একটি বাঙ্গালী রান্নাঘরের গল্প


#প্রথম_পর্ব


ওঁ শশধরসমবৰ্ণং রত্নহারোজত্বলাঙ্গং কনকমুকুটচুড়ং স্বর্ণযজ্ঞোপবীতস্থ ।

 অভয়বরদহস্তং সৰ্ব্বলোকৈকনাথং তমিহ ভুবনরূপং বাস্তুরাজং ভজমি ॥

 
হ্যাঁ বাস্তু দেবতার আরাধনা। প্রতিটি মন্দির , দেবালয় হতে রাজপ্রাসাদ , সাধারণ গৃহ সর্ব কিছু নির্মাণে এবং নির্মাণের পরে তাঁকে তুষ্ট রাখতে হয়। তিনিই তখন সকল স্থাপত্যের শুভাশুভ বিচারক হন। তারঁ নিয়ম মেনেই নির্মাণ হয়। বাস্তু শব্দটি এসেছে বস্তু থেকে- বস্তু মানে যেকোনো বস্তু, মুলত বাস্তু বলতে সব কিছুকেই বুঝায়- তা একটি স্থান হতে পারে- কিংবা একটা বাড়িও হতে পারে। সুবিশাল ভারতবর্ষে প্রায় সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে স্থাপত্য নির্মাণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।


  বাস্তু কথাটা এসেছে সংস্কৃত শব্দ বস্তু থেকে। শব্দটির অর্থ – যেকোনো সৃষ্টিই হল বাস্তু। আবার বস্তু হল ‘ভূ’। অর্থাৎ পৃথিবী। এই পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হওয়া সমস্ত কিছুই বাস্তু। ময়মতম্ এ ময়া জানাচ্ছেন, সকল নশ্বর এবং অবিনশ্বরের আবাসস্থলই বাস্তুর অন্তর্গত। বাস্তুকে বলা যেতে পারে ভারতীও স্থাপত্য বিজ্ঞান। বিস্তৃত ভাবে এই বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং, নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্যবিদ্যা, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা। 
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই ভারতীও উপমহাদেশে শিল্পচর্চাকে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। স্থাপত্যশৈলী উপবেদের অন্যতম বিষয়। স্থাপত্য উপবেদ বা স্থাপত্যশাস্ত্র চারটি উপবেদের অন্যতম। স্থাপত্য উপবেদ আবার অথর্ববেদ থেকে এসেছে। প্রায় ৫০০০ বছর ধরে বাস্তুবিদ্যা কালের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। স্থাপত্য উপবেদ বা স্থাপত্য শাস্ত্রের সূত্রগুল পরবরতিকালে ‘বাস্তুশাস্ত্র’ শিরোনামে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বৈদিক যুগে স্থাপত্য বিজ্ঞান মূলত মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে তা বিস্তার লাভ করে। প্রাচীন যুগে স্থপতিরা কেবল নিছক রাজমিস্ত্রির ভূমিকা পালন করতেন না, নির্মাণশৈলী ও পরিকল্পনার বিষয়টিও তদারক করতে হত তাঁদের।



তো এহেন বাস্তুবিদ্যায় বা শাস্ত্রে পাকশালা মানে হেঁশেল মানে রান্নাঘরের অবস্থান , সেখানে পাকস্থান অর্থাৎ অগ্নির অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব রাখে। সেখানের পরিচ্ছন্নতা গৃহে লক্ষ্মীর আগমন ঘটায়,  গৃহের সম্মৃদ্ধি আনে।
কবিগুরু বলেছেন –
গদ্য জাতীয় ভোজ্যও কিছু দিয়ো,
          পদ্যে তাদের মিল খুঁজে পাওয়া দায়।
তা হোক, তবুও লেখকের তারা প্রিয়;
          জেনো, বাসনার সেরা বাসা রসনায়।

আবার ইংরেজিতে প্রবাদ আছে – 
The way to a man’s heart is through his stomach…. said to mean that a woman can make a man love her by cooking him good meals.

উক্ত সকল কারণেই  বঙ্গ তথা ভারতীয় নারী এতই রন্ধন নিবেদিত প্রাণ। শুধুই কি তাই ?  তাঁরাই পাকশালায় হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। তাঁদের ভান্ডারে কোনো দিন অভাব হয় না। প্রয়োজনে নিজেরা না খেয়েও পরিবারের সকল সদস্যের মুখে অন্ন তুলে দেন।
ওঁ অন্নপূর্ণে স্বাগতং তে সুস্বাগতমিদন্তব।
আসনঞ্চেদমপ্যস্মিন্‌ আস্যতাং পরমেশ্বরি॥

বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে রান্নাঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব দিকে হওয়া উচিত । সেই কোন প্রাচীন কাল হতে রান্না বা পাকশালা এবং তৎসহ ভোজন কক্ষকে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে রাখা হত। সেটা যত গৃহ স্বামীর আগ্রহে নয় । হত গৃহের যিনি জীবন্ত লক্ষ্মী তাঁর হাত ধরে। এসব তো খুব একটা সাবেক কালের কথাও নয়। আজও তো আমাদের মা , পিসিরা যতই আধুনিক #মডিউলার_রান্নাঘরে রান্না করুন না স্বচ্ছতার ব্যাপারে তাঁরা যেকোনো মিশনকেও ছাড়িয়ে যাবেন। যাক, এসব বাস্তুশাস্ত্র , স্বচ্ছতা ইত্যাদি আলোচনা করতে করতে আজ একটা বাঙ্গালী রান্নাঘরের গল্প বলি।

 
আমি মফস্বলের মেয়ে ছিলাম। ছিল এক একান্নবর্তী পরিবার। আমি নব্বই দশকের সময়কার কথা বলছি। তখন আমাদের ঐদিকে অনেক বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাই আসে নি তো স্টোভ জ্বেলে রান্না করাও ছিল স্বপ্নের মতো। উনুনে কাঠকয়লা, গুল ও ঘুঁটের আগুনে মাটির পাত্রে রান্না হত। উনুনের আগুনের আঁচে আর ধোঁয়াতে রান্না ঘরের দেওয়া থেকে ছাদ সর্বত্র ঝুলকালি পড়ে যেত। মা ,পিসিদের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ত, তবুও তাঁরা সেই পাকশালায় কি অসাধারণ সব পদ সৃষ্টি করতেন ।

 
কেবল তাই ? তখন ভোর বেলা উঠে কোনো না কোনো পিসিকে কয়লা ভাঙতে দেখতাম অথবা গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুঁটে বা গুল দিতে ,শীলনোড়ায় ঘটঘট করে মশলা বাটতে হত, বড় আঁশ বঁটিতে বাড়ির কর্তার আনা আস্ত মাছটা কুটতে হত , সংসারের মধ্যে ছিল আরো উনকোটি সত্তরলক্ষ কাজ। তার মধ্যেও দেখতাম মা ,পিসিরা সেই মাটির উনুন লেপে পুঁছে , গোবর নিকিয়ে রান্নাঘর সাফ সুতরো করে , রান্নাপুজো বা বাড়ির যেকোনো পুজোয় রান্নাঘরে আলপনা এঁকে , সব কিছু কত গুছিয়ে কত নিপুণ ভাবে তাঁরা বাস্তুদেবতাকে খুশি করে রন্ধনকলাকে এক অসামান্য শিল্পে পরিণত করতে পারতেন। তাঁদের গুণে পাকশালা পেতো লক্ষ্মীশ্ৰী ছোঁয়া।


শোভন হাতের সন্দেশ, পানতোয়া,মাছমাংসের পোলাও ইত্যাদিও

যবে দেখা দেয় শোভামাধুর্যে-ছোঁওয়াতখন সে হয় কী অনির্বচনীয়!


ছোটবেলায় আমার বাড়ি , মামার বাড়ি বা মাসির বাড়ি সবই একান্নবর্তী পরিবারই দেখে এসেছি। তো সেই বিশাল পরিবার গুলোতে খুব করেও পাত পড়ত বিশ খানা।  সেসব বৃহৎ পরিবার বা আমার বাড়ির রান্নাঘর গুলোর একপাশে থাকত ঢাউস ঝিঁক তোলা উনুন। এগুলো র বিশেষ পরিচিতি ছিল দোপাকা উনুন নামে। মা ,পিসি বা ঠাকুমাকে দেখেছি পিঁড়িতে বসে সেই উনুনে রান্না করতেন। উনুনের একপাশে টগাঁও রান্নার যাবতীয় সামগ্রী, পাত্রের মধ্যে সাঁতলানো সবজি বা নুন হলুদ মাখা মাছ , মানে যাতে হাতের কাছে সব মজুত থাকে। অত বড়ো পরিবারের রান্না করা তো আর চাট্টিখানি কথা ছিল না। 
আমার ঠাকুমা ছিলেন সাত্ত্বিক মানুষ। আমার ঠাকুরদার মৃত্যুর পড়ে উনি ঈশ্বরের জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তবে , ছোট থেকেই দেখেছি ছোঁয়া ছুঁয়ি বাতিক ছিল। অবশ্য সে বাতিক আমার মা , পিসি, মাসি , মায় আমার মধ্যেও আছে। ঠাকুমাকে এসব নিয়ে বললে , ঠাকুমা বলতেন ” ওরে ,কিছু বাতিক বা সংস্কার ভালো হয়। এসব মনের ব্যাপার। নিরামিষ  যেদিন হবে সেদিন রান্না ঘর পরিষ্কার করা , ব্যবহারের সময় থালা বাটি ধোয়া , হাত ধুয়ে কাজ করা এসব খারাপ না…. নিদেন পক্ষে পরিছন্নতাই বজায় থাকে…বুঝলি..”


