শেষ জীবনে স্বামীজি মেতেছিলেন আদিবাসীদের সেবায়, রান্না করে তাঁদের খাইয়েও দিয়েছেন 

১৯০০ সালের ৯ ডিসেম্বর। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কনকনে ঠান্ডার দাপট সমানে চলছে। মঠের ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা তখন সবেমাত্র রাতের খাবার খেতে বসেছেন। বাগানের উড়ে মালি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে খবর দিল এত রাতে ‘এক সাহেব আউচি’। এই রাতে কে সাহেব, কোথাকার সাহেব, কী জন্যই বা সাহেব এসব কথাবার্তায় যখন বেলুড় মঠ সরগরম, হঠাৎ সবাই দেখলেন সেই সাহেব নিজেই তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। হতবাক সকলে, সাহেবের এত তাড়া যে মূল দরজা খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তিনি পাঁচিল টপকে মঠে প্রবেশ করলেন! সাহেব আরও একটু কাছে আসতেই সব সন্দেহের নিরসন হল। সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘স্বামীজি এসেছেন, স্বামীজি এসেছেন’ বলে।

আজীবন অপরের চিন্তায়, মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করা বিশ্বখ্যাত বিবেকানন্দের এটিই ছিল বিদেশ থেকে ভারতে শেষ প্রত্যাবর্তন। জলপথে  মুম্বাইতে আসার পর কাউকে কোনোরকম খবর না দিয়ে সময়নষ্ট না করে তিনি সাহেবি পোশাকেই কলকাতায় ফিরেছিলেন। মঠের অনান্য সাধু- ব্রহ্মচারীরা যখন তাঁর এইভাবে পাঁচিল টপকানো নিয়ে হাসাহাসি করছেন, রসিক স্বামীজি তাঁদের বলেছিলেন, “তোদের খাবার ঘণ্টা শুনেই ভাবলুম, যাঃ এখনি না গেলে হয়তো সব সাবাড় হয়ে যাবে! তাই আর দেরি করলুম না”। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই রাতে রান্না খিচুড়ি বিবেকানন্দকে খেতে দেওয়া হলে অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খেলেন তিনি। এতদিনের প্রবাস বাস শেষে এতক্ষণে যেন প্রাণ জুড়াল।

ভারতবর্ষ স্বামীজির নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। তাঁর সন্ন্যাস জীবনের চিরবাঞ্ছিত সাধনা তাঁর দেশ। সন্ন্যাসের প্রথম জীবনেই এই মানুষটি ভয়ংকর সমুদ্র ঠেলে ভারতের শেষতম শিলাখণ্ড কন্যাকুমারিকায়, কোনও বিশেষ ধর্মীয় অনুভবের খোঁজে নয়; অন্ধ সংস্কার, অশিক্ষার জালে জড়িয়ে পড়া ভারতের মুক্তি হবে কীসে, এই ধ্যানেই ডুবে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। সন্ন্যাসের চিরপরিচিত ‘মুক্তি’ চিন্তার নতুন সমীকরণ রচনা হয়েছিল উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ার নরেন্দ্রনাথের হাতে, যেখানে ‘আত্মানোমোক্ষার্থং’-এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অপরের কল্যাণ, মানুষের মুক্তি। পরহিতায় সর্বস্ব অর্পণ এই যেন ছিল স্বামীজির সন্ন্যাসের মূলমন্ত্র। এই  বিবেকানন্দই তাই আক্ষেপ করে বলতে পারেন, “দেশের লোকে দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না, দেখে এক এক সময় মনে হয় ফেলে দিই তোর শাঁখ বাজানো, ঘণ্টানাড়া, ফেলে দিই তোর লেখাপড়া… দেশের গরিব দুঃখীর জন্য কেউ ভাবে না রে! যারা জাতির মেরুদণ্ড, যাদের পরিশ্রমে অন্ন জন্মাচ্ছে, যে মেথর একদিন কাজ বন্ধ করলে শহরে হাহাকার রব ওঠে… তাদের সুখে দুঃখে সান্ত্বনা দেয়, দেশে এমন কেউ নেই রে! …দেশে কি আর দয়াধর্ম আছে রে! আছে কেবল ছুঁৎমার্গীর দল!” গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী প্রচারের পাশাপাশি ভারতবর্ষের এই লাঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য কিছু করতেই  বিবেকানন্দের পাশ্চাত্য যাত্রা। নিজেই বলেছেন সেকথা, “ওদেশে ধর্ম প্রচার করতে যাওয়ার আমার এই আর একটা উদ্দেশ্য ছিল যে, এদেশের লোকের জন্য যদি অন্নসংস্থান করতে পারি”।

