শালগাছের কথা : শালশিরি ও শালগাছের তৈজস দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

শাল একটি বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। Dipterocarpaceae পরিবার ভূক্ত শালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Shorea robusta । এক সময় ভারতবর্ষের মোট বনভূমির এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল শালবনে আচ্ছাদিত। সুদূর অতীতকাল থেকেই এই শালবন বা তার আশেপাশে বসবাসকারী মান্দি, কোচ, বর্মণ, ডালু, হদি, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, সিং প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতিতে শাল কেন্দ্রিক আপন আচার, আপন বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।

এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।

শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।

রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে   হাটের পথিক চলে ধেয়ে,

ছোটো মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়–

সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়॥

প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত এই বিশ্বাস আর কৃত্য আচারাদির সাথে শালগাছ বা শালবনের নিবিড় যোগসূত্রতার দরুন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতিতে শালগাছ বা পুরো শালবন স্থান করে নিয়েছে পবিত্র উদ্ভিদ (Sacred Plant) বা পবিত্র স্থানের (Sacred Place) মর্যাদা। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচারাদির মধ্যেই নয় এই শালগাছ বা শালবন হয়ে উঠেছে জীবন ধারণের অন্যতম উপায় ।

সেই সুপ্রাচীন কাল হতেই অরণ্য , জল, সূর্য, বায়ু, ওষধি, ভূমি ,প্রকৃতি ও প্রকৃতির বিবিধ উপাদান মানবকুলের আরাধ্য। সনাতনে তাই প্রকৃতিই ধর্ম , ধর্মই প্রকৃতি। বনবাসী ,গুহাবাসী ত্রিকালজ্ঞ মুনি , ঋষি হতে সাধারণ তাই নানাবিধ বৃক্ষকে উপাসনা করে এসেছেন সেই প্রাচীন কাল হতে। বৃক্ষের পবিত্র, স্নিগ্ধ, শীতল ছায়ায় তাই ঋষির আশ্রম থেকে দেবতার অবস্থান যুগ হতে যুগান্তে। 

আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন  সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই  জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে।

মাতা চ যত্র দুহিতা চ ধেনূ সবদুর্ঘে ধাপয়েতে সমীচী।

ঋতস্য তে সদসীলে অন্তৰ্মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্।।

জীবনে জল, মৃত্তিকার গুরুত্ব, বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা , জলচক্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় ধারণা সকলই বেদ আমাদের প্রদান করেছেন। সুপ্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিগণ প্রকৃতির বক্ষে যেস্থানেই শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন সেখানেই তাঁকে উপাসনা করেছেন। সেই শক্তিকে সদাই সকল জীবকুলের থেকে ভীষণ এবং অপরাজেয় তা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। 

চিত্রং দেবানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য বরন্যস্যাগ্নেঃ।

আহ প্রা দ্যাবা পৃথিবী সূর্য আত্মা জাগতস্তস্থুষশচ।।

বেদে ও উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতি , মন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আর্তি ও প্রার্থনা। সাধারণ জীবসহ মানবকুলের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্ন , বাসস্থানের সংস্থান এবং শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা এগুলিই ছিল প্রাচীন কালের মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। এই প্রার্থনা ও আর্তিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ঋগ্বেদের মন্ত্রের মুনি ঋষিগণ ছিলেন প্রার্থী। তাঁর সকল জীবের মঙ্গলের জন্য অর্থাথী ছিলেন।তবে  বেদ উপনিষদের গ্রন্থ প্রকৃতির  থেকে রামায়ণ গ্রন্থপ্রকৃতি স্বতন্ত্র। রামায়নে আর্তি নেই, পরিত্রানের আবেদন নেই, রামায়ণ – মহাকাব্য …সেখানে মানবকুল জীবন প্রকৃতি পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে শিখেছেন, প্রকৃতির প্রতি বিনয় রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্ববোধের অঙ্কুরে।

সর্বভূতা সমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনিঃ।

বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল। তাই আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে।  রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ‍্য‍শৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ‍্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম। 

