প্রথম পর্ব
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতো’স্য জগন্ময়ে ।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।
মহামোহা চ ভবতি মহাদেবী মহেশ্বরী।।
প্রকৃতিস্ত্বং চ সর্বস্ব গুণাত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহারাত্রিশ্চ দারূণা ।।
তুমি ধারণ করে আছ বিশ্বকে, তুমি-ই জগৎ সৃষ্টি করেছ।
তুমি পালন কর সকলকে, সকলের অন্তিমেও তুমি-ই আছ।।
সৃষ্টিরূপে তুমি ব্যপ্ত চরাচরে, এবং পালনে তুমি স্থিতিরূপা।
আবার হে জগন্ময়ী, অন্তিম কালে তুমি-ই দাও সব শেষ করে।।
মহাবিদ্যা তুমি, মহামায়া, মহামেধা, তুমি মহাস্মৃতি।
তুমি-ই সেই মহামোহ, তুমি-ই মহাদেবী, তুমি মহেশ্বরী।।
তুমি-ই প্রকৃতি (আদি শক্তি), তুমি-ই সর্বস্ব, তুমি-ই এনেছ (সেই) তিন গুণ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)।
তুমি কালরাত্রি (সময়ের নিয়ম অনুসারে ধ্বংসের রাত), মহারাত্রি (সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়ার রাত), মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার নিদারুণ রাত্রি ও তুমি।।
রোগ-শোক , জরা ব্যাধি প্রভৃতি সর্বপ্রকার জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্গতি থেকে তিনি জগতকে এবং সৃষ্টিকে এবং তাঁর সন্তানকে রক্ষা করেন তিনিই আমাদের চির আরাধ্যা ভগবতী দুর্গা। তাঁর বরাভয় সমস্ত অমঙ্গল দূর হয়। দূর হয়ে যায় ভয়, তাই তিনি সর্বমঙ্গলা অভয়া। দুর্গম সংসারে বন্ধুর পথের যাত্রী , ক্ষুধিত সন্তানের মুখে পরম আদরে যত্নে অন্ন জোগান যে দেবী তিনি অন্নদা । জীবনযুদ্ধে নিয়ত ব্যপৃত, ক্লান্ত, ক্লিষ্ট মানুষ দেবীর চরণ স্মরণ করে নিশ্চিন্ত হতে চায় । মায়ের চরণে আপন কামনা বাসনা, শ্রদ্ধা-ভক্তি অর্পণ করে।
তাই আমরা প্রার্থনা করি –
আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে |
পুত্রান্ দেহি ধনং দেহি সর্ব্বান্ কামাশ্চ দেহি মে ||
হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম্ |
হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে ||
এষ সচন্দন-পুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ নমঃ দক্ষযঞ্জ বিনাশিন্যে
মহাঘোরায়ৈ যোগিনী কোটিপরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ ||
সংগ্রামে বিজয়ং দেহি ধনং দেহি সদা গৃহে | ধ
র্ম্মার্থকামসম্পত্তিং দেহি দেবী নমোস্তু তে ||
দুর্গা পূজা আমরা #ছৌ_নাচ ছাড়া ভাবতেই পারি না। শৈশবে দূরদর্শনে মহিষাসুর বধ নিয়ে নানা ছৌ নাচের অনুষ্ঠান দেখতাম। বাড়ির সাদা কালো ঢাউস টিভির এন্টেনার তার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভির চ্যানেল ধরতে হতো। তারপর মহালয়ার সকালে আকাশবাণী কলকাতায় সরস্বতীর বরপুত্র শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আবেগময় কন্ঠে চণ্ডী পাঠ সমাপ্ত হলে দূরদর্শনে মহিষাসুরমর্দিনী । সাদা কালো টিভিটায় আমি হুমড়ি খেয়ে সেই অনুষ্ঠানটা দেখতাম। দেখতাম মা দুর্গা কেমন করে অবির্ভূতা হয়ে অশুভ শক্তি নাশ করছে। তখন মা দুর্গা হতেন সংযুক্তা বসু। তাঁকে আমার সত্যিকারের দুর্গা মনে হতো। জীবনে ওনাকে ব্যতীত দেবীর ভূমিকায় কাউকেই আর দেখতে ইচ্ছে করেনি , এখনো করে না। তারপর সারাদিন ব্যাপী দুর্গা পূজা সংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠান হতো। সেসব অনুষ্ঠানে ছৌ নাচে মহিষাসুরমর্দিনী পালার একটি বিশেষ ভূমিকা থাকত। সাদাকালো টিভির পর্দায় সেই বিশাল মুখোশ গুলোকে লাফাতে দেখে ভারী অবাক হতাম। মনে মনে ভাবতাম এত ভারী মুখোশ গুলো কেমনে নড়াচড়া করে ? নিঃশ্বাস নেয় কি করে ? এদের সামনে কবে দেখব?
