ধ কাকা পড়ে গেল। আমি জলে পড়ে গড়াগড়ি খেলাম। আমার প্রচন্ড আঘাত লেগেছিল। মনে হয়েছিল কেউ আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে। ওই জলের মধ্যে কোনরকমে কাকা আমাকে তুলে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িতে সবাই শুনে কাকাকে প্রচন্ড বকাবকি করতে লাগল। সেদিন রাত থেকে কাকা আর আমার তুমুল জ্বড় এলো ।প্রায় এক সপ্তাহ আমরা ভুগলাম। আমরা ভুল বকছিলাম। কি বলেছিলাম তা আমার পিসি বা ঠাকুমা কেউই আমাদের বলে নি।

এক সপ্তা বাদে যখন আমরা সুস্থ হয়ে উঠলাম তখন থেকে ঐরম নিঝুম রাতে আমাদের বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর বারণ হল।

এর পরের ঘটনাটা ঘটলো বর্ষা যাবার মুখে ।আমাদের বাড়ির পিছন দিকে একটা বড় নারকেল গাছ ছিল দিব্য নারকেল হতো । সেই ছেলেটা চলে যাবার পর থেকে কি জানি কেন নারকেল গাছটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল ।মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষা যাবার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হয় এবং সে বছরও হয়েছিল। একদিন সন্ধ্যেবেলা তুমুল বৃষ্টিতে নারকেল গাছটা ভেঙ্গে হুড়মুড় করে পাশে সাঁওতালদের চালের উপর গিয়ে পড়ল।

ঠাকুমা খুব ভয় পরের দিন শান্তি স্বস্তনের ব্যবস্থা করল। কিন্তু সেই জীবনের প্রথম অপ্রাকৃত ভয় আমার এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। এর পরেও আমার মা আর সেজ পিসিও অনেক রাতে বারান্দা দিয়ে পুকুরে দেখেছিল কেউ যেন ডুবে দিয়ে বুদ্বুদ ছাড়ছে।

দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.