এয়ারইন্ডিয়া বেসরকারীকরণে একমাত্র লাভবান  দেশের প্রান্তিক মানুষই 

প্রথমেই শুরু করি ,কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একটা মন্তব্য থেকে যেখানে উনি বলেছিলেন, দেশের মানুষের রক্ত ও ঘামে তৈরি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নাকি বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে l কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এই সংস্থাগুলির অধিকাংশই তৈরি ব্যক্তি মালিকনায় l ভারত সরকার সোভিয়েত মডেলকে অনুসরণ করে এঁদের জাতীয়করণ করে l পরবর্তীকালে প্রশাসনিক অদক্ষতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং লালফিতের ফাঁসে এই সংস্থাগুলি হয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে সরকারের কাছে ভর্তুকি ভিক্ষা করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, নয় তাদের পরিষেবার খরচ এমন বাড়িয়ে দেয় যে সেই পরিষেবা নেবার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের ছিল না l উদাহরণ হিসেবে, ব্যাংক ঋণের সুদ এতো বেশী ছিল এবং রাষ্ট্রায়ত্ত স্টিল কোম্পানিগুলোর স্টিলের বাজারদর এতো বেশী ছিল যে বিংশ শতকের ভারতবর্ষে লোন নিয়ে বাড়ি বানানোর সংস্কৃতিই আমাদের দেশে গড়ে ওঠে নি l অটলজী ব্যাঙ্কিং এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার আনলে ভারতবাসী গত 20-21 বছর ঋণ নিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে l দ্বিতীয় উদাহরণ, টেলিকম l অটলজী প্রধানমন্ত্রী হবার আগে প্রতি পাড়ায় বা গ্রামে একটা টেলিফোন থাকতো, কারণ আয়ের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত BSNL এর বিল অনেক বেশী ছিল l রাস্তায় রাস্তায় টেলিফোন বুথ থেকে মানুষ তার প্রয়োজনীয় ফোন করতো l 2004 এ সেখানে আমরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখছি, পানের দোকানের কর্মচারীর হাতেও মোবাইল l আর সম্ভবতঃ এই কাজের শাস্তি দিয়ে ভারতবাসী 2004 এ অটলজিকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধীর হতে পরের দশ বছর দেশের দায়িত্ব তুলে দেন l তৃতীয় উদাহরণ বীমা জাতীয়করণ l নেহেরুজী LIC কে জাতীয়করণের পরেই দেশের প্রথম স্ক্যাম তথা দুর্নীতি হয় l যার নাম হরিদাস মুন্দ্রা স্ক্যাম l পদত্যাগ করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী l

আর এয়ারইন্ডিয়ার? ক্ষেত্রে দুটো সমস্যাই ছিল l একদিকে পরিষেবার খরচ মানুষের নাগালের বাইরে অন্যদিকে ক্ষতির পরিমান আকাশ ছোঁয়া l সরকারের কাছে দুটি রাস্তা ছিল l এক বন্ধ করে দেয়া, দুই বিক্রি করে দিন দেয়া l গত কয়েকবছরে কেউ এই সংস্থার অদক্ষতা এবং ঋণের কথা মাথায় রেখে কেউ কিনতে আসেনি এই সংস্থাকে l দিনে দিনে বেড়েছে ঋণ এবং ক্ষতির পরিমান l সরকার জনগনের করের টাকায় বাঁচিয়ে রেখেছে এই সাদা হাতি বছরের পর বছর l শেষে এই সংস্থার পুরোনো মালিক গোষ্ঠী এগিয়ে এসে সরকারকে দায়মুক্ত করে l

হ্যা l এয়ার ইন্ডিয়া আবার টাটার কাছে l মাঝে 68 বছর কি হল একবার ভাবা দরকার l কেন 68 বছর আগে টাটার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল এই কোম্পানি? টাটার সঙ্গে সরকারের বিরোধ বাধে দুটি বিষয় নিয়ে l প্রথমতঃ তৎকালীন কমিউনিকেশন মন্ত্রী রফি আহমেদ কিদোয়াই আবদার করেন যে, বড় শহরের সব চিঠিপত্র বিমানে পাঠাতে হবে l পরিকাঠামোর অভাবে জেআরডি টাটা বেঁকে বাসেন l দ্বিতীয়তঃ সেই সময় খুব কম দামে একটি মার্কিন সংস্থা বিমান বেচা শুরু করলে, ভারত সরকার বহু কোম্পানিকে দিল্লির বাবুরা ঢালাও লাইসেন্স দেয়া শুরু করেন l প্রতিবাদ করেন জেআরডি টাটা l তাঁর সঙ্গে অসৎ বাবুদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে l তার উপর তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত তথা প্রধানমন্ত্রীর ভগিনী বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের তার বড়ভাইকে রাশিয়ার জাতীয়করণের সুফল নিয়ে পান্ডিত্যে ভরা কিছু অমূল্য চিঠি l চাচা এয়ার ইন্ডিয়াকে জাতীয়করণ করলেন, কিন্তু বোর্ডে রাখলেন জেআরডিকে l কারণ তার অপদার্থ বাবুদের দ্বারা এই কাজ হবে না সেটা তিনি জানতেন l এর 25 বছর পর প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বোর্ড থেকে জেআরডিকে সরিয়ে দেন l 1991 তে নরসিমা রাও ক্ষমতায় এলে আবার বেসরকারি বিমান সংস্থার জন্য খুলে দেয়া হয় বিমান পরিষেবার দায়িত্ব l

কিন্তু কি পেল ভারত এই জাতীয়করণে? ইন্দিরা গান্ধী/রাজীব গান্ধীর আত্মঘাতী অর্থনীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাদুটির আকাশছোঁয়া অদক্ষতা বিমানভাড়াকে এমন জায়গায় নিয়ে গেল যে, অটল বিহারী বাজপেয়ীজী ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত সরকারি ক্লাস ওয়ান অফিসারদেরও (শুধুমাত্র সৎ অফিসারদের কথা বলা হচ্ছে) 99% এর ক্ষমতার বাইরের চলে যায় বিমান পরিষেবা l আইএএস, অধ্যাপক, সরকারি ডাক্তাররাও 2000 সালের নিজের পয়সায় বিমানে ভ্রমণ ভাবতে পারতেন না l একসময় এয়ারইন্ডিয়ার ক্ষতির পরিমান একলাখ কোটির কাছাকাছি চলে যায় l
যারা বিমান পরিষেবাকে বেসরকারী হাতে তুলে দেবার বিরোধী তাঁদের কাছে প্রশ্ন, লক্ষ্মীকান্তপুর বা মছলন্দপুরের যে চাষী জীবনে কোন দিন কোন বিমানে চড়েন নি এবং আগামী দিনে চড়বেনও না, তিনি কেন এয়ার ইন্ডিয়ার এই বিপুল ধার শোধের দায়িত্ব নেবেন? আর বামপন্থীদের এবারের প্রতিবাদের সুর নরম কেন? সম্ভবতঃ সিঙ্গুর কাণ্ডের পর থেকে টাটাকে তাঁরা বুর্জোয়া লিস্ট থেকে সরিয়ে প্রলিতারিয়েটদের দলে ফেলেছেন, ঠিক যেমন কংগ্রেসকেও তাঁরা আর বুর্জোয়াদের দল মনে করেন না l বলাই বাহুল্য, তৃণমূলও এই ব্যাপারে বামেদের সঙ্গেই l ভাইপো তো বলছেন, তাঁরাই এখন সবচেয়ে বড় বাম l তবে, ভগবানের কাছে ধন্যবাদ এই টেন্ডার আদানী বা আম্বানি জেতেনি l নাইলে শহীদ মিনারের নিচে এবং ঘন্টাখানেক অনুষ্ঠানে আবার মোদীজীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছিলো আর কি l

শেষে আরেকবার বলি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অকর্মণ্যতার দায় দেশের কোটি কোটি গরিবের মাথায় চাপিয়ে দেবার পক্ষে অটলজিও ছিলেন না, মোদীজিও নন l যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা একাধারে মানুষকে সুলভে পরিষেবা দিতে ব্যর্থ এবং অপরদিকে তাদের করা ঋণ শোধের দায়িত্ব নিতে হয় দেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষকদের উপর, তা বহন করা অন্যায় l 1% মানুষের স্বার্থরক্ষায় 99% মানুষের বলি চড়বে না আগামী দিনে l অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং অকর্মন্য বাবুদের করে খাবার রাস্তা বন্ধ করতে সরকার বদ্ধপরিকর l

সুদীপ্ত গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.