#পর্ব_২
অঘ্রাণে আমন ধান্যে মাঠ গেছে ভরে।
লক্ষ্মীপূজা করি মোরা অতি যত্ন করে।।
পৌষপার্বনে মাগো মনের সাধেতে।
প্রতি গৃহে লক্ষ্মী পূজি নবান্ন ধানেতে।।
মাঘ মাসে মহালক্ষ্মী মহলেতে রবে।
নব ধান্য দিয়া মোরা পূজা করি সