কার্তিক অমাবস্যা সহ কয়েকটি দিনে বাংলায় গো-পালনের দীক্ষা, বাঁদনা-পরব।

গ্রাম-বাংলার খবর যারা রাখেন, তারা জানেন, গো-সম্পদকে কীভাবে দেখেছেন বাংলার মানুষ, বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গে। গোরুকে যে কেবল প্রহার করার নয়, কেবল কেটে খাবার পশু নয়; পুষ্টিকর দুধ, গোবর-গোমূত্র সার, জ্বালানি-ঘুঁটে পাবার পরও যে গো-আধারিত কৃষি বাংলার মূল্যবান সম্পত্তি, তা স্মরণ-মনন করার দিন হল মানভূমের ‘বাঁদনা পরব’, জঙ্গল মহলের ‘সোহরী’, ওঁরাও-মুণ্ডা-বিরহোর-কোরোয়া-অসুর সম্প্রদায়ের ‘সোহরাই’ উৎসব। এদিন গোরুর শিং-এ তেল-সিঁদূর মাখানো হবে, মাথায় পরানো হবে ধানের মুকুট, গ্রামীণ জীবনের এই নিত্যসঙ্গীর পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হবে, অলক্ষ্যে অনুভূত হবে গো-পালনের দীক্ষা। কৃষি প্রধান দেশে গো-পালন ছাড়া যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ শহুরে বুদ্ধিজীবী ও পরিকল্পনা-বিদের চাইতেও বেশি বোঝেন বাংলার সনাতনী লোক-সমাজ।
“জাগ মা ভগবতী / জাগ মা লছমনি
জাগে ত অমাবইসা রাতিরে
জাগে কা আশিস দেবে/ মা গ ভগবতী
পাঁচ পুতা দশ ধেনু গাই।”

পাঁচ পুত্রের ভরণপোষণ সম্ভব দশটি গাভী পালন করে এবং গো-আধারিত কৃষিকাজ করে। আজ গ্রাম বাংলায় কৃষক পরিবারের মেয়েরা গো-পালনের মতো পরিশ্রম করতে চান না, সন্ধ্যা হলেই ওই বোকা-বাক্সের সামনে সপরিবারে সিরিয়ালগুলির মনস্তত্ত্বকে গিলেকুটে খেতে চান। তার স্বামী-পুত্রের পরিশ্রম-জনিত ক্ষয়ের বিপ্রতীপে পুষ্টিকর আহার দুধের যোগানে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাতে চান না। দেশে দুধের চাহিদা মেটে না, তাই ‘দুধ’ বলে যে সামগ্রী খাই, তা অধিকাংশ সময় আদৌ ‘দুধ’ পদবাচ্য নয়। গোবর-গোমূত্রের চাহিদা মেটে না বলেই রাসায়নিক সারের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে, আর বাড়ছে দূষণ। বাড়ির সকলে মিলে শ্রমদান করে গো-পালন করলে, তাদের আয় ও পুষ্টি কেবল বাড়ত না, মজবুত হতো ভারতের অর্থনীতি। অথচ এসব কথা বলার লোক নেই। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় গো-সম্পদ যা কিছুটা আছে, তাও কেটে খাওয়ার জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে।

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “ধান-ধন বড় ধন/আর ধন গাই/সোনা-রূপা কিছু কিছু /আর সব ছাই।” যারা গোরু-মোষের দুধ বেচে, তাদের শক্তিকে কৃষিতে কাজে লাগায়, বর্জ্য পদার্থকে জমি-জিরেতের পুষ্টি যোগাতে ব্যবহার করে, তারা/শুধু তারাই জানে গো-সম্পদের কী গূঢ় মানে! তারাই কার্তিক অমাবস্যায় গোরুকে পরিবারের অঙ্গীভূত করতে গো-বন্দনা করে, গবাদিপশুর আনন্দ অভিষেক ঘটায়, মাদলের তালে তালে গোরু-জাগানোর গান গায়। সারা বছর, আউশ-আমন কেন্দ্রিক কৃষিতে কৃষকের সঙ্গে গোরুও তাল মিলিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছে; জমি-চাষ করেছে, ফসল কাটার পর বাড়িতে এনেছে, ফসল মাড়াই করেছে, আরও কত কী! কালীপুজোর ক’টা দিন তাদের ছুটি। এই অন্ধকারেই দীপাবলির আলো জ্বালানোর উৎসব, এই অন্ধকারেই এক অবলা জীবের জন্য আলোর বাতির সঙ্গেই পুলক-পূর্ণিমার আয়োজন, thanks giving ceremony, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো।

গোরুর কাছ থেকে যে দান নিয়েছি, তার সেবা পেয়েছি, তারই ধন্যবাদাত্মক চিন্তন বাঁদনা পরব। উৎসবের আয়োজনে গোরু হয়ে ওঠেন ‘ভগবতী’। এ সংস্কৃতি চিরকালই ভারতবর্ষে ছিল। কাজেই ‘গো-মাতা’ কনসেপ্ট ভারতের শিকড়-সংস্কৃতি। ‘চাড্ডিদের সংস্কৃতি’ বলে তা লঘু করা চলে না। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে এই গ্রামীণ উৎসব, তিন-চারদিন চলবে।

কল্যাণ গৌতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.