বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ দেবী চৌধুরানী ‘ উপন্যাসে রয়েছে লাঠির গরিমার কথা।

বাঙালি হিন্দু যুবক লাঠিখেলায় ফের পালোয়ান হয়ে উঠুক। এটি কেবল একটি খেলা নয়, এটি জীবনচর্যার অপরিহার্য অঙ্গ। লাঠি খেলায় যে দক্ষ, তার মানসিক জোরও ছিল অসম্ভব। সব বাড়িতেই সকলের ব্যবহারোপযোগী লাঠি যত্ন সহকারে রাখা থাকতো। বন্য জন্তু তাড়ানোই হোক অথবা হিংস্র মানুষের আক্রমণ ঠেকানো — লাঠিই ছিল বাঙালির একটি সহজলভ্য অস্ত্র। লাঠি দিয়ে ধাতব অস্ত্রের মোকাবিলা করতেও জানতো বাঙালি। আজ বাঙালি খেলতে ভুলে গেছে, বাঙালি শরীরচর্চার অভাবে ভীতু-পলায়নপর এক জাতি। সে কেবলই পুব থেকে পশ্চিমে পালায়, সে সীমান্ত ছেড়ে শহরে দৌড়ায়, সে গৃহের নিরাপদে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু তা কত দিন? নিজের বাপ-ঠাকুরদাদার জমি আগলাতে অপারগ বাঙালি হিন্দু। এমতাবস্থায় দিকে দিকে লাঠি খেলা তার মনোবল বাড়িয়ে দিক। নানানভাবে শারীরিক সুস্থতা ও যোগ্যতা অর্জন করুন বাঙালি। দিকে দিকে ব্যায়ামাগার, কুস্তির আখড়া নির্মাণ করুক বাঙালি। ভেজানো ছোলা আর রকমারি দেশীয় ফল হোক বাঙালির পরিপুষ্টির উৎস। কোদাল চালিয়ে গাঁয়ের ধারে হারিয়ে যাওয়া ফলের গাছ লাগাক সে, আর তৈরি করুক নিজের ব্যবহারের পাকাপোক্ত লাঠি। দুর্বলকে বাঁচাতে প্রয়োজন মতো লাঠৌষধ জরুরী হয়ে পড়ে৷ বাঙালি হিন্দু নারীও যেন শারীরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে না থাকে। শক্তিহীন বাঙালিকে চান নি স্বামী বিবেকানন্দও। গুরুসদয় দত্ত একসময় ব্রতচারী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লাঠিখেলার প্রচলন চেয়েছিলেন। আবার হোক লাঠিখেলা। ভীতু মানুষকে কেউ সমীহ করে না।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দেবীচৌধুরাণী উপন্যাসে বাঙালি-লাঠির গরিমার কথা বলেছেন, তা যেন বাঙালি হিন্দু আবার স্মরণ করেন, পুনরায় অনুশীলন করেন, “দেবী সন্ন্যাসিনী হউক আর নাই হউক, তাহার আজ্ঞাধীন হাজার যোদ্ধা আছে, সাহেবেরা জানিতেন।এই যোদ্ধাদিগের নাম “বরকন্দাজ”। অনেক সময়ে কোম্পানীর সিপাহাদিগকে এই বরকন্দাজদিগের লাঠির চোটে পলাইতে হইয়াছিল, এইরূপ প্রবাদ। হায় লাঠি! তোমার দিন গিয়াছে! তুমি ছার বাঁশের বংশ বটে, কিন্তু শিক্ষিত হস্তে পড়িলে তুমি না পারিতে, এমন কাজ নাই । তুমি কত তরবারি দুই টুকরা করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ, কত ঢাল খাড়া খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিয়াছ—হায়! বন্দুক আর সঙ্গীন তোমার প্রহারে যোদ্ধার হাত হইতে খসিয়া পড়িয়াছে। যোদ্ধা ভাঙ্গা হাত লইয়া পলাইয়াছে। লাঠি! তুমি বাঙ্গালায় আব্রু পর্দা রাখিতে, মান রাখিতে, ধান রাখিতে, ধন রাখিতে, জন রাখিতে, সবার মন রাখিতে। মুসলমান তোমার ভয়ে ত্রস্ত ছিল, ডাকাইত তোমার জ্বালায় ব্যস্ত ছিল, নীলকর তোমার ভয়ে নিরস্ত ছিল । তুমি তখনকার পীনাল কোড ছিলে—তুমি পীনাল কোডের মত ছষ্টের দমন করিতে, পীনাল কোডের মত শিষ্টেরও দমন করিতে এবং পীনাল কোডের মত রামের অপরাধে শু্যামের মাথা ভাঙ্গিতে । তবে পীনাল কোডের উপর তোমার এই সর্দারি ছিল যে, তোমার উপর আপীল চলিত না । হায়! এখন তোমার সে মহিমা গিয়াছে। পীনাল কোড তোমাকে তাড়াইয়া তোমার আসন গ্রহণ করিয়াছে —সমাজ-শাসন-ভার তোমার হাত হইতে তার হাতে গিয়াছে। তুমি, লাঠি! আর লাঠি নও বংশখণ্ড মাত্র। ছড়িৎ প্রাপ্ত হইয়া শৃগাল-কুকুর-ভীত বাবুর্গের হাতে শোভা কর; কুক্কুর ডাকিলেই সে ননীর হাতগুলি হইতে খসিয়া পড়। তোমার সে মহিমা আর নাই ।”

কচ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.