#দ্বিতীয়_পর্ব
পাটায় ছেঁচিয়া নেয় পোলতার পাতা।
বেগুন দিয়া রান্ধে ধনিয়া পোলতা।।
জ্বরপিত্ত আদি নাশ করার কারণ।
কাঁচা কলা দিয়া রান্ধে সুগন্ধ পাঁচন।।
জমানী পুড়িয়া ঘৃতে করিল ঘন পাক।
সাজ ঘৃত দিয়া রান্ধে গিমা তিতা শাক।।
নারিকেল দিয়া রান্ধে কুমারের শাক।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে কুমারের চাক।।
মঙ্গলকাব্য , ব্রতকথা গুলি বাঙ্গালীর দৈনন্দিন জীবনের রান্নাঘর ও খাদ্যাভ্যাসকে ধরুন সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষ্যহিসাবেই ধরে রেখেছে। গতপর্বে আমি বাঙ্গালীর রান্নাঘর নিয়ে আলোচনায় আমার ছোট বেলার স্মৃতির কথা বলছিলাম। সেখানে রান্নাপুজোর গল্প বলে শেষ করেছিলাম আজকে বাকিটুকু বলি।
বাঙ্গালীর নিকট রান্নাঘর বা পাকশালা একটা নস্টালজিক ব্যাপার ছিল। আজও বুঝি থেকে গেছে তার কিছুমিচু। সেই যে বলেছিলাম কয়লা,কাঠে , গুল এবং গোবর দিয়ে জ্বালানী হত। সেই জ্বালানী দেওয়া উনুনের আঁচ নিয়ন্ত্রণ হত কাঁই বিচি, ছোবড়া, শুকনো আমের আঁটি, কাঁটা গাছের ডাল এসব দিয়ে। আবার দেখতাম খুব জোরে আঁচ তোলার জন্য একটা ভাঙা হাত পাখা দিয়ে পিসি বা মা উনুনের মুখে হাওয়া করতেন। অনেক গ্রামের বাড়িতে উনুনের মুখে বাঁশের চোঙা দিয়ে ফুঁ দিয়ে আচঁ তুলতে দেখেছি। দেখতাম ওই কাজ করতে গিয়ে যিনি রান্না করছেন তিনি তেতে পুড়ে লাল হয়ে , চোখ দিয়ে জল পড়ছে….তবু মা অন্নপূর্ণার মতো হাঁসি মুখে রান্না করে খাবার পরিবেশন করছেন।
গ্রামাঞ্চলে চিঁড়ে , মুড়ি ভেজে যাঁরা জীবিকা অর্জন করেন ,তাঁরা এই কাজে এখনো উনুন ব্যবহার করেন। তাছাড়াও ধান সেদ্ধ করার জন্য যে উনুন তা ভিন্ন প্রকার দেখতে হয়।
সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙ্গালী তথা ভারতীয় পাকশালে একটি প্রিয় সই থাকত। কে বলুন তো ? হম , ঠিক ধরেছেন বঁটি। সবজি হোক বা মাছ , সব কিছু কেটেকুটে রান্না করতে বাঙ্গালী বঁটির ব্যবহার করে এসেছে। এই বঁটির আবার অনেক ধরন আছে। আঁশ বঁটি, নিরামিষ বঁটি আর খড় কাটার বঁটি। যাক, আঁশ বঁটি হতো পেল্লায় রকমের। মাছের বাজারে দেখে থাকবেন। আগে বাঙ্গালী বাড়িতে আস্ত টাটকা মাছ কাটার জন্য অমন একখান আঁশ বঁটি থাকতই। তারপর ছিল সংসারের ঊনকটি সত্তর লক্ষ সবজি কাটার বঁটি। সে ছোট হলেও ধার মোটেই কম ছিল না। গরুর খড় কাটার বঁটি হতো অনেকটা দা এর মতো। মা , পিসীদের কত দেখেছি বঁটির ধারে হাত কেটে গলগল করে রক্ত বেরতে। কিছুক্ষণ কষ্টে হাত নিয়ে জলে ধরতেন। মুখ চেপে কান্না লোকাতেন । তারপর হলুদ লাগিয়ে পুরোনো কাপড়ের ফালি দিয়ে বেঁধে আবার রান্নার কাজে লাগতেন। রাবণের গুষ্টি সামলানো মুখের