যে দেশেতে রজনী নাই, সে দেশের এক লোক পেয়েছি।
আমার কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা, সন্ধ্যারে বন্ধ্যা জেনেছি।। …
সোহাগা গন্ধক মিশায়ে, সোনাতে রঙ ধরায়েছি।
মণি মন্দির মেজে দিব, মনে এই আশা ধরায়েছি।।
প্রসাদ বলে ভক্তি মুক্তি, উভয়কে সাথে ধরেছি।
এবার শ্যামার নাম ব্রহ্ম জেনে, ধর্ম কর্ম সব ছেড়েছি।”
হ্যাঁ , কলকাতা, আমার শহর কলকাতা, আমার প্রথম সব কিছু জানা কলকাতা, আমার কালীক্ষেত্র কলকাতা। কলকাতার প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় বহু দেবদেবীর উল্লেখ রয়েছে । তবে মা কালীর মতো এতো হাঁকডাক এত রমরমা আর ঠাকুর দেবতার নেই সেকথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়।
শুধু কালীঘাট কিংবা দক্ষিণেশ্বর নয়। এ শহরে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য কালীমন্দির।
মজুমদার বংশের শ্যামরায় পুজো পেতেন বহু মানুষের নিকট। সুতানুটি হাটের নঙ্গরেশ্বর পুজো আদায় করতেন হাট করতে আসা বহু মানুষের নিকট থেকে। তবু পুরনো কলকাতার মহাকালীর মাহাত্ম্যের তুলনায় এ সমস্ত নিতান্তই ছোট ব্যাপার বলে মনে হয়। একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার যে প্রাচীনতা এবং মাহাত্ম্যের দিক থেকে কলকাতার সকল কালী বা কালীমন্দির একপর্যায়ে নেই । কালীঘাটের কালী কিংবা চিত্তেশ্বরীকে কেন্দ্র করে যে প্রাচীন ইতিহাস বা কিংবদন্তির সমারোহ তা অন্য কালীর ক্ষেত্রে নেই। ঠনঠনের কালী, সিদ্ধেশ্বরী কালী, আনন্দময়ী প্রাচীনতায় কালীঘাট বা চিত্রেশ্বরীর পর্যায় নন।
আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।
(তুই) কালি দিয়ে লিখলি হিসাব কেতাব পুঁথি, শিখলি পড়া,
তোর মাঠে ফসল ফুল ফোটালো কালো মেঘের কালি-ঝরা।
তোর চোখে জ্বলে কালির কালো, তাই জগতে দেখিস আলো
(কালী)-প্রসাদ গুণে সেই আলো তুই হৃদ-পদ্মে দেখবি কবে?’
কালী সাধনার ইতিহাসের সেই পুরনো কলকাতা যেন অন্য রূপ পেত কার্তিক অমাবস্যায় – কালীপুজোর ঘনঘোর আমাবস্যার রাত। দিক হতে দিগন্তে অদ্ভুত আঁধার। তন্ত্র প্রসিদ্ধ কলকাতার তান্ত্রিকরা সেই ঘোর অমানিশায় জেগে উঠতেন তন্ত্রসাধনার মাহেন্দ্রক্ষণে । খড়্গ উঠত রঞ্জিত হয়ে। করোটির পানপাত্রে তান্ত্রিকরা পান করতেন কারন বারি।
কালীপুজোর সেই অমারাত্রে প্রাচীন কলকাতার সম্পন্ন পরিবারের উদ্যোগে আঁধার আকাশ আত্সবাজীর আলোর খেলায় মেতে উঠত । নিশাচররা সেই আলোর খেলায় ভয়ে ছুট লাগাত। শৃগালের দল হুক্কাহুয়া রবে বিরক্তি জানতো।
কালীপুজোর রাত্রির তন্ত্রের রহস্যময়ী কলকাতা বা সাধারণ মানুষের উৎসবে মেতে ওঠা কলকাতার বাইরেও একটা অদ্ভুত , পৈচাশিক কলকাতা ছিল। কি ছিল সেই কলকাতা ? কলকাতার কালীপুজোর ইতিহাস বলতে গিয়ে এটাও বলতে হয়। কালিপুজোর রাত্রিতে কলকাতাজুড়ে মেতে উঠতো ম্লেচ্ছযবন – ফিরিঙ্গি – কাফ্রি খালাসীদের দল। এবার তাদের মেতে ওঠা কোনো সাধারণ মানুষের মেতে ওঠার ন্যায় ছিল না। তাদের মানসিকতার বিকৃতি বোধয় কোনো কারণে কেবলমাত্র নেটিভদের প্রতিই ছিল। তাই পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে পথে পথে হৈ হৈ করে ছুটে বেড়াত। ঠিক যেন দৈত্যদানো, শ্মশানচারী শ্মশান থেকে বেরিয়ে এসেছে কালীপুজোর রাতে….। তাদের সামনে মানুষজন পড়লেই বিপত্তি । হাতের জ্বলন্ত পাটকাঠি উঁচিয়ে তাড়া করত সেই পথ চলতি মানুষকে। কাপড় জামায় আগুন ধরিয়ে দিত। সেই শঙ্কায় কলকাতার মানুষ এই রাতে পথে বেরোনোটা যথা সম্ভব এড়িয়ে চলত।
