শিবাজীর রাজপতাকা, হিন্দু জাতি-গঠন-ভাবনা এবং স্বামী প্রণবানন্দ ও ড. শ্যামপ্রসাদের মধ্যে তার উত্তরাধিকার

১.
শিবাজীর গুরু ছিলেন রামদাস স্বামী, যার জন্য সাতরা দুর্গ জয় করার পর সজ্জনগড়ে আশ্রম নির্মাণ করে দিয়েছিলেন শিবাজী (১৬৭৩)। গুরুকে অঢেল ধন আর ঐশ্বর্য দান করলেও তাঁকে দৈনিক ভিক্ষায় যেতে দেখে শিবাজী অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। গুরুদেবের সাধ মেটাবেন, পণ করলেন শিবাজী। রাজ্যের যা কিছু সম্পদ, এমনকি গোটা মহারাষ্ট্র রাজ্যটাই গুরুকে দান করার শপথ নিলেন। এরজন্য যাবতীয় দলিল – দস্তাবেজ প্রস্তুত করলেন শিবাজী, তৈরি হল দানপত্র। পরদিন সকালে গুরু রামদাস যখন ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বের হবেন, স্বয়ং মারাঠা রাজ তথা হিন্দু-অস্মিতা শিবাজী গুরুর পদতলে সমর্পণ করলেন সমগ্র রাজ্য। গুরু শিষ্যকে বুকে টেনে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “তোমার দান আমি গ্রহণ করলাম; এখন থেকে তুমি আমার গোমস্তা হলে। ভোগসুখী ও স্বেচ্ছাচারী রাজা না হয়ে বিশ্বাস করো, তুমি যেন এক জমিদার প্রভুর বিশ্বাসী ভৃত্য হয়ে রাজকার্য পরিচালনা করছো। এমনই রাজ্যশাসনের দায়িত্বজ্ঞান যেন তোমার থাকে।” ছত্রপতি শিবাজী মেনে নিলেন হিন্দু যোগীর সর্বাধিনায়কত্ব। সেই থেকে শিবাজীর রাজ্য পরিণত হল এক হিন্দু সন্ন্যাসীর ভাবাদর্শে-চালিত রাজ্য, এক যোগী-রাজ্য। সন্ন্যাসীর গেরুয়া-বসন দিয়েই নির্মিত হল রাজপতাকা।

২.
যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ হিন্দু-জাতি-গঠন সংক্রান্ত নানা ভাষণ ও কাজে বারবার হিন্দু সম্রাট ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে হিন্দু রক্ষীদল গঠনের আহ্বান জানান তিনি এবং হিন্দু সমাজের বিপন্নতার বিষয় তুলে ধরেন। কারণ ১৯৩৭ সালের পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে মুসলমান আধিপত্যবাদ বাঙ্গালি হিন্দুজীবনে গভীর সংকট তৈরি করেছিল। নোয়াখালিতেও তার বত্যয় ঘটলো না, গোলাম সারওয়ার ও গোফরানের নেতৃত্বে কৃষক সমিতির অন্তরালে একদল মানুষ হিন্দুদের মধ্যে ক্রমাগত আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল; তারপর যা হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। ১৯৪০ সালের ৭ ই মে নোয়াখালিতে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে হিন্দু রক্ষীদল কেমন হবে, তা বলতে গিয়ে স্বামীজি বললেন, “ছত্রপতি শিবাজী, শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের জাতি গঠনের পদ্ধতি যেমন ছিল, আমার হিন্দু-জাতি-গঠন-আন্দোলনও সেই ধারায় পরিচালিত।” স্বামীজির আশীর্বাদধন্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, যাকে ‘শিবাজীর কার্যকরীরূপ’ বলে বর্ণনা করা হয়, তিনি নোয়াখালির হিন্দুদের দুর্দশাকে মোকাবিলাকে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অগ্রাধিকার দিলেন। স্বামীজি এই যাত্রায় দক্ষযজ্ঞ ধ্বংসকারী শিবের রুদ্রমূর্তি সঙ্গে নিয়েছিলেন আর সঙ্গে নিয়েছিলেন বাছাই করা বীরদের। “আমি কোনো কাপুরুষকে আমার সঙ্গে নেবো না, মাথা দিতে পারে, মাথা নিতে পারে — এমন লোক আমার সঙ্গে চলুক।” ত্রিশূল হস্তে আচার্য দেব মঞ্চে সর্বদা সমাসীন থাকতেন, পরীধানে পীতোজ্জ্বল কৌষেয় বসন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মূর্তিতে শিবাজীর পথে হিন্দুজাতি গঠন ও ধর্মরক্ষার বাণী। তাঁর সাফ কথা, “হিন্দু শির দিয়েছে, কিন্তু সার দেয় নাই।” আগের দিন ৬ ই মে পূর্ববঙ্গের বাবুরহাট সম্মেলনেও বললেন, “আজ প্রত্যেক হিন্দুকে রাণাপ্রতাপের মত, ছত্রপতি শিবাজীর মত, শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের ন্যায় স্বধর্ম ও স্বসমাজের রক্ষার ব্রত ও দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক জাতি-গঠন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে।” বাঙ্গালি হিন্দুর শিরায় শিরায় দুর্জয় বীর্যসঞ্চারের জন্য হৃদয়ে দুর্দম সঙ্কল্প প্রবাহের জন্য ১৩ ই মে কুমিল্লার হিন্দু সম্মেলনে স্বামীজি আবার শিবাজী-স্মরণ করলেন, “শিবাজী ও গুরুগোবিন্দ সিংহ যে পন্থায় যথাক্রমে মারাঠী ও শিখ জাতিকে মহাজীবন দান করেছিলেন, আমি বাঙ্গলায় সেই সংগঠন-পদ্ধতিক্রমে পরাক্রমশালী হিন্দু-সংহতি গঠনে বদ্ধপরিকর। এই আত্মরক্ষা ও আত্মগঠন প্রচেষ্টাকে যথেষ্ট প্রবল করে তুলতে পারলে হিন্দুসমাজের যাবতীয় তুচ্ছ ভেদ-বিবাদ ঘৃণা-বিদ্বেষ বিদূরিত হয়ে যাবে।”
এরপর দেখা যায় যুগাচার্য হিন্দুদের পাশে সতত অবস্থান করবার এক প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দু নেতার সন্ধানে রত হলেন, যার মধ্যে শিবাজীর মতো অকুতোভয় শক্তি সঞ্চারিত আছে। অবশেষে ১৯৪০ সালের ২৬ শে আগষ্ট জন্মাষ্টমীর দিন আপন মাল্যে বরণ করে নিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে, নিজের সামূহিক-শক্তি সঞ্চারিত করে দিলেন, বাঙ্গালির জন্য এক শিবাজী-প্রতিম নেতা নির্বাচন করে গেলেন। ওই বৎসরই শৈবপীঠ বারাণসীতে দুর্গাষ্টমীর দিন শ্যামাপ্রসাদকে রুদ্ধদ্বারে ডেকে নিয়ে জাগালেন তার মধ্যে থাকা যাবতীয় উদ্যম ও নৈপুণ্য। প্রণবানন্দ-জীবনীকার স্বামী বেদানন্দ ‘শ্রীশ্রী যুগাচার্য জীবন চরিত’ গ্রন্থে খোলাখুলি লিখেছেন, “নিরপেক্ষভাবে বিচার করিলে শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টা ও সাফল্য মেবারের মহারাণা প্রতাপ অথবা মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজীর কীর্তির সহিত তুলনীয়।…. আচার্যের আশীর্বাদ শক্তিসমৃদ্ধ-শ্যামাপ্রসাদের অন্তরে সুপ্ত সিংহ গর্জন করিয়া উঠিল। বাংলার তথা সমগ্র ভারতের নেতাদের বিরুদ্ধে তিনি একক মহাবিক্রমে অভ্যুত্থান করিলেন। পাকিস্তান-রাক্ষসের কবলে সমগ্র বাংলাকে উৎসর্গ করিবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া বাংলার এক-তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গ ছিনাইয়া আনিয়া বাঙালি হিন্দুর দাঁড়াইবার স্থান ও অস্তিত্ব রক্ষার উপায় করিয়া দিলেন।…বাংলার বীর সন্তান শ্যামাপ্রসাদের জীবন-মাধ্যমে এইরূপে আচার্যের বাংলা ও বাঙালি জাতির রক্ষার সঙ্কল্প রূপায়িত হইয়াছিল।”

৩.