আদিম রাঢ় অঞ্চলের শাল পিয়ালের ভরা জঙ্গলে শাল হল ধর্মীয় বৃক্ষ । রাঢ়ের শাল সত্যের প্রতীক। তাই তারই নিচে অবস্থান করেন লৌকিক , অলৌকিক দেবতারা। শালের তলে হয় ঠাকুর দেবতার থান। সে মারাং বুরু হোক বা জাহের এঁরা অথবা  টাঁড়বারো, পিলচু হারাম ,পিলচু বুড়ি, সিং বোঙ্গা….তা সে করম পরব হোক বা বাহা উৎসব , শিকার সেঁদরা অথবা মাঃ মড়ে। সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় শালগাছের কাছে, শালগাছের নিচে, শাল ফুলে, শাল পাতায় আরাধনা করে প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী।

অকময়া চিয়ালেৎ হো বির দিশম দ।

অকয় মায় দহলেৎ অতোড়ে পাঁয়ড়ি।।

মারাংবুরুয় চিয়ালেৎ হো বির দিশম দ।

জাহের এরায় দহলেৎ আতোড়ে পাঁয়ড়ি।।

সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে বনের মাঝে , গাছের তলায়, বনের ফুলে, বনের ফলে বৃক্ষবাসিনী, পাহারবাসী দেবতার পূজা হত। সিঁদুর , শাল মাখন কি রেডি অথবা তিল সরিষার তেলের প্রদীপে আরতি হত।

পঞ্চরাত্রাগমবচন অনুযায়ী, 

     যস্যা ন প্রকৃতিঃ সেয়ং মূলপ্রকৃতিসংজ্ঞিতা॥

হে ঠাকুর , মারাংবুরু

হে জাহের মাতা,

হে রুক্মিনী, তোমরা মনতুষ্টি করে নাও।

আমার ক্ষমতা অনুযায়ী দিচ্ছি।

আবার আগামী বছরেও দেব।

এসব বৃক্ষ আমাদের যেমন খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান দেয় তেমন দেয় তৈজসপত্র, জীবিকা উপার্জনের পথ। প্রাচীন কাল থেকে পাতার তৈজসপত্র ব্যবহার চলে আসছে সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতিতে। বিয়েবাড়ি হোক বা পূজাপার্বন, অন্নপ্রাশন , উপনয়ন হোক বা যেকোনো নিয়ম অনুষ্ঠান সর্বত্র পাতার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যেত এক সময়। তার মধ্যে শাল, কলা ও পদ্মপাতা ছিল উল্লেখ্য। এমনকি হোটেল রেস্তরাঁয় ( পাইস) সেদিন অবধি শালের পাতার ব্যবহার হতো। এছাড়া ঘুগনি ,ফুচকা খেতে আপনাকে শালপাতার বটি ধরানো হতো

এই গাছের পাতার তৈজস একসময় বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ছিল। তার মধ্যে ছিল অবশ্যই শাল পাতা। এখন তো প্লাস্টিক , নকল থার্মোকলের থালা বাটি… না আছে রূপ না আছে গুন। অনেক সময় তো নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিবেশ দূষণ। তবে, বর্তমান করোনা অতিমারী পরিস্থিতিতে পুনরায় এই শালপাতা , কলাপাতার তৈজসের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। কমদামি প্লাস্টিক বা থার্মোকলের জিনিসের থাকে মানুষ বৃক্ষের দানকে পুনরায় অমৃত স্বরূপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। 

“হে বনস্পতি শাল, অবসানের অবসাদকে তুমি দূর করে দিলে। তোমার অক্লান্ত মঞ্জরীর মধ্যে উৎসবের শেষবেলাকার ঐশ্বর্য, নবীনের শেষ জয়ধ্বনি তোমার বীরকণ্ঠে। অরণ্যভূমির শেষ আনন্দিত বাণী তুমি শুনিয়ে দিলে যাবার পথের পথিককে, বললে “পুনর্দর্শনায়’। তোমার আনন্দের সাহস বিচ্ছেদের সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়াল।

     ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল,

                   মাধবী ঝরিল ভূমিতলে অবসন্ন,

          সৌরভধনে তখন তুমি হে শাল,

                   বসন্তে করো ধন্য।

          সান্ত্বনা মাগি দাঁড়ায় কুঞ্জভূমি

                   রিক্তবেলায় অঞ্চল যবে শূন্য।

          বনসভাতলে সবার ঊর্ধ্বে তুমি,

                   সব অবসানে তোমার দানের পুণ্য॥”

এই শালগাছ ও শালপাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু মানুষের জীবিকা। মূলত বীরভূম ,বাঁকুড়া, পুরুলিয়া , মেদিনীপুরের এক বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকার মা বোনদের অন্যতম জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই শালপাতা। যদিও এর সঙ্গে প্রাচীন অখন্ড সনাতনী ভারতীয় সূত্র বাঁধা। প্রাত্যহিক জীবনে শালপাতার ব্যবহারিক গুণ পর্যবেক্ষণ থেকেই তারা একে লোকজীবিকা করে তুলেছেন। 