পারিবারিক আশ্রয় ছেড়ে বরাহনগরের পোড়োবাড়িতে গুরুভাইদের সঙ্গে কৃচ্ছসাধন, পরিব্রাজক হয়ে ভারতবর্ষের পথে পথে ঘোরা, বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ হওয়ার পরও মানুষের কল্যাণচিন্তায়, গঠনমূলক কাজের পরিকল্পনায় ছুটে বেড়ানো, মানুষের সেবায় নিবেদিত এই জীবনে কখনই নিজের কথা ভাবার সময় ছিল না স্বামীজির। ফলে মারণ রোগ শরীরে বাসা বাঁধছিল অজান্তেই। ১৯০০-১৯০২; জীবনের এই শেষ দুটো বছর তাই  বারেবারেই বিবেকানন্দের অসুস্থতার কথা লিপিবদ্ধ হয়। ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার জনিত কারণে এসময়ে ঘনঘন অসুস্থ হয়েছেন স্বামীজি। হাওয়া বদলের জন্য তাঁর গুরুভাইয়েরা তাঁকে এ সময়ে যে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন, স্বভাবসিদ্ধ কারণেই সেই সব জায়গাতে গিয়েই কোনো না কোনো কাজ বা কাজের চিন্তায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন কর্মযোগী বিবেকানন্দ। এই সময়পর্বে যাওয়া    মায়াবতী, পূর্ববঙ্গ, আসাম, শিলং, বুদ্ধগয়া বা কাশী সবজায়গাতেই স্বামীজির কর্মযোগের প্রত্যক্ষ নিদর্শন মেলে। অসহায় ও রোগজীর্ণ মানুষের সেবার জন্য এই সময়তেই বিবেকানন্দের প্রত্যক্ষ উপদেশে উদ্বুদ্ধ হয়ে কয়েকজন বাঙালি ছেলের হাতে বারাণসীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে’র ভিত্তি। একইরকম কাজ এর আগেই অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল এই বাংলার সারগাছিতে স্বামীজির গুরুভাই অখণ্ডানন্দের উদ্যোগে। এই সেবাব্রতই পরে প্রয়াগ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সেবাশ্রমের সূচনার পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কর্মকাণ্ডের অন্যতম  প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াবে।

নিজের জীবন উপেক্ষা করে রোগ, মহামারী, বন্যা, দুর্ভিক্ষে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই ব্রত বিবেকানন্দ নিজের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেখিয়েছিলেন। হাঁটতে কষ্ট, অথচ স্বামীজি যেন পণ করেছেন, যতদিন এই শরীরটা আছে ততদিন তিনি কাজ করে যাবেন। নিজেই  বলছেন, ‘খাটতে খাটতে মরব’। শরীর ভাঙছিল দ্রুত অথচ বিশ্রাম নেই স্বামীজীর। শেষের কয়েকটা মাস বেলুড় মঠে নিজের পোষা কুকুর ‘বাঘা’, ছাগল ‘মটরু’-কে নিয়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি, মঠে কাজ করতে আসা সাঁওতাল মানুষগুলোর সেবায় মেতে থাকতেন দিনভর। নিজের হাতে রান্না করে ওই মানুষগুলোর মুখে গ্রাস তুলে দেওয়ার সময় নিজেই চোখের জলে ভেসেছেন। অসুস্থ শরীরেও মঠের সাধু ব্রহ্মচারীদের নিয়মিত শাস্ত্রক্লাস, ব্যাকরণের ক্লাস নিয়েছেন। কোনো কিছুর আধিক্য বিবেকানন্দ পছন্দ করতেন না মোটেও। পুজোআচ্চায় আড়ম্বরপূর্ণ বিধিপালন তাঁর কাছে ছিল সময়ের অপব্যবহার, বরং ওই সময়টা একটু পড়াশোনা ও মানুষের সেবাকাজে দেওয়াতেই মত ছিল স্বামীজির।