কালীপুজোর রাতে এরকম উৎপাত, অত্যাচার একটা সময় অসহ্য হয়ে উঠেছিল । সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে এই উৎপাত বন্ধের জন্য লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন তৎকালীন কলকাতা পুলিশের চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সে সময় কলকাতার পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ডেভিড ম্যাকফার্নেল। সে আবেদনে লেখা হয়েছিল –
” আমরা সর্ব্বসাধারণের অনিষ্টজনক বিষয় যাহা নিবারণ কারণের যোগ্য তাহা আপনার কর্ণগোচর করিতেছি , প্রতি বৎসর শ্যামাপূজার রাত্রিতে মোসলমান ও ফ্রিঙ্গি এবং কাফ্রি ও খালাসিরা প্রজ্জ্বলিত পাঁকাঠি হাতে করিয়া রাস্তায় দৌড়িয়া বেড়ায় এবং ঐ অগ্নিময় পাঁকাঠি দ্বারা মানুষ্যকে মারে ও শরীরে বস্ত্রাদি দগ্ধ করে। বিশেষতঃ গত শ্যামাপূজার রাত্রিতে ঐ ব্যবহার যেরূপ করিয়াছে তাহা অন্যান্য বৎসর অপেক্ষা অধিক। অতএব আমরা অতি নম্রভাবে আবেদন করিতেছি আপনি দয়াপূর্ব্বক এ বিষয়ে বিবেচনা করিয়া যাহাতে এই কর্ম আর না হইতে পারে এরূপ আজ্ঞা করিবেন। “( সমাচার দর্পণ ২৩ নবেম্বর ১৮৩৩ )
জনগনের এমতো সমবেত আবেদন কলকাতা পুলিশের নজর কেড়েছিল। তিনি একটি হুকুম জারি করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল , ” অনিষ্টজনক বিষয় নিবারণ করা উচিত । কিন্তু এ বৎসর হইয়া গিয়াছে । অতএব দরখাস্ত করিয়া আগত বৎসর পুনর্ব্বার দরখাস্ত করিলে পোলীশ এবং অন্যান্য লোকেরা ইহাতে মনোযোগ করিবেন এবং যদ্যপি বাধা না থাকে তবে ওই সম্পূর্ণ ব্যবহার রহিত করা যাইবেক।”
সাধারণ মানুষ অবশ্যই কালীপূজোর উৎসবের আনন্দে নিজেদের যুক্ত করতেন। তাঁরা মায়ের নিকট পুজো দিতেন যথাসাধ্য। পাঁঠা বলি হত। বলি মাংস প্রসাদ হিসাবে বাঙ্গালী গ্রহণ করতেন।
কালী মাহত্ম্যের এই মহাতীর্থ কলকাতার এই পরিবেশেই একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠনঠনে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। তখনও এ অঞ্চল গভীর জঙ্গলে ভরা। অঞ্চলটি সুতানুটির মধ্যে পড়ত। চারিদিকে খানাখন্দ, দিনের আলোতেও শৃগাল ডেকে যেত। শোনা যায় সেখানে এক মহাশ্মশান ছিল। এই জঙ্গলে সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটা খাল। এই খাল গঙ্গা ছুঁয়ে এসেছে। সেই গঙ্গা তখন বয়ে চলেছে আজকের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ রাস্তার উপর দিয়ে ।
সেই আদিপর্বে কলকাতার ঠনঠনে এলাকার জঙ্গলের মধ্যে এক শাক্ত ব্রহ্মচারী মা কালীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনিই ছিলেন মায়ের পূজারী। সেই ভীষন অরণ্যের মাঝে বড় ভক্তি ভরে তিনি নিয়মিত মায়ের পুজো করে যাচ্ছিলেন। ক্রমে ক্রমে অরণ্যে ঘেরা ছোট্ট কুটিরের মা সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা ধীরে ধীরে নিজের নাম ডাক ছড়াতে লাগলেন।
ভক্তি গদগদ কালী মাহত্ম্যে আলুপ্ত কলকাতার মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন ঠনঠনের মা কালী। তবে তেমন ব্যাপক ভাবে নয়। তাঁর সে প্রসিদ্ধি অনেক পরে।মায়ের পূজারী সেই শাক্ত ব্রহ্মচারী যাঁর নাম ছিল উদয়নারায়ণ , তিনি একদিন দেহ রাখলেন। তারপরই ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার পূজা সেবার ভার নিলেন হালদার বংশের পুরোহিত।