শালপাতা ও শাল জঙ্গলের ব্যাপকতার নিমিত্ত বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ,পুরুলিয়ার নামকরণ হয়েছে। শালতোড়া , শালতোড়, শালডিহা, সাধু শালতোড়া , শালবনী প্রভৃতি।

মূলত বনবাসী সকল মেয়েরাই এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। এসব গাঁ ঘরগুলির সামনে বনজঙ্গল থাকায় পাতা সংগ্রহ করাটা তাদের কাছে সহজসাধ্য। তাছাড়া বনদপ্তর গাছ কাটতে বাঁধা দেয় পাতা সংগ্রহে নয়। বনরক্ষীদের সঙ্গে পাতা সংগ্রহকারীদের সম্পর্কও বেশ ভালো হয়।  

এই জীবিকা মেয়েদের একান্ত নিজস্ব জীবিকা। কাঁচাপাতা সংগ্রহ থেকে পাতাতৈরি সব কাজ মেয়েরা একাই করে। পুরুষদের এতে তেমন ভূমিকা থাকে না। মেয়েদের হাতে অন্যান্য শিল্পকলার মতোই পাতাসেলাই সুনিপুণ ভাবে উঠে আসে। শুধুমাত্র শালপাতা বাজারে বিক্রি করতে যাওয়ার সময় পুরুষরা কখনো কখনো সঙ্গে যায়। প্রায় সব বয়সী মেয়েরাই এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত থাকে। তবে অবিবাহিত মেয়েরা এবং নববধূরা জঙ্গলে পাতা আনতে যায় না। ৩৫ – ৫৫ বছরের নারীরাই এই কাজের উপযুক্ত। বিবাহিত মেয়েরা বাচ্চা হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হন। বাড়িতে পাতা আনার পর সমস্ত মেয়েরা একসঙ্গে বসে পাতা সেলাই করে। অবসর সময় ও অন্যান্য  কাজ করার পর তারা পাতা সেলাই করতে বসেন। 

শালপাতা তৈরির জন্য কাঁচা শালপাতা ও সরু শক্ত কাঠির প্রয়োজন হয়। থালা পাতা তৈরির জন্য যেমন তেমন শাল পাতা হলে চলবে না। কাঁচা পাতার গুনাগুণ অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে তৈরি পাতার তৈজসাদির গুণমান নির্ভর করে।  সেই জন্য  কাঁচা পাতা হবে –

১) বেশ পুরু। কচি পাতা সেলাই করার সময় নষ্ট হতে পারে।

২) আবার পাতা অধিক পুরু হলেও চলবে না। কারন শুকলে কেটে যেতে পারে।

৩) পাতা মাঝারি শক্ত হলেই ভালো হয়।

৪) পাতা হবে নিখুঁত পরিচ্ছন্ন । তার মধ্যে একটি চকচকে ভাব থাকবে।

পাতা সেলাই করার কাঠি সংগ্রহ করার ব্যাপারটিও বেশ পদ্ধতি সাপেক্ষ। নিমকাঠি ও একধরনের খাড়া ঘাস পাতা সেলাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। চাষের জমির ধারে এক ধরনের শক্ত ঘাস কেটে শুকিয়ে কাঠি তৈরি করা হয়। নিমপাতা ঝরে গেলে গাছের তলায় যে লম্বা লম্বা কাঠি পড়ে থাকে সেগুলি সংগ্রহ করে আনা হয়। কাঠি সরু এবং শক্ত হলে পাতা সেলাই করতে সুবিধা হয়। 

অরণ্যে যতদিন পাতা পাওয়া যায় , ততদিন এই জীবিকা চলে। তাই বৃক্ষ থাকা আবশ্যক।  যেদিনবন উজাড় হয় তবে এই কুটির শিল্প ও কুটির শিল্পী দুজনেই ধ্বংস হয়ে যাবে। চৈত্র বৈশাখ মাসে গাছের নতুন পাতা হয়, সেই সময় থেকে আরো দু তিনমাস জঙ্গলে কাঁচা পাতা ভালো পাওয়া যায় ।