আমার সব প্রশ্নের অবসান করে তারপর একদিন শরতের সোনা ঝরা রোদ্দুরে, শেফালী ফুলের নাচের মধ্যে দিয়ে, শিউলির গন্ধ আর পদ্ম বিলের মধ্যে দিয়ে কাকা আমাকে নিয়ে পুরুলিয়া গেলেন। সেখানে প্রথম আমি ছৌ নাচে মহিষাসুর বধ পালা দেখেছিলাম। খুব অবাক হয়ে, হাঁ করে বসে দেখেছিলাম।
হ্যাঁ, মানভূম , পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হল ছৌ নাচ । এই ছৌ নাচে যে সমস্ত পালা কাহিনী পরিবেশিত হয়ে থাকি তা সম্পূর্ণভাবে পুরান আশ্রিত ।পুরাণ আশ্রিত কাহিনীর চরিত্রগুলো সাধারণভাবে পৌরাণিক হয়, যদিও তাঁদের গাত্রে লৌকিক ছাপ কখনো কখনো প্রকট এবং অধিকাংশ সময় প্রচ্ছন্ন ভাবে লক্ষ্য করা যায়। ছৌ নাচে মা দুর্গা একটি বিশেষ স্থান জুড়ে অবস্থান করছেন ।
পূর্বকালে এতদঞ্চলে যেমন বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবমার্গীয়দের প্রভাবাধিক্য ছিল তেমনই শক্তিসাধক সম্প্রদায়ের প্রভাবও বড় কম ছিল না । তাঁরাও কালীকীর্তনে ধর্মজগৎ কম্পিত করে সিংহের ন্যায় ধরায় বিচরণ করত। শাক্ত মহাত্মাগনের নাম এবং সাধন স্থানে বহু নিদর্শন সিদ্ধপীঠ , উপপীঠ নাম ধারণ করে আজও বিরাজ করছে ।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ মার্গের বজ্রযান শাখাও তন্ত্রভাবাপন্ন হয়ে পড়ে । ওই সমস্ত বৌদ্ধ তান্ত্রিকগণ রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পশ্চিমাঞ্চলে, মলুটি, তারাপীঠ, ভাবুক ইত্যাদি স্থানে তাদের তন্ত্র সাধনা চালিয়ে যান ।
অতীতে রাঢ় অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্ত অরণ্যময় । সেই অঞ্চলটি নানা সাধক, তান্ত্রিক এবং পরবর্তী কালে বৌদ্ধদের প্রভাবাধীন ছিল । জঙ্গলের মধ্যে তান্ত্রিকগন ছোট ছোট মন্দির তৈরি করে তার ভিতর তাদের উপাস্য দেবীকে স্থাপন করে গোপনে সাধন ভজন করত। বহু গ্রামেই এই সকল দেব দেবীর প্রস্তর প্রতিমা দেখতে পাওয়া যায় ।
ঐতিহাসিক বিনয়তোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন ” বজ্রযানী বৌদ্ধদের প্রভাব বাংলা বিহার উড়িষ্যায় যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এই সব জায়গায় বৌদ্ধদের দেবদেবীর মূর্তি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। “
ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্টদেব সাধন ক্রিয়ার জন্য কামরূপে পাড়ি দেন কিন্তু কামরূপের সাধনার মার্গফল করা সম্ভব নয় দেখে তিনি অঙ্গদেশ ত্যাগ করেন। এরপর তিনি সাধন পদ্ধতির জন্য রাঢ় বাংলায় পাড়ি দেন। রাঢ়দেশে অন্তর্গত বক্রেশ্বরের ঈশান কোন অবস্থিত দ্বারকা নদীর পূর্ব তীরে শ্মশানে প্রতিষ্ঠিত এক পঞ্চমুন্ডির আসনে তিনি গভীর তপস্যায় বসেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি দেবী উগ্রতাঁরার মাতৃরূপ দর্শন করেন। পরে একই আসনে সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামাক্ষ্যাপা । সেই সিদ্ধস্থানই তারাপীঠ এবং কিরীটেশ্বরী নামে সুপরিচিত।
আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন রাঢ়ে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে। রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম।
রাঢ় দেশ একসময় শৈব এবং শাক্ত গণের লীলাস্থান বলে গণ্য ছিল। তার কারণ ৫১ পীঠের মধ্যে এই রাঢ় বঙ্গেই ৯ টি ডাকর্ণব পীঠ অবস্থিত। কুঞ্জিকাতন্ত্রের ৭ ম পটলে কর্ণসুবর্ণ বা কর্ণস্বর্ণ ,ক্ষীরগ্রাম , বৈদ্যনাথ , বিল্বক , কিরীট , অশ্বপ্রদ বা অশ্বতীর্থ , মঙ্গলকোট ও অট্টহাস এই আটটি সুপ্রাচীন সিদ্ধপীঠের উল্লেখ আছে।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে বহুলা, উজাণী, ক্ষীরখণ্ড , কিরীট, নলহাটী , বক্রেশ্বর , অট্টহাস, মন্দিপুর এই ৯ টিকে মহাপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিব চরিত সংগ্রহ গ্রন্থে অট্টহাস, নলহাটী ও মন্দিপুর উপপীঠ বলে গণ্য হয় এবং সুগন্ধা , রণখণ্ড ও বক্রনাথ মহাপীঠ বলে গণ্য হয়। যা হোক এসব ক্ষেত্রে কুঞ্জিকাতন্ত্রকেই প্রামাণ্য হিসাবে ধরা হয়।
অজয়- কুনুর তীরবর্তী উজানি মঙ্গলকোটের #চন্ডী_সংস্কৃতি_ও_তন্ত্র_মার্গের প্রবাহ সমগ্র রাঢ় বঙ্গকে প্রভাবিত করেছিল । কেতু রাজবংশের রাজধানী #বহুলানগর তথা আজকের কেতুগ্রামের সতীর যুগ্ম পীঠ যথা – বহুলাক্ষী ও ফুল্লরা শাক্তধর্মের এক বিরল তীর্থস্থান ।কাটোয়ার শাঁখাই ঘাট থেকে দাঁইহাট ভাউসিং পর্যন্ত ভাগীরথীর পশ্চিম তীর বরাবর প্রসারিত ইন্দ্র, ইন্দ্রেশ্বর ও ইন্দ্রানীকে নিয়ে একদা গড়ে উঠেছিল এক সর্বভারতীয় তীর্থনগরী #ইন্দ্রানী…এর প্রাণকেন্দ্র ছিল বর্তমান বিকিহাট, বেড়া ও দাঁইহাট।
আরো কত শত শাক্তস্থান আছে, তা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তার উল্লেখ সম্ভব নয় । এইরূপ যে সকল শৈব কীর্তি আছে তন্মধ্যে বৈদ্যনাথ এবং বক্রেশ্বর সর্ব প্রাচীন ও প্রধান।
তাছাড়াও এস্থলে বিষ্ণু উপাসকের আধিক্যও স্বল্প ছিল না। রাময়েত , নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এখানেই মহাপ্রভুর সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে মহাকবি জয়দেবের কথা , কদমখন্ডি র ঘাটের কথা , কেন্দুবিল্ব গাঁয়ের কথা….. কত শত কিংবদন্তি!