আমাদের বাড়িতে কোনো পুজোপার্বন মানেই নিরামিষ রান্না হত। মা , পিসিদের দেখতাম রান্নাঘরের দাওয়াতে বসে বাড়ির সবার জন্য কি অসাধারণ সব স্বাদু নিরামিষ রান্না করতেন। পুজোর দিন ঠাকুরের ভোগ ইত্যাদি রান্না হত , তবে সেটা প্রাত্যহিক উনুনে নয়। পবিত্রতা রক্ষার জন্য আলাদা তোলা উনুন ছিল, সেটা ব্যবহার হত।  আমার বাপের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত গোপাল ঠাকুর আছে। তাই জন্মাষ্ঠমী থেকে দোলপূর্ণিমা ঘটা করে পালন হত। এছাড়াও বারো মাসে তেরো পার্বন, ভাদ্র মাসে মনসা পুজো, রান্নাপুজো ,অরণ্য ষষ্ঠী, জয় মঙ্গলবার , চারমাসের লক্ষ্মী পুজো, দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজো , নবান্ন লক্ষ্মী পুজো, সরস্বতী পুজো , শিবরাত্রি , নীলষষ্ঠী , সত্যনারায়ণ সবই ধুমধাম করে পালন হত। পুজোর দিন গুলোতে দেখতাম মা, পিসিরা আঁশ হেঁশেলের ছোয়াঁ বাঁচিয়ে সব নিয়ম নিষ্ঠা মেনে তোলা উনুনে পুজোর ভোগ ইত্যাদি রান্না করতেন। সে সব রান্নার সরঞ্জাম , জলের কলসী সব আলাদা থাকত সিঁড়ির উপরের সেলফে তোলা।  
শুনেছি বিত্তশালী পরিবারে দুটো রান্নাঘর থাকত। একটি আঁশ অন্যটি নিরামিষ। এখনো ফ্ল্যাট কালচারে আলাদা করে এসবে সময় নেই মানুষের । আমি তো গ্যাস ওভেন সব সাবান জল দিয়ে ধুয়ে মুছে সেখানেই ঠাকুরের ভোগ রান্না করি। তবে , আমার ঠাকুরের বাসন সব আলাদা থাকে। 


রান্নাঘর ও ভাঁড়ার ঘরকে লক্ষ্মীর থান মনে করত আমাদের বাড়ির সবাই। তাই কেউ বাসি বা নোংরা কাপড়ে রান্না ঘরের দুয়ার মারাতো না। প্রতিদিন মা , পিসিরা ভোর বেলা স্নান করেকাচা কাপড় পড়ে শুদ্ধ ভাবে রান্নাঘরে ঢুকতেন।


রান্নাপুজোর দিন আজও আমরা বাঙ্গালীরা নিয়ম মেনে উনুনকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করি। রান্নাপুজোর দিন পান্তাভাত, ডালমাখা, কচু বাটা, আলুভাজা ইত্যাদি খাবার জন্য বাড়িতে বহু অতিথি সমাগম ঘটত। আগেরদিন সারারাত ধরে পিসি , মা , ঠাকুমা সব্বাই মিলে নানা পদ রান্না করতেন। ভোররাতে গোবর নিকিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার হত। কারন পরেরদিন দিন অরন্ধন, ওইদিন অগ্নি দেবতার পুজো, সবাই শীতল খাবেন। রান্নাপুজোর দিন সকালে উঠে সবাই স্নান করে নিতাম। তারপর ঠাকুমা কাশফুল দিয়ে উনুন পুজো করে, কলাপাতায় অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে ও বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে পান্তাভাত, পঞ্চ ব্যজন সাজিয়ে উৎসর্গ করতেন। তারপর রান্নাঘরের দোর বন্ধ করে দিতেন। আর এরম অরন্ধন পালন হত প্রতি বৈশাখ মাসের সংক্রান্তিতে, ঐদিন আমাদের পাড়ায় বাৎসরিক শীতলা পুজো হত। সারাপাড়া মা শীতলার নামে পান্তাভাত খেত। 


ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ D. N. Shukla, Vastu-Sastra: Hindu Science of Architecture

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.