পাতা সেলাই করার কাঠি পাওয়া যায় তার কিছু আগে। অর্থাৎ , শীত ও বসন্তের মাঝামাঝি সময়। নিমপাতা সব ঝরে গেলে কাঠি গুলি গাছের তলায় পড়ে থাকে। নিম খাড়িকে সাঁওতালরা বলে #নিমচাড়ায় , নিমখাড়ি বিশুদ্ধ।  এতে শরীরের বিশেষ উপকার হয়। তাই নিমখাড়ি পাতা সেলাইয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ। 

জঙ্গলে দুই ধরনের শালগাছ থাকে। এক ধরনের গাছ বেশ লম্বা লম্বা হয়। আর এক ধরনের গাছ ছোট ছোট ঝোপের মতো হয়।  বনবাসী মা বোনেরা ছোট ছোট গাছগুলি থেকে পাতা সংগ্রহ করেন। যেহেতু কোনো পুরুষ মানুষ তাদের সঙ্গে থাকে না তাই নিজেদের চেষ্টায় তাঁদের পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এদের মধ্যে অনেকেই গাছে চাপতে পারেন। 

বড় বড় পাতা সংগ্রহের জন্য এঁরা আঁঁকশি ব্যবহার করেন। বাঁশের সঙ্গে কাণ্ডের মতো বাঁকানো দণ্ড দিয়ে এটি তৈরি করা হয় । সাঁওতাল ভাষায় বাঁশকে বলে #মাত আর কাণ্ডের মতো দণ্ডটিকে বলে #হেসা। এই দুটিকে যুক্ত করে যে আঁকশি তৈরি করা হয় , রাঢ় অঞ্চলে একে #বানাডাঙ বলে। 

এই বানাডাঙ দিয়ে বড় বড় গাছের পাতা কেটে কেটে মাটিতে ফেলা হয় । তারপর বেছে বেছে সুন্দর  ব্যবহার যোগ্য পাতাগুলি ঝুড়িতে বা বস্তায় ভরে ঘরে নিয়ে । পাতা সংগ্রহকে সাঁওতালরা #সাকামহেড় বলে। 

পরিশ্রমী মানুষের গান হল জীবনের অঙ্গ। যাঁরা বনেবাদারে, জলে জঙ্গলে , মাঠে ঘাটে কাজ করেন তাঁদের গানই কষ্টসহিষ্ণু হবার প্রথম উপায়। তো, রাঢ় অঞ্চলে শালের জঙ্গলে পাতা তোলা থেকে , পাতা সেলাই থেকে বাজারে নিয়ে যাওয়া সবতেই তাঁরা যৌথ ভাবে গান করেন। এসব শ্রম সংগীতে শ্রম লাঘব হয় । 

বনে পাতা তোলার সময় তাঁরা গান করেন :

পাতাঞেল ছাতাঞেল

হরকো লেলেয় দাঃ গে তারাং 

দা তেতেং জালাতে অনা তেরং

বাগি কেদার ইন্দ্ দিসুম দারাম্।

অর্থাৎ, অনেক পাতা পেলে তা বিক্রি করে অনেক টাকা হয়। তারপর মেলা দেখতে যায়। সেখানে মানুষের ভিড়ে ঠেলাঠেলিতে তাদের জল তেষ্টা পায়। তখন দেশ দুনিয়া সব ভুলে যায়। 

বাড়িতে পাতা আনার পর সকলে মিলে বসে পাতা সেলাই করে। জীবনে দুঃখ তো স্বভাবিক বিষয়। কিন্তু তার মধ্যেও তাঁরা আনন্দকে খুঁজে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করেন। পাতা আনার সময় গান করেন – 

বিরবু ঞ দাবা কেদা তালা বিরইঞ 

সরজম দারে  রে  ঞমা  পিদিঞ

সুনুম অজগ সাকাম্।..

অর্থাৎ , বন পাহাড় গভীর জঙ্গল সব ঘুরলাম । শাল গাছের চকচকে পাতা পেলাম।

একদিনে তাঁরা প্রায় ২০০- ৩০০ পাতা সেলাই করেন। কেউ কেউ ১০০ – ১৫০ পাতা সেলাই করতে পারেন। সেলাই করার সময় তাঁরা গান করেন – 

বাবা বাবা পরের বাবা সারা দেয় 

আমার বাবা অভিদেশে

আমার বাবাও অভিদেশে

মেয়েটার নিজের বাবা মারা গেছেন। আজ সে বাবা বাবা করে ডাকলে পরের বাবা এসে সাড়া দেয়। আজ তার নিজের বাবা এদেশে নেই। পাতা সেলাই করার সময় পিতৃহীনা মেয়েটির চাপা বেদনার কথা বেরিয়ে এসেছে। একদিকে তাদের শ্রম লাঘব অপরদিকে মেয়েটির দুঃখ যেন সকলের দুঃখ হয়ে উঠে।