কথা ছিল না। আঁশ বঁটিতে দশসেরি আস্ত মাছের মুড়োখানা খপ করে কেটে পড়ত। সবজি বঁটিতে মা ,পিসিরা শিল্পের মতো করে সরু সরু ভাজার আলু কাটাতেন। জীবনটা থোড় বড়ি খাঁড়া , খাঁড়া বড়ি থোড় ছিল। সেই থোড় ,মোচা , এঁচোর বঁটিতে কাটতে হাতে তেল মেখে বসতেন মা , ঠাকুমা। বঁটি বলতে মনে পড়ল , আমার একবার ছোট বেলায় বঁটিতে পড়ে ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি কেটে ঝুলে গেছিল। সে হাত সেলাই ইত্যাদি , সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার হয়েছিল।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যেও পাই বঁটির কথা। বস্তুটি ছিল রমণী জীবনের এক নিত্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র। ফুল্লরা গোধার মাংস কাটার জন্য সইয়ের বাড়ি গিয়ে বঁটি ধার চাইতে গিয়ে বলেছিলেন –
গোধিকা কারনে রামা চিন্তিত অন্তর।কিমতে কাটিমু গোধা বঁটি নাহি ঘর।।
আমাদের বাড়িতে ঠাকুরের জন্য একটা আলাদা বঁটি ছিল। তার মুখ ছিল কাঁটা কাঁটা চক্র করা। ওটাকে নারকেল কোড়া বঁটি বলা হতো। তাতে পুজোপরবে ঘষঘষ করে নারকেল কোড়া হতো।
রান্নাপুজো গিয়ে দুর্গাপুজো আসত। তখন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় ছুটির শরৎকে সারা দেহ দিয়ে অনুভব করা যেত। পুজোর পাঁচদিন আমাদের নিরামিষ রান্না হত। লুচি, কচুরি, ডালপুরি, পরোটা সঙ্গে আলুরদম বা সাদা আলুর তরকারী। বিকালে নিমকি সিঙ্গাড়া হতো। আহা, সাদা ময়দায় কালো জিরে যখন পড়ত …. ইস ভাবতেই একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হচ্ছে। সঙ্গে সুজির পান্তুয়া বানানো হত। ইয়ে , আমাদের বাড়ি এত বাইরের খাবার চল ছিল না। বাড়িতে এত লোক…সবাই মিলেই রান্না করা হতো নানা পদ। সেজ পিসির হাতের রান্না ছিল অমৃত।
উনুনে রান্নার কেমন একটা দুর্দান্ত স্বাদ হতো। সেজে পিসির হাতের শুকতো খেতে দূর দুরান্তের আত্মীয়রাও চলে আসতেন মাঝে মাঝেই। জন্মাষ্টমী , বিজয়া দশমী ও দ্বীপনিতা লক্ষ্মী পুজোয় নারকেল নাড়ু, জীবে গজা ছিল অত্যাবশ্যক দ্রব্য। জন্মাষ্টমীর বিশেষ মিষ্টি তাল বড়া…. তখন তো এত সরঞ্জাম ছিল না রান্নার, তাই রাত জেগে তাল চাঁছা হত বড় বেতের ঝুড়ি উল্টে দিয়ে। আমরা বাড়ির কচিরা সেসব দেখতাম ভারী মজার সঙ্গে।
তো, বিজয়া দশমীতে আমাদের বাড়িতে কিছু সিদ্ধি র শরবত খাওয়ার চল ছিল। মা জলে পড়লে একশো আট বার বেলপাতায় আলতা দিয়ে #শ্ৰী_দুর্গা নাম লিখে ঠাকুর ঘরে জমা করতে পারলেই রসগোল্লা, নিমকি, জিবেগজা ইত্যাদির সঙ্গে এক গেলাস দুধবাদাম সিদ্ধির শরবত জুটে যেত। সেই সিদ্ধি বাটা হত এক বিশাল হামান দিস্তায় । দুপুর থেকেই কোনো পিসি বা মা লোহার হামান দিস্তায় ঘটাং ঘটাং করে সিদ্ধি কুটতেন। সে হামান দিস্তা ঠাকুরের কাজেই ব্যবহার হতো। ঘরের জন্য আলাদা একটা পেল্লায় শিলনোড়া ছিল। সে কথায় পড়ে আসছি।
তো, পুজো গেলে আমরা তারপর দিন থেকে পরের বছরের পুজোর অপেক্ষা করতাম। আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছিল না। আমাদের কালীপুজোর রাতে দ্বীপানিতা লক্ষ্মী পুজো হতো। আগের দিন হতো চোদ্দ শাক খাওয়া ও চোদ্দ প্রদীপ জ্বালা হতো। কাকা বাজার থেকে পৃথক পৃথকভাবে ১৪ রকম শাকের আঁটি নিয়ে আসতেন। সেই শাক পিসিরা বা মা বঁটিতে কুচি কুচি করে সূক্ষ্মভাবে কাটতেন। বাপরে, সে এক শিল্প ছিল। ওরম কাটা এখন ওই ইলেট্রিক চপারে হয়। তখন মা , ঠাকুমারা হাতে করেই করতেন।
পৌষসংক্রান্তিতে আমাদের বাড়ি নবান্ন লক্ষ্মীপুজো হতো। নতুন ধান কুনকেতে রেখে তাঁকেই মা লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হতো। আগের দিন বাউনি পাতা হাতো। লক্ষ্মীর নামে চাল, ফুল,দূর্বা উৎসর্গ করে সেই নিয়ে সন্ধ্যায় ঠাকুমা সব ঘরে, রান্নাঘরে ছড়িয়ে দিতেন। এতে সংসারে অভাব হয় না। যাক , পৌষ পার্বনের দিন বাড়িতে ধুন্ধুমার হতো পিঠে বানানো হতো। মাটির খোলা আনা হতো পিঠে গড়ার। সেই খোলা সকাল থেকে জলে ভিজিয়ে রেখে রোদে শুকনো করা হতো। আগের দিন রাত থেকে ভেজানো আতপ চাল ঘটর ঘটর শব্দে শিলে বাটা হতো। উনুনে মাটির খোলা জ্বালা হতো। তার আগে সেজ পিসি স্নান করে শুদ্ধ হয়ে আসতেন। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে উনুনের নরম আঁচে খোলা বসিয়ে ঠাকুরকে নমস্কার করতেন। পিঠের খোলা ফেটে যাওয়া খারাপ মনে করা হয় এখনো বাঙ্গালী সমাজে। তাই ঠাকুরের নামে প্রথম পিঠে ছেঁক ছেঁক শব্দে খোলায় দিয়ে লক্ষ্মীর নাম করতেন। পৌষসংক্রান্তির প্রথম পিঠে অগ্নি বা উনুনকে , দ্বিতীয় পিঠে তুলসী তলায়, তৃতীয় ঘরের ঠাকুরকে এবং চতুর্থ পিঠে পুকুর পাড়ে পূর্ব পুরুষদের নামে উৎসর্গ করা হতো।
দেখতে দেখতে সরস্বতী পুজো আসত। সেতো বাড়িতে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার হতো। দূর থেকে লোকে শুনলে ভাবত বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। রাত জেগে বাবার তৈরি ঠাকুর সাজানো হতো। সরস্বতী পুজোর পরদিন হয় শীতল ষষ্ঠী। ওইদিন ঠান্ডা খাওয়া। তাই আগের দিনই আমাদের বাড়িতে #গোটাসেদ্ধ রান্না হতো। ছোট নতুন আলু, রাঙালু, ছোট বেগুন, আস্ত কড়াই শুঁটি ইত্যাদি সব বড় মাটির কড়ায় চাপিয়ে একভাবে সিদ্ধ করে নামানো হতো । পরেরদিন তাতে কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে খাওয়া হতো। ওইদিন সকালে কাঁচা হলুদ ছোপ ভেজা পরিষ্কার কাপড় শিলনোড়ায় জড়িয়ে রাখা হতো। শিলনোড়ায় সারাবছর কাজ করার পর ওইদিন তাদের ছুটি থাকত।