ব্রহ্মচারীর একমাত্র শিষ্য ছিলেন পুত্রহীন রামশঙ্কর হালদার।রামশঙ্কর হালদারের সংসারের মায়ায় কোনই আশক্তি ছিল না ।সারাদিন পড়ে থাকতেন শ্মশানে। দিন গেল। উদয় পরিব্রাজিত হবার সময় এল।তিনি শিষ্য কে দেবীর ত্রুটিহীন ভাবে পূজার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন …….
কিন্তু শ্মশান জঙ্গল হলেও জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। যেকোনো সময় দখল নিতে পারে তারা।সেই সময় রামশঙ্কর হালদারের নিজস্ব জমিটি ছিল ফোর্ট উইলিয়মের জমি। নিজের জমির স্বত্ব ইংরেজদের দিয়ে শ্মশান জঙ্গলের স্বত্ব তিনি নিলেন।
শাক্ত ব্রহ্মচারী উদয়নারায়ণ প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি ছিল মাটির তৈরী। বাংলার ১১১০ সালে ঠনঠনে অঞ্চলের বিখ্যাত ধনী মানুষ শঙ্কর ঘোষ মায়ের বর্তমান মূর্তি মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন। মন্দিরের গায়ে পাথরের ফলকে লেখা আছে :
শঙ্কর হৃদয় মাঝে কালী বিরাজে।
মন্দির গাত্রে লেখা এই শঙ্কর কোন শঙ্কর ? একই প্রতিষ্ঠাতা শঙ্কর ঘোষের শঙ্কর ? নাকি দেবাদিদেব মহাদেব শঙ্কর ? হয়ত শঙ্কর শব্দ এখানে দ্ব্যর্থ বোধক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদ ছিলেন স্বামী সুবোধানন্দ। তাঁরই প্রপিতামহ ছিলেন শঙ্কর ঘোষ।
মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। ম্যাকাচ্চিয়েন সাহেব বলেছেন : ” ঠনঠনিয়ার সাবেক কালীমন্দির ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ” এরপর ১৩৭১ বঙ্গাব্দে সাপ্তাহিক অমৃতের পৌষ সংখ্যাটি কলকাতা সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংখ্যায় সৌমেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন। ” কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীমন্দির সকলেই জানেন । এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৭০ বছর আগে। এখন এ অঞ্চল যেমন ঘন জনবসতিপূর্ণ তখন ছিল তেমনই ছিল জঙ্গলময় ।সেই জঙ্গলের মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় সামান্য একটি চালা ঘরে দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে একট তান্ত্রিক সাধক। পরে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দের সেই জায়গাতেই বর্তমান মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন বিশিষ্ট ধনী শঙ্কর ঘোষ। ” মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখ উল্লেখ প্রসঙ্গে রাধারমণ মিত্র বলেছেন ” বর্তমান মন্দিরের এক পাথরের গায়ে ১১১০ সাল লেখা আছে । অর্থাৎ এই পাথরেরপ্রমাণেকালী মন্দির তৈরি হয়েছিল ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে , ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে নয়। “
মন্দিরের দেবী সালঙ্কার সবসনা। কোমর ছাড়িয়ে এলান কেশদাম। বিগ্রহের বাঁ দিকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন সদাশিব। মাঝারি আকারের মূর্তি। দয়াভরা ত্রিনয়নি দেবী চতুর্ভূজা ।
ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরের পাশেই শংকর ঘোষ মহাশয় এর একটি আটচালা শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । শাক্ত মতে প্রতি কালী বা শক্তির থানে তার ভৈরব থাকা দরকার । ঠনঠনে তথা ঠনঠনিয়া , বিধান সরণী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির সংলগ্ন পুষ্পের আটচালা মন্দির। সেই মন্দির এর উৎকর্ণ লিপি নিম্নরূপ…..