এক একটা থালা পাতা তৈরি করতে কমপক্ষে  ৫ টা পাতা লাগে । পাতা বড় হলে পাঁচটাতেই হয়ে যায় ।

ছোট পাতা হলে সাত-আটটা লাগে। পাতাগুলি খাড়ি বা কাঠি দিয়ে থালার মত করে সেলাই করা হয় । চার পাঁচটি পাতাকে  চার কোনা ছয় কোনা করে শালপাতার বাটি বানানো হয়।

 পাতা সেলাই করার পর তাকে আলাদা আলাদা করে বাড়ির উঠোনের রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। তবে দুপুরের চড়া রোদ পাতায় লাগতে দেওয়া হয় না।

 রোদ চড়া হওয়ার আগেই পাতাগুলো তুলে নেওয়া হয়। পরের দিন আবার হালকা রোদে শুকোতে দেওয়া হয় ।কড়া রোদ পেলে পাতাগুলো ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে । বেশ কয়েকদিন এইভাবে হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে একশটি করে বান্ডিল করে রাখা হয় । এরপর পাতা পাঠানো হয় মহাজনদের কাছে। সেখানে আধুনিক ডাইস মেশিন দ্বারা নানারকম থালাপাতা, বাটি তৈরি করা হয়।

এই পাতা মহাজনের কাছে দিতে যাবার সময় বা বিক্রি করতে যাবার সময় তারা গান করে –

হর হর তিন চালায়া

বাজার ঘন গিদরে লাগি

চপ পকুরি আগুয়া

স্বামী স্ত্রী পাতা বিক্রি করতে যাচ্ছে । এমন সময় স্ত্রী পিছিয়ে পড়লে তাকে তাড়াতাড়ি পা চালাতে বলে। কারন বাজার থেকে ছেলে মেয়েদের জন্য চপ পকুরি আনতে হবে। 

বাড়িতে পাতা তৈরির পর সেগুলি মহাজনদের নিকট কিংবা পাতা তৈরির কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আবার অনেক সময় হাতে তৈরি পাতাও দোকানে দোকানে বিক্রি করা হয়ে থাকে। আগে, পুরুষ মহিলা উভয়ে মিলে পাতা বিক্রি করতেন। 

পাতা বিক্রি করে ফেরার পথে গান গায় – 

বাজার বাজার ঘুরলাম গোটা বাজার ঘুরলাম

তবু কিন্তু তিষা মরে নাই

জল দে রাম জল বিনু প্রাণ বাঁচে নাই

জল দে রাম জল বিনু প্রাণ বাঁচে নাই।

অর্থাৎ , বাজারে বাজারে ঘুরে ঘুরে পাতা বিক্রি করে মেয়েটি ক্লান্ত ও অবসন্ন । তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কোথাও একটু জল পাওয়া গেল না। রামচন্দ্র তোমাকে স্মরণ করি জল জোগানের জন্য। 

আগে, যখন নারী পুরুষ উভয় মিলে গ্রামের শহরে ঘুরে ঘুরে পাতা বিক্রি করতেন,  সেখানে পুরুষেরা একটি বাঁশের বাঁকে ১০০০ থেকে ২০০০ পাতা ঝুলিয়ে নিয়ে যেতেন। মেয়েরা তাড়ি বেঁধে মাথায় করে বিক্রি করতেন।

বর্তমানে যদিও খুব একটা পাতা বিক্রি করতে যাবার দরকার হয় না। লোকেরা বাড়িতে এসেই পাতা নিয়ে যায়। 

ঋতু বিশেষে পাতার চাহিদার উপর এবং বনের কাঁচা শালপাতার বাজারদর নির্ভর করে।

যেমন – চৈত্র মাসে যখন প্রচুর পাতা পাওয়া যায় এবং প্রচুর পাতা তৈরি হয়। সেই কারণে এই সময় তৈরি পাতার দাম কম হয়। আগে তাড়ি হিসাবে পাতার বিক্রি ছিল। এক তাড়িতে ২০ টি করে পাতা থাকত। ১ তাড়ির দাম ৪০ -৫০ পয়সা হতো। 