পৌষের সংক্রান্তি কাল তীব্র শীত রাত!
অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে আছে ঘরের কোনায়-
সাধক কবির চোখে নেমে আসে
আকুতির জল..
এবার তার মন্দভাগ্যে গঙ্গা স্নান নেই।
ভক্ত প্রাণ কেঁদে ওঠে , অন্ধকার শুক্লপক্ষ চাঁদ…
পরদিন ভোরবেলা অবাক বিস্ময়ে দেখে
কেন্দুবিল্ব গ্রামের মানুষ
অজয়ের কানায় কানায়
সাদা জলে মিশে আছে ভাগীরথীর গেরওয়ার রং!
এই শক্তি ও শৈব এবং প্রকৃতির উপাসনার বহু বহু পরে এখানে জৈন মতের প্রবেশ। মহাবীর স্বামীর অবস্থানের হেতু এই স্থান জৈন মার্গীয় সম্প্রদায়ের নিকট রাঢ় দেশ তথা বর্দ্ধমান পুণ্যভূমি রূপে বিবেচিত হয়।
চৈতন্য মতাবলম্বী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ই যে কেবল কাটোয়া ও তৎপরবর্তী স্থানসমূহের প্রতিভা গৌরবান্বিত করেছিল তা নহে। তার সঙ্গে একধারে ইন্দ্র, শৈব এবং শাক্তগনের কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। বর্তমান যুগে অনেক ব্যক্তি ধর্মমার্গ পরিভ্রষ্ট ও নাস্তিকভাবগ্রস্থ দেখা যায়। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ধারণা আদৌ ছিল না। ধর্মের যথার্থতা উপলব্ধি করে সেই নিগুঢ় রসাস্বাদনে সকলেই মাতোয়ারা হয়ে থাকতেন। পরিবর্তনশীল কালের অখন্ডনীয় প্রভাবে যেন সে ভাব বিলীন হয়ে গিয়েছে।হায়! সেই পাপ হরণকারী শান্তি যেন ভ্রান্তি বিজড়িত মানবকূলকে পরিত্যাগ করেছেন।
যাহোক , পূর্বকালে এতদঞ্চলে যেমন বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবমার্গীয়দের প্রভাবাধিক্য ছিল তেমনই শক্তিসাধক সম্প্রদায়ের প্রভাবও বড় কম ছিল না । তাঁরাও কালীকীর্তনে ধর্মজগৎ কম্পিত করে সিংহের ন্যায় ধরা বিচরণ করত। শাক্ত মহাত্মাগনের নাম এবং সাধন স্থানে বহু নিদর্শন সিদ্ধপীঠ , উপপীঠ নাম ধারণ করে আজও বিরাজ করছে । তারমধ্যে কাটোয়া থেকে ক্রোশকমাত্র দূরে বেড়া গ্রামের স্বনাম প্রসিদ্ধ মহাত্মা রামানন্দের কথা কাটোয়ার ইতিহাসের অঙ্গীভূত হবার উপযুক্ত ।
আর আছেন রাঢ়দেশে, ধর্ম স্বরূপ নারায়ণের কুর্ম্ম রূপ ধর্মঠাকুর।
একে শনিবার তায় ঠিক দুপুরবেলা।
সম্মুখে দন্ডাইল ধর্ম্ম গলে চন্দ্রমালা।।
গলায় চাঁপার মালা আসাবাড়ি হাথে।
ব্রাহ্মণ রূপে ধর্ম্ম দন্ডাইল পথে।।
রাঢ় বঙ্গের অন্ত্যজ দরিদ্র শ্রেণীর সাধারণ মানুষের ঠাকুর হলেন নারায়নের লৌকিক রূপ স্বরূপনারায়ণ অর্থাৎ ধর্ম্মঠাকুর। তিনি রাঢ় বঙ্গের সাধারণ মানুষের ত্রাণ কর্তা। তাঁর নিকট লাউসেনও যা কালু ডোমও তাই। ধর্মমঙ্গল তাই হয়ত রাঢ় বঙ্গের মহাকাব্য।ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতির কথা। এসব কারণেই রাঢ় বঙ্গের গাঁয়ে গাঁয়ে ধর্ম ঠাকুর নানা নামে স্বয়ং অবস্থান করেন।
