প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার এক সম্রাট দান ফেলছেন বোর্ডে। দেখার জন্য, যে পরজন্মে বিধাতা তাঁর ভাগ্যে আবার সম্রাট হওয়াই লিখেছেন কি না। কিংবা কোনও বণিক দান চেলে বুঝে নিতে চাইছেন তাঁর ভাগ্য। ভবিষ্যৎ, যা দেখা যায় না, তাকে আগে থেকেই জেনে নেওয়ার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ বোধহয় সভ্যতার প্রথম দিন থেকেই। সেখানে রাজা থেকে ফকির, সবার জিজ্ঞাসাই প্রায় সমান। আর সেই ভবিষ্যৎ যদি দাঁড়িয়ে থাকে গোটা জীবনকালের পরে, তবে জিজ্ঞাসা আর অনিশ্চয়তার বিভ্রম গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। অন্তত যাঁরা নিত্যনতুন জন্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে তো বটেই। সেই জন্মের ভাগ্য গণনা মানুষ করে নিতে চায় বিভিন্নভাবে। কখনও শাস্ত্রজ্ঞানের মাধ্যমে, কখনও ধর্মবিশারদের কাছে গিয়ে। কখনও মানুষের অক্লান্ত কল্পনা আর অনিশ্চয় জিজ্ঞাসা জন্ম দেয় কোনও বিশেষ খেলার, যা কোনও জাতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।

তেমনই একটি খেলা হলো প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার দ্য রয়্যাল গেম অফ উর (The Royal Game of Ur)। ২০ খোপযুক্ত বোর্ডে দান চেলে পরজন্মের ভাগ্য বুঝে নেওয়ার খেলা। এরকমই অসংখ্য প্রাচীন, অধুনা বিলুপ্ত বোর্ডগেম নিয়ে সাজানো কলকাতার বোর্ডগেম মিউজিয়াম। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে নিজের বাড়িতেই অধ্যাপক সৌভিক মুখার্জি (Souvik Mukherjee) খুলেছেন এই অন্যরকমের সংগ্রহশালা। যেখানে আছে প্রাচীন আর নতুন মিলিয়ে ১০০-এর কাছাকাছি বোর্ডগেম-এর রেপ্লিকা। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সময়কালের।

টেরাকোটার দাবার সেট

Story image

মিউজিয়ামটির নাম গৌতম সেন মেমোরিয়াল বোর্ডগেম মিউজিয়াম (Gautam Sen Memorial Boardgame Museum)। সৌভিক বাবু বলেন “আমার শ্বশুরমশাই গৌতম সেন খুবই দক্ষ দাবাড়ু ছিলেন। বিভিন্ন বোর্ডগেম সম্পর্কে তাঁর গভীর উৎসাহ ছিল। তিনি বিভিন্ন দেশের দাবা আর অন্যান্য বোর্ডগেম সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা আর চর্চা করেছেন, ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। কোভিডকালে তাঁর মৃত্যুর পর, স্মৃতির উদ্দেশ্যেই তাঁর নামে এই সংগ্রহশালাটি তৈরি করেছি।” সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তাঁর সংগ্রহে থাকা বোর্ডগেমগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন খেলা দ্য রয়্যাল গেম অফ উর। ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই খেলার প্রচলন ছিল। সৌভিক জানান, “স্যার লেনার্ড বুলি ইরাকের একস্থানে খননকার্য চালাতে গিয়ে ১৯৩০ সালে একটি ফলক খুঁজে পান, যেখান থেকে এই খেলা সম্পর্কে জানা যায়। খেলার নিয়মগুলি খুঁজে পান এডউইন ফিংকেল, ২০০০ সালের পরে। ইজরায়েলের এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি মহিলার কাছ থেকে। তাঁরা ভারতে থাকার সময় কোচিনে ‘আশা’ নাম দিয়ে এই খেলাটি খেলতেন। গেমটির একটি রেপ্লিকা আমি জোগাড় করেছি। আসলটি আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।” কোথায় মেসোপটেমিয়া আর কোথায় কেরলের কোচিন! 

গোলকধাম, ছবিঃ অপূর্ব কুমার পাণ্ডা

এভাবেই ইতিহাস হাত ধরে বর্তমানের, এক সভ্যতার সংস্কৃতি বয়ে আসে অন্য সভ্যতায়। আরেকটি গেম হলো মানকালা (Mancala), দক্ষিণ ভারতে এর নাম পালানগুঝি (Pallanguzhi)। পূর্ব আফ্রিকা থেকে খেলাটি ভারতে এসেছিল। কাঠের বোর্ডে কড়ির মতন গুটি দিয়ে খেলতে হয়। গ্রামের দিকে, অনেকক্ষেত্রে মাটিতে গর্ত করে গাছের বীজ দিয়েও খেলা হয় এটি। তবে বোর্ডগেম শুধু সংস্কৃতি আর ইতিহাস নয়, তার মধ্যে জুড়ে থাকে অঙ্ক। যুক্ত থাকে স্ট্র্যাটেজির লড়াই, স্নায়ুযুদ্ধ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাপানি গেম ‘গো’ (Go)। সৌভিকের কথায়, “১৯৯০-এর দিকে মানুষ দাবাড়ুকে হারিয়ে দিয়েছিল কম্পিউটার। কিন্তু ২০১০ সালের আগে কোনও গো প্লেয়ারকে হারাতে পারেনি। তাহলেই বুঝুন খেলাটি কত জটিল। এই খেলা নিয়ে একটি বিখ্যাত উপন্যাসও আছে, নাম ‘দ্য মাস্টার অফ গো’।”

কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক সৌভিকবাবুর কাছে আছে নেপালের জাতীয় খেলা ‘বাঘচাল’। বাংলায় যা পরিচিত বাঘবন্দি নামে। আছে বিভিন্ন দেশের আর সভ্যতার দাবার সেট। সবকটিই অনবদ্য। তবে আলাদা করে নজর কাড়বেই পেরুর একটি চেস সেট। সাদা আর লালচে ঘুঁটিগুলির আকার যোদ্ধাদের মতন। যুদ্ধক্ষেত্রে একদিকে দাঁড়িয়ে স্প্যানিশ কংকিস্তাদোর পিজারো আর অন্যদিকে ইনকাদের শেষ সম্রাট আতাহুয়ালপার সেনা। “এই খেলাটি ইতিহাসের একটি অসাধারণ প্রতীক।” বলেন সৌভিকবাবু। বাস্তবে পিজারোর ছলের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন ইনকারা। কিন্তু এই খেলায় সব ছলচাতুরিকে হারিয়ে জিতেই যেতে পারেন তাঁরা। সৌভিকবাবু আলাপচারিতায় জানালেন, “প্রতিটি খেলার সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাস, বিভিন্ন সময়কালের সমাজ, অর্থনীতি। এক খেলার সঙ্গে অন্য খেলার সাদৃশ্যে বোঝা যায় দুই সভ্যতার সম্পর্ক, ধরা পড়ে কোনও একটি বিশেষ সময়ের রাজনীতি, ধর্মবিশ্বাস, মিথ।” 

দ্য রয়্যাল গেম অফ উর

তেমনই একটি খেলা বাংলার গোলকধাম। বিভিন্ন ধর্মীয় পুণ্যধামের নামাঙ্কিত এবং সেখানকার মন্দিরের ছবি দেওয়া একটি কাগজ। আছে হিন্দুদের মুক্তিধাম, গোলকধাম। খেলতে খেলতে বুঝে নিতে হয় নিজের অর্জিত পুণ্যের পরিমাণ। “সাপ লুডো তো আমরা সকলেই খেলেছি। সেই ধাঁচের একটি বিশেষ খেলা হলো জ্ঞান চৌপার। এই খেলাতে সাপ আর সিঁড়ি আছে। কিন্তু বোর্ডে আছে জন্ম, মৃত্যু, বিভিন্ন পুণ্যধাম, বিভিন্ন স্থানের নাম লেখা খোপ। আছে বৈকুন্ঠ। সেখানে পৌঁছালেই মুক্তি”, জানালেন সৌভিক মুখার্জি। তাঁর কাছে আছে ইন্দোনেশিয়ার সুরাকর্তা, আজটেক দাবার সেট, ভারতের দশাবতার কার্ড, জাপানি খেলা সোগি, চাইনিজ, বার্মিজ চেস সেট ইত্যাদি। সবকটির বর্ণনা দেওয়া এই স্বল্প পরিসরে সম্ভবও নয়।

আজটেক দাবার সেট

তাঁর গবেষণার একটি বিষয় ভিডিওগেম। ভিডিওগেমের মাধ্যমে গল্প বলা। তার সঙ্গে সঙ্গেই চর্চা আর অধ্যয়ন বোর্ডগেম নিয়েও। গেম নিয়ে লিখেছেন বইও। বললেন, বোর্ডগেম বা ভিডিওগেমকে সাধারণত খেলা হিসাবে ততটা মর্যাদা দেওয়া হয় না, বিশেষত এই দেশে। কিন্তু গেমগুলিতে ধরা থাকে কোনও বিশেষ সময়ের সামগ্রিক সুর। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বিজনেস বলে যে খেলা একসময় খেলতাম বা এখনও কেউ কেউ খেলি, তা একটা ক্যাপিটালিস্ট খেলা। কিন্তু প্রথমদিকে এই খেলা ছিল একেবারেই অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্ট। এর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় ক্ষমতা বদলের বাঁক। বোঝা যায় এক সভ্যতার সঙ্গে অন্য সভ্যতার সম্পর্ক। গেমগুলি সময়ের গল্প বলে। বোর্ডগেমগুলিকে সংরক্ষণ করা আর সেগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য।”

তাঁর মিউজিয়াম দেখতে আসেন বিভিন্ন গবেষকরা, গেম ডিজাইনাররা আর ডেভেলপাররা। কলকাতার একটি স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে এই বোর্ডগেমের উপর ওয়ার্কশপও করাবেন তিনি। তার কথাবার্তা চলছে। এছাড়া গেম নিয়ে চলতেই থাকে সেমিনার, কনফারেন্স। এভাবেই বোর্ডগেমকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা করছেন তিনি। নিজের চর্চা আর তাঁর সা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.