তবে , এখন চৈত্র মাসে ১০০ পাতার দাম থাকে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। 

আবার , বছরের অন্য সময় কম পাতার দাম একটু বেশি হয়। তখন ১০০ পাতার দাম থাকে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। 

এই পাতা ডাইস মেশিনে সুন্দর করে সাইজ করার পর ব্যবসাদাররা পায় ১০০ পাতায়  ৭০ থেকে ৮০ টাকা দাম । এই জন্যই পাতা তৈরিকারীদের তুলনায় পাতা ব্যবসায়ীদের লাভ বেশি হয়।

আগে গাছে চেপে পাতা পাড়া হতো এখন আঁকশি দিয়ে টেনে পাতা সংগ্রহ করা হয়। তবে , এখনো বস্তা বোঝাই বা ঝুড়ি বোঝাই করে পাতা সংগ্রহ করা হয়। নিমখাড়ি বা কাঠিও অবিকৃত আছে। তবে আগে এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত লোকেরা তেমন কোন সরকারি সাহায্য পেত না এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে কিছু কিছু সরকারি অনুদান পায় যদিও তার পরিমাণ খুবই সামান্য।

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে একথা সুপ্রাচীন ভারতীয় রমণীদের ক্ষেত্রে সত্য। তাই , রাঢ় বঙ্গের বনবাসী  মা বোনেরা সংসারের সমস্ত কাজ করেও , অবসর সময় পাতা সেলাই করেন। সেগুলো বিক্রি করে মহাজনদের কাছ থেকে যা টাকা পান তা দিয়ে নিজেদের সংসারের অতিরিক্ত চাহিদাটুকু মেটানোর চেষ্টায় থাকেন। কখনো কখনো সেই টাকা বাড়ির পুরুষদের হাতেও তুলে দেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলে সেই টাকায়। বর্তমানে তাঁরা পাতা বিক্রি করে যা পান তা ব্যাংকে গিয়ে জমা দেন। একদিকে জীবিকার মধ্য দিয়ে তাঁরা যেমন স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন, তেমন সমাজে তাঁদের  আত্মপ্রতিষ্ঠাও ঘটেছে।

এখন অত্যাধুনিক যুগে সৌখিন দ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে।  তাই শালপাতা, কলাপাতা ,পদ্মপাতার পরিবর্তে নিম্নমানের থারমোকল ,কাগজ বা প্লাস্টিকের থালা-বাটির ব্যবহার বেড়েছে । যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এই জীবিকার উপর পড়েছে এবং তার সঙ্গে পরিবেশের উপরেও…. চিন্তাশীল শিক্ষিত সমাজ ভালোভাবে জানেন এগুলোর ব্যবহার শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর । তবুও তাঁরা এগুলোই ব্যবহার করতে চান দু পয়সা কম দাম হবে বলে । তবে এই পর্ব লেখার শুরুতেই আমি বলেছি, বর্তমান করোনা অতিমারীর প্রভাবে পুনশ্চ এই শালপাতার শিল্প ও জীবিকা নতুন দিশা দেখতে শুরু করেছে। মানুষ দেশীয় জিনিসের অমৃতের স্বাদ পুনরায় আস্বাদন করতে চাইছেন।

যেহেতু খাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই খাবারকে যে ধারণ করে তারও বিশুদ্ধতা প্রয়োজন। শালপাতার গন্ধে যে পবিত্রতা , স্নিগ্ধতা তা প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতি যেন মানুষের কাছে ধরা দেয়।  মনকে শুদ্ধ করে ।আমাদের রোগমুক্তি ঘটায়।  

শালপাতার 

প্রতিটি সেলাইয়ে 

আঙুল গুলি দেখতে পাই

প্রতিটি কাঠিরর সেলাইয়ে শব্দ খুঁজে পাই

গ্রাম খুঁজে পাই 

প্রতিটি কাঠির সেলাই উজ্জ্বল হয়ে

গোল চেহারার একটি পাতা

বুননে নাম নেই গ্রামেরও নাম নেই

গ্রাম দেখতে পাই

 এক মানুষকে দেখতে পাই

শালপাতার প্রতিটি সেলাইয়ে

যার আঙুলগুলি এলোমেলো নয়

 যার আঙুলগুলি কেঁপে উঠছে না।….

#সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্য : ১.The Golden Bough

২.Tree symbol worship in India

 ৩.The Rajbanshis of Nort Bengal

৪. Indian Folklore

 ৫. Cult of Tree Deities of Bengal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.