সুতরাং , সমগ্র শৈব শাক্ত প্রভাবিত রাঢ় অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতে দেবী মহামায়া মহাশক্তির প্রভাব থাকবে , এটাই স্বাভাবিক। সেই বিশ্বাসের ও চিন্তার বাস্তব এবং সার্থক প্রতিফলন পড়েছে ছৌ নাচের পালাগুলিতে এবং মা দুর্গার চরিত্রে।
ছৌ নাচের পালায় পুরাণ কথাগুলি গৃহিত হলেও, একথা বলা যায় পালার কাহিনী বিন্যাসে পুরোপুরি পুরাণকে অনুসরণ করা হয় নি। লোকায়ত সমাজের জীবনধারা ধর্মীয় বিশ্বাস, রুচি , চিন্তাভাবনা ও চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছৌ নাচের পুরাণ কথাগুলি অপূর্বভাবে প্রভাবিত ও বিবর্তিত হয়েছে।
এই বির্বতনের ধারা ও পথ অতি সূক্ষ্ম এবং লোক মানসের অবচেতনার সূক্ষ্ম পথ ধরেই ক্রমশঃ অগ্রসর হয়েছে , এখনো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে , লোকশিল্পীরা কোনোদিনই কোনোভাবে পুরাণ কথা এবং চরিত্রগুলির মর্যাদা বা মূল্য কোনোভাবেই ক্ষুন্ন বা বিকৃত হয়নি। মা দুর্গা এইসব লোকশিল্পে একে বারে গ্রামের মাটির কাছে ঘরের জন হয়ে উঠেছেন। ফলে, ছৌ নাচেও মা দুর্গা এবং বিভিন্ন পৌরাণিক পালাগুলি হয়ে উঠেছে আরো আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল।
ছৌ নাচের প্রত্যেকটি দল তাঁদের নাচ শুরু করেন গনেশ বন্দনার মাধ্যমে। সূচনাকালে পালার এই প্রথম দৃশ্যকে কেউ “বন্দনা” , কেউ “পরশুরামের গুরু দর্শন” , আবার কোনো দল ” গণেশের দন্তভঙ্গ ” নামে অভিহিত করে থাকেন। যদিও গণেশের দন্তভঙ্গ প্রায় দেখানো হয় না , কিংবা কাহিনীর ও নাচের ওই পর্বেই শেষ করা হয় না।
দুর্গা চরিত্রের প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এই পালা বা দৃশ্যে। মূল পৌরাণিক কথার কাঠামো এক রেখেও , দলভেদে কাহিনীর উপস্থাপনায় স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে কাহিনীর বিন্যাসে , চরিত্রের উপস্থাপনায় স্বাতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে কাহিনীর বিন্যাসে , চরিত্রের উপস্থাপনায় এবং নৃত্য পরিচালনায় পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে মোটামুটিভাবে সর্বক্ষেত্রে দেখা যায় , নাচের চরমতম নাটকীয় উত্তেজনার পর্যায়ে দুর্গা চরিত্রের আসরে আবির্ভাব ঘটে –
পরম শিব ভক্ত কৈলাশের দেবাদিদেব আদিগুরুকে দর্শনের উদ্দেশ্যে এসেছেন। গুরু শিব ধ্যানমগ্ন। বিঘ্নহর্তা গণপতি দ্বার রক্ষা করছেন। পরশুরাম গুরুর চরণ দর্শনের অভিলাষ ব্যক্ত করে তাকে দ্বার ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানালেন। গণেশ রাজী হলেন না।অনুরোধ করলেন বারবার পরশুরাম। গণেশ তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে লাগলেন। উপেক্ষিত এবং প্রত্যাখ্যাত পরশুরাম জোরপূর্বক কৈলাশে প্রবেশ করতে চাইলেন। গণেশ পরশুরামের স্পর্ধা দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। ক্রোধে তিনি সিঁদুর বরণ রাঙা হয়ে উঠলেন। শুরু হল দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ। ভ্রাতার সঙ্গে যোগদান করলেন দেবসেনাপতি কার্তিক। এদিকে পুত্রদের বিলম্ব দেখে জননী পার্বতীর চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তিনি মহাদেবের নিকট গিয়ে বললেন –