স্বামী প্রণবানন্দজীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ‘মহামৃত্যু কি?’ (What is Real Death?) তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘আত্ম-বিস্মৃতি’ (Forgetfulness of the ‘self’)। নিজেকে ভুলে যাওয়া, নিজের পূর্ব ইতিহাস ভুলে যাওয়া; নিজের পরিবার, গোষ্ঠী, ধর্মের প্রতি নেমে আসা অসংখ্য আক্রমণের ধারাবাহিকতা ভুলে যাওয়ার নামই হল ‘আত্ম-বিস্মৃতি’। বাঙালি হিন্দু এক চরম আত্ম-বিস্মৃত জাত। তারা সহজেই তার উপর নেমে আসা প্রভূত-প্রহার ভুলে যায়; অপরিমিত অন্যায়-অত্যাচার বিস্মৃত হয়। ভুলে যায় বলেই তাদের ক্রমাগত পালিয়ে বাঁচতে হয় ‘পূর্ব থেকে পশ্চিমে’, আরও পশ্চিমে৷ দৌড় দৌড় দৌড়! জীবন হাতে করে পাশবিক পঙ্কিল পরিবেশে বাঁধা মুক্তির দৌড়! জলছবিটির মতো গ্রাম ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনের সন্ধানে নিজের ধর্ম নিয়ে দৌড়! মা-বোন-বউ-মেয়েকে মাংস-হাতড়ানো ভয়ঙ্কর পশুর মুখে ফেলে রেখেই নিজের জীবন বাঁচানোর দৌড়! এই আত্মবিস্মৃতি থেকে বাঙালি তখনই রেহাই পাবে, যখন যাবতীয় জীবনের জিঘাংসার সালতামামি ভুলতে দেবে না! সম্প্রীতির আলিঙ্গন নিয়ে বাস করেও প্রতিবেশীর আক্রমণের সহিংসতার ইতিহাস মনে রাখবে! বাঙালি হিন্দু টিঁকে থাকবে কিনা, তার পরীক্ষা তখনই শুরু হবে।
এখন এই জোর-জবরদস্তির জীবন থেকে মুক্তির পথ কোথায়? পলায়নপর হিন্দু বাঙালির মুক্তি ও শেষ গন্তব্য কোথায়? সে কী তার আপন ধর্ম-সংস্কৃতি বজায় রেখে, সন্তান-সন্ততি নিয়ে নিরুপদ্রবে বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে না? পারবে। হিন্দুকে বেঁচে থাকতে হলে সংগঠিত হয়েই থাকতে হবে, প্রায় একশো বছর আগেই বলে গিয়েছিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা, হিন্দুরক্ষী স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। বলেছিলেন “সঙ্ঘশক্তি কলিযুগে”। তিনি সঙ্ঘশক্তি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, কারণ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিশাল জাতিকে এক ধর্মসূত্রে গেঁথে নেবার প্রয়োজন আছে। তিনি হিন্দুকে মহামিলনে সম্মিলিত করাকে সেবা আখ্যা দিয়েছিলেন। হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য উত্তরাধিকার। এই কাজে বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিদ্বজ্জনের অংশগ্রহণ জরুরি, জরুরি ছাত্র ও যুবশক্তির অংশগ্রহণ, মাতৃশক্তির মহাজাগরণ। এরজন্য প্রত্যেকের মানসিক শক্তি চাই। শরীর সবল ও সুস্থ থাকলেই মানুষ মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। মানুষ ভয় পেলে আর শক্তিহীন হলে তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি শুনিয়ে যায়। পেশীতে শক্তি না থাকলে সে অমেরুদণ্ডীর মতো আচরণ করে। তখন দু’-চারশো মানুষের জনশক্তিতে ভরপুর গ্রামেও আট দশজন হিংস্র মানুষের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে না। মনে রাখতে হবে হিন্দু বাঙালির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এক দুষ্ট শক্তি, তাতে বাইরের দেশের বৃহত্তর মদত আছে। সেই পশুশক্তি প্রতিবেশীর রূপ ধারণ করে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে এবং তারা ঐতিহাসিক কারণেই শক্তিমান। স্বামী প্রণবানন্দজীর মতে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা তখনই সম্ভব হবে, যখন উভয়েই শক্তিশালী ও মত প্রকাশে বলিষ্ঠ হবে।

কল্যাণ গৌতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.