শিলনোড়া সেকালের বাঙ্গালী রান্নাঘরে বঁটির পরেই বা বঁটির সঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ছিল। এই শিলনোড়া সংসারে হরপার্বতীর রূপ ছিল। যে সংসারে শিলনোড়ার ক্ষয় যত কম হতো সে সংসারে সমৃদ্ধি থাকত মনে করা হতো। আমাদের বাড়িতে কেউ গুঁড়ো মশলা খেত না। শুধু আমাদের কেন , আমার চোদ্দ গুষ্টির কেউ একটা সময় অবধি গুঁড়ো মশলা কিনে খেতেন না।
তখনকার দিনে শিলনোড়া ছাড়া বাটনা বাটা ভাবাই যেতোনা। মা ,পিসিদের রান্নাঘরের কাজের মধ্যে বাটনাবাটাটা একটা কাজ ছিলো। কাটাকাটি বাটাবাটির সব ঝামেলাই তাঁরা সমালাতেন, সে সর্ষে হোক বা পোস্ত।
বাড়ীর সামনে দিয়ে মাঝে মধ্যে যেতো “শিলকাটাওয়ালা”। পিসিরা সজাগ থাকতো সে ব্যাপারে। শিল নোড়া ঠিক মতো কাটানো থাকলে মশলা বাটতে সুবিধে হতো তাদের। শিলের মধ্যে সে কতো রকমের নস্কা কাটা হতো , মাছ, ফুল , পদ্ম, লতাপাতা ….সে শিলকাটা শিল্প ছিল কি অপূর্ব। পিসিরা বা মা হলুদ, লঙ্কা, জিরে, ধনে আলাদা আলাদা করে বেটে ছোট একটা রেকাবীতে সাজিয়ে দিতো। আদা রসুন পেঁয়াজের জন্য থাকতো আলাদা আর একটা রেকাবি, তারপর শিল ধুয়ে নিয়ে বাটা হতো গরম মশলা ।রাখা হতো আলাদা বাটিতে , ঢাকা দিয়ে, যাতে গন্ধ চলে না যায়। আর হতো শীতের দিনে নানা রকম ডালের বাটা , বড়ি দেবার জন্য।
শীত এলেই মা ,ঠাকুমা বা সেজ পিসি মুসুর, বিউলি, অড়হর ইত্যাদি ডালে বাটতেন শিলে । তারপর সেই ডাল বাটা হাত দিয়ে ফটফট শব্দে ফেটিয়ে ফোলানো হতো। বাড়ির রান্না ঘরে চাল , ডাল ঝেড়ে বাছার জন্য দুটো কুলো থাকত। সেই কুলোয় পরিষ্কার কাপড় পেতে বড়ি দিয়ে সেটা ছাদের রোদে দেওয়া হতো। আমরা মানে বাড়ির কচি কাঁচাদের কাজ হতো কাক তাড়ানো।
আগে বাড়িতে ঠাকুরের জন্য আলাদা একটা হামান দিস্তা ছিল। পরে বাড়িতে এল দুটি শিলনোড়ো। একটিকে বলা হতো নিরামিষ শিলনোড়া। সেসব দিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল হুস করে। খুব ফিরতে ইচ্ছে করে এসব করোনা আর কংক্রিটের জঙ্গল থেকে সেই একতলা , বড় দাওয়া , উঠোন , আর একটা বড় মাটির রান্নাঘরওলা বাড়িটায়।
চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বৌল।
কলার মূল দিয়া রান্ধে পিপলিয়া শৌল ।।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ।
জিরামরিচে রান্ধে চিথলের কোল ।।
উপল মৎস্য আনিয়া তার কাঁটা করে দূর।
গোলমরিচে রান্ধে উপলের পুর ।।
আনিয়া ইলিশ মৎস্য করিল ফালাফালা।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণসাগর কলা।।