আজি কেনে আমারি প্রাণ কাঁদে দেব ত্রিলোচন
পাছে কি বিপদে পড়েছে কার্ত্তিক গণেশ দুজন।
সন্তানের মঙ্গল কামনায় এবং অমঙ্গলের আশঙ্কায় আকুল ও আর্তি অতি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে এখানে। দেবী দুর্গা লৌকিক হয়ে উঠেও এখানে হয়েছেন অনন্যা , কারণ তিনি জগদম্বা। মাতার হৃদয় সদাই সন্তানের প্রতি অবস্থাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং তাঁদের বিপদে রক্ষার উদ্দেশ্যে রুদ্র রূপ ধারণ করেন। এমন করে তিনি জননী রূপে আমাদের ঘরে বাইরে সর্বত্র অবস্থান করেন। মহামায়ার তাড়নায় মহাকাল জাগ্রত হয়ে ওঠেন । তাই –
অতি ক্রোধে সাজেন ত্রিপুরারী হে, –
অতিক্রোধে সাজেন ত্রিপুরারী….
দলের #গায়েন ঝুমুরটি বলার সঙ্গে সঙ্গে ই শিবদুর্গা আসরে প্রবেশের মুখে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দুর্গার তখন দশভূজা মূর্তি। ওদিকে মঞ্চে তখন কার্ত্তিক ও পরশুরামের যুদ্ধ চরমে। দ্রুততালে সানাই, ঢোল ও ধামসা বাজে –
” গুড়গুড় গুড় ধা গেদা গেদা ঘেনতা
গেড়েন গেদা ঘেন, গেড়েন দা ঘেন , গেড়েন তা।
গুড় গুড় ধা , গেদা ঘেন তা” – ধ্বনিতে।
আসর মেতে ওঠে। এই সময় মা দুর্গা সিংহবাহিনী, মহিষাসুরমর্দিনী , দনুজদলনী রূপে আসরে প্রবেশ করেন। পরশুরাম মায়ের অমন রুদ্ররূপ দেখে ভীত হয়ে তাঁর শ্রীচরণে শরণ নেন। শিবও ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত। আপন আরাধ্যের দর্শন লাভ করে পরশুরামের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। তিনি শিবশক্তির নিকট তিনি ক্ষমা এবং আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি , কোনো কোনো ছৌ নাচের দল দুর্গার সঙ্গে শিবভক্ত পরশুরামের তুমুল যুদ্ধ দেখিয়ে থাকেন। সেখানে পুত্রদের উপর পরশুরামের আক্রমণে ক্রুদ্ধ মাতা দুর্গা দশভূজা রূপ ধারণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যখন উভয়ের ঘোরতর যুদ্ধে তখন ত্রিলোকে প্রলয় উপস্থিত তখন সকল দেবগণের সঙ্গে শিবের আগমন ঘটে । শিবের আগমনে উভয়েই যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন। পরশুরাম গুরু দর্শন পেয়ে প্রীত হলেন।
পরের পর্বে ছৌ নাচের মা দুর্গা ভিত্তিক আরো কিছু পালার উল্লেখ ও ব্যাখা করব।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পুরুলিয়ার ছৌ – ছো নৃত্যে দুর্গা : নিমাই ওঝা