“শ্রীমন্দিরে সমস্থাপিত শ্রীমৎ পুষ্পেশ্বর শিবঃমনোহরস্রীয়াদৌসা। শকাব্দে হি দ্বী দ্বিপর্ককে ১২৭৮ সন ১২১৩ । তারিখ ১ বৈশাখ- ।”
এই আটচালা মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে মূল গড়ন পাল্টানোর মত তেমন বড় কোনো সংস্কার হয়নি ।মোটামুটি বলতে পারা যায় মূল গড়ন তেমনটি আছে। তবে কালী মন্দিরের বহুল সংস্কার হয়েছে। মন্দির প্রাচীন চেহারার পোশাক পাল্টে আধুনিক হয়ে গিয়েছে । শোনা যায় , ১৮০৬ সালে আটচালা শিব মন্দির নির্মিত হয়।ঠনঠনে তথা ঠনঠনিয়া , বিধান সরণী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির সংলগ্ন পুষ্পের আটচালা মন্দির। সেই মন্দির এর উৎকর্ণ লিপি নিম্নরূপ…..
“শ্রীমন্দিরে সমস্থাপিত শ্রীমৎ পুষ্পেশ্বর শিবঃমনোহরস্রীয়াদৌসা। শকাব্দএ হি দ্বী দ্বিপর্ককে ১২৭৮ সন ১২১৩ । তারিখ ১ বৈশাখ- ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ যখন তার দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাস করতেন ঝামাপুকুরে, সেই সময় প্রতিদিনই তিনি যেতেন এই ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে…এই সময়ের একটি ঘটনা লিখেছেন সত্যচরন মিত্র –
“রামকৃষ্ণ একদিন ঠনঠনে কালিতলায় যান। সন্ধ্যার পর তিনি কালীর সম্মুখে বসলেন ।মার দিকে চাইতে চাইতে রামকৃষ্ণের গায়ে কাটা দিল । রামকৃষ্ণ কাঁদতে লাগলেন। রামকৃষ্ণ কিছুক্ষন পর উঠে পাগলের ন্যায় এক দিকে চললেন। “
শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদ স্বামী সুবোধানন্দেরপিতা কৃষ্ণদাস ঘোষ ছিলেন শঙ্কর ঘোষের পৌত্র।প্রথম যেদিন ঠাকুর সুবোধ কে দেখেছিলেন সেদিন বলেছিলেন , ” যখন ঝামাপুকুর এ ছিলুম , তোদের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে, তোদের বাড়িতে কতবার গেছি, তুই তখন জন্মাসনি।”
কেশব সেন সেই সময় ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম প্রতিভূ স্বরূপ ছিলেন। মূর্তিপূজার চরম অবিশ্বাসী সেই কেশব সেনও ঠাকুর গদাধর এর হাত থেকে কিন্তু রক্ষা পাননি ।শ্রী রামকৃষ্ণ দেব কেশবকে ভীষণ ভালবাসতেন এবং কেশব সেন নিজের ধর্মবোধের তাগিদে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে প্রতিদিন আসতেন….. কারণ ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণই তো ছিলেন সকারের সাকার ,নিরাকারে নিরাকার ,অদ্বৈতবাদী অদ্বৈত, ব্রহ্মবাদীর ব্রহ্ম।
তো একবার এই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে মানত করে পুজো দিয়েছিলেন এই ব্রাহ্মব কেশব সেনের আরোগ্য কামনার উদ্দেশ্যে…..