মাছ এবং বাঙ্গালী একে অপরের পরিপূরক ছিল। সে বলি রাজার পুত্র বঙ্গের জল ও ভূমি নিয়ে থাকা প্রজারা মাছ ও ভাত থেকেই জীবনী শক্তি সঞ্চয় করতেন।একসময় বাঙ্গালী বাড়িতে মাছ কাটা ছিল এলাহী কান্ড। আমাদের বাড়িতে জন্মদিন, বিয়ে, অন্নপ্রাশন পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি নানা শুভ ক্রিয়া কর্মে আস্ত মাছ আসত। এছাড়া আমাদের বাড়িতে মাংস খুব কম হতো। মাছই হতো বেশি। ঠাকুমা শুদ্ধ শাকাহারী ছিলেন। বাকিরা মাছ খেতেন। তো, রোজগেরে মাছের মধ্যেও আস্ত মাছই আসত – রুই, কাতলা , গুরজাওয়ালি, পুঁটি, মৌরোলা, পমফ্রেট , ইলিশ, চিংড়ি ( কুঁচো, ভুঁসো , চাপড়া, গলদা) , আমুদে, চাঁদা, ট্যাংরা , ভেটকি, আঢ় , বাণ , কই , শিঙ, তোপসে , মাগুর ইত্যাদি আর আসত কাঁকড়া। এর মধ্যে আমি রুই আর কাতলা মাছ ভাজা ছাড়া জীবনে অন্য মাছ খেতাম না। বাকিরা সর্ব মৎসভুক ছিলেন।
বাড়িতে আস্ত মাছ এলে সেটা নিয়ে কাট বসতেন মা বা কোনো পিসি। বাজার থেকে আঁশটুকুও ছাড়িয়ে আনা হতো না। দেখতাম মা বা পিসি একটা পয়সা দিয়ে আঁশ তুলছেন। সে কাজ করতে গিয়েও কত হাত কাটত। মাছ কাটার জন্য সেই পেল্লায় বঁটি নামিয়ে তাতে মাছের মুড়ো বসিয়ে কোপ দেওয়া হত। চিংড়ি মাছের পেটের কালো সুতো বের করা হতো। কুঁচো মাছ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ধোয়া হত। বাবা কাঁকড়া খেতে খুব ভালোবাসতেন। বাজার থেকে জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে এসে কাটতে দিতেন। বর্ষায় বাড়ির ঠিক পিছনের পুকুর থেকে কাঁকড়া ধরা হতো। সেই কাঁকড়া একমাত্র মা কুটতে পারতেন। কাঁকড়া কতবার দাঁড়া দিয়ে কামড়ে নিয়েছে মাকে….
বড় একটা লোহার কড়ায় মাছ রান্না হতো। অবশ্য আমাদের বাঙ্গালী পাকশালে এই কড়ায়ের গুন যে কত কি বলি ? ভাত থেকে মাছ মায় দুধ সবার জন্যই সে ছিল মানানসই পাত্র বিশেষ। কাজের সূত্রে পরিচিত হওয়া এক মাদ্রাজী মাসিমার বাড়ির রান্না ঘরে দেখেছি মাছ রান্নার জন্য আলাদা একটা কেমন যেন উঁচু পাত্র, সম্বর ডালের জন্য আলাদা। আহাঃ আমাদের কড়া সেখানের সর্বগুন সম্পন্ন ছিল। তো , রাবণের গুষ্টির জন্য একটা বড় মাছের ঝোল হতো। তবে রবিবারকে লাউ চিংড়ি বা একটু নারকেল দিয়ে মোচা চিংড়ি, আলুপোস্ত অথবা তোপসে মাছের ব্যবস্থা থাকত। মাছ , মাংস আবার আঁশ , সগরি এসব হতো। মা , পিসিদের দেখতাম চোদ্দ বার করে হাত ধুয়ে তবে অন্য বাসন , মশলা ইত্যাদিতে হাত দিতেন। সেই করতে করতে তাঁদের হাতে ঘা হয়ে যেত…কেউ কি তাঁদের খবর নিত ?
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ D. N. Shukla, Vastu-Sastra: Hindu Science of Architecture