ক্রমশ শেষের সে দিন এগিয়ে আসে। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে স্বামী শুদ্ধানন্দকে একখানা পঞ্জিকা আনতে বলেন ও নিজেই কয়েকটা পাতা উল্টে আবার রেখে দেন। শরীর যাওয়ার তিনদিন আগে মঠের মধ্যেই গঙ্গাতীরের একটা জায়গার দিকে আঙুল তুলে সঙ্গীসাথীদের বলেন, ‘আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি’। মৃত্যুদিনের ঠিক আগের একাদশী তিথিতে নিজে হাতে পরিবেশন করে খাওয়ান সিস্টার নিবেদিতা-সহ আরও কয়েকজনকে। খাওয়ার পর তাদের হাতে জল ঢেলে দিতে তাঁরা আশ্চর্য হয়ে স্বামীজিকে বলেন, ‘এ কী করছেন স্বামীজি!’ ভুবনভোলানো হাসিতে বিবেকানন্দ তাঁদের বলেন প্রভু যীশুও তাঁর শেষ সময় তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। কারোর মুখে তখন কথা নেই, শুধু অলক্ষ্যে এভাবেই যেন লেখা হয়ে যায় এই মানুষটির জীবনের শেষ সংলাপ।

১৯০২-এর ৪ঠ জুলাই রাত ৯.১০ মিনিটে শরীর যায় বিবেকানন্দের, যে দুজন ডাক্তার স্বামীজিকে এরপর দেখেন তাঁরা কেউ বলেন হার্ট অ্যাটাক আবার কেউ বলেন ব্লাডপ্রেশার অত্যন্ত বেড়ে গিয়ে মাথায় রক্ত উঠে মৃত্যু ঘটে স্বামীজির। অথচ সেইদিন সকাল থেকে রাত অবধি এতদিনকার অসুস্থতার সমস্ত লক্ষ্মণ দূরে সরে গিয়ে বিবেকানন্দ একদম স্বাভাবিক সুস্থ শরীরে দিনটি কাটিয়েছিলেন। তাই এই শরীরত্যাগ তাঁর গুরুভাইদের কাছে ছিল অভূতপূর্ব, এ যেন কর্মযোগীর নিজের স্বরূপ উদঘাটন শেষে স্বইচ্ছায় শরীর ছেড়ে যাওয়া।রাতে শরীর গিয়েছিল স্বামীজির, বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা সে সময় বাগবাজারে তাঁর নিজের ঘরে। খবর পেয়ে পরদিন সকালে যখন তিনি মঠে পৌঁছান, তখন স্বামীজির শরীর নিথর হয়ে গেছে। দাহ করার সময়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে একখণ্ড না পোড়া গেরুয়া নিবেদিতার সামনে এসে পড়ে। গুরুর আশীর্বাদ মনে করে তক্ষুনি তা মাথায় তুলে নেন সিস্টার। মৃত্যুতে কোনো কোনো জীবন শেষ হয়ে যায় না, নতুন করে শুরু হয় যেন। বিবেকানন্দের কর্মধারাও ওইভাবে আবার চলা শুরু করল, ওই কাকতালীয় মূহুর্ত থেকেই। ‘জীবন’ দেখিয়ে দিয়ে ভাবীকালের জীবনীকারদের প্রকৃত ‘জীবনী’ লেখার রসদ দিয়ে গেলেন স্বামীজি। জাত, বর্ণ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মানুষকে ভালোবেসে মানুষের হাসিকান্নার সঙ্গী হওয়ার চেয়ে আর কোনো বড়ো মুক্তি সন্ন্যাসীর লক্ষ্য হতে পারে না, তা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন স্বামীজি। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসধারায় নতুন চিন্তা সময়োপযোগী হয়ে যুক্ত হল যেন। স্বামী বিবেকানন্দ এক প্রবাহমান আদর্শনাম, আর সনাতন বিশ্বাসে আদর্শের মৃত্যু হয় না। এই কারণেই হয়ত,  শতক পেরিয়ে গেলেও বিবেকানন্দের মৃত্যুদিন আজ পর্যন্ত কোথাও আলাদা করে স্মরণ করার রেওয়াজ নেই রামকৃষ্ণ মঠমিশনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.