পরে তিনি ব্রাহ্ম কেশব বাবু কে বলেছিলেন , “আগেরবার যখন তোমার অসুখ হয় , রাত্রি শেষ প্রহরে আমি কাঁদুতম , কেশবের যদি কিছু হয় তবে কার সঙ্গে কথা কবো ? কলকাতায় এলে ডাব চিনি সিদ্ধেশ্বরীকে দিয়েছিলুম। মার কাছে মানত করেছিলুম যাতে তোমার অসুখ ভালো হয়।”
একবার ঠাকুর তাঁর মানসপুত্র রাখালের অর্থাৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দের জন্য এসে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে মানত করেছিলেন। কথামৃতে আছে, ” বৈকালে শ্রীরামকৃষ্ণ ,রাখাল ,মনির সঙ্গে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির অভিমুখে গাড়ি করিয়া আসিতেছেন …পথে শিমুলিয়া বাজার সেখানে ডাবচিনি কেনা হইল। মন্দিরে ভক্তদের বলিতেছেন ডাব চিনি কেটে দিয়ে মার কাছে পুজো দাও।”
এভাবেই মাঝেমধ্যেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন । তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল সিদ্ধেশরী মায়ের উপর । ঠাকুর তখন খুব অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য তিনি শ্যামপুকুরে আছেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। আশ্বিন অমাবস্যা। ৬ই নভেম্বর ১৮৮৫। কালীপূজা। ঠাকুর মাস্টারকে পাঠালেন ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পূজা দেবার জন্য। মাস্টার স্নান করে শুদ্ধ হয়ে, নগ্ন পায়ে গেলেন পূজা দিতে। ডাব চিনির পূজা দিয়ে নগ্ন পায়ে ঠাকুরের নিকট ফিরলেন।
ঠাকুর শ্যামপুকুর বাটীর দক্ষিণ গৃহে দাড়িঁয়ে ছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের পরনে পরিশুদ্ধ বস্ত্র কপালে চন্দনের ফোটা।
মাস্টার ঠাকুরের আদেশে সিদ্ধেশ্বরী কালী প্রসাদ এনেছেন । ঠাকুর অতি ভক্তি ভাবে দাঁড়ায়ে কিঞ্চিৎ খাচ্ছেন ,কিঞ্চিত মস্তকে ধারণ করছেন । প্রসাদ গ্রহণ করিবার সময় পাদুকা খুলেছেন। মাস্টার কে বলছেন , “বেশ প্রসাদ।”
কালীপূজার পূর্বের সন্ধ্যা থেকে সারারাত আয়োজন চলতে থাকে । নানা ধরনের অলংকার বস্ত্রে মা সজ্জিতা হন। প্রতিবছর দ্বীপানিতা কালীপুজোর আগে অঙ্গরাগ হয় মৃন্ময়ী মায়ের।
দীপান্বিতা কালীপূজার দিন মায়ের নিত্য পুজো হয় সকালে। এদিন মন্দির প্রায় সারাদিনই খোলা থাকে । সন্ধ্যায় মহাদেবের মঙ্গলারতি শুরু হয় , তারপর শুরু হয় মায়ের পুজোর আয়োজন। পুজো হয় সারা রাত ধরে। ভোগ রান্না হয় মন্দিরে । দেবী পূজার প্রসাদ বিতরণ করা হয় । এখানে এখনও বলি প্রথা আছে। পরদিন সকালে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে ভোগ বিতরণ শুরু হয় ।
ঠনঠনিয়া সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে প্রতিদিন পুজো শুরু হয় ভোর চারটে । অন্নভোগ হয় দুপুর বারটায়। রাত এগার টায় অন্নভোগ হয়ে মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন মন্দির বন্ধ থাকে দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে তিনটে অব্দি।
কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি হল “দেবী কালীর” পবিত্র আবাসালয় যিনি সম্ভবত সম্পূ্র্ণ গ্রহের দৃঢ় নারী শক্তির সবচেয়ে সারগর্ভ ও পরাক্রমশালী প্রতিমূর্তি। এটি বলাই বাহুল্য যে, দেবী কালী হলেন এই “আনন্দ নগরীর” এক অখন্ড অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
যে কেউ সহজেই শহরের যে কোনও স্থানে দেবী কালীর উৎসর্গীকৃত মন্দির খুঁজে পেতে পারেন। তবে কোনওরকম দ্বিধা ছাড়াই কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির এই মন্দির সবচেয়ে অন্বেষিত স্থান যেখানে প্রার্থনা নিবেদনের জন্য দিনে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়।
কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে, দেবীকে “সিদ্ধেশ্বরী”-রূপে পূজা করা হয় অর্থাৎ যিনি ইচ্ছা-পূরণ করেন।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১.বাংলার প্রাচীন কালীকথা
২. এই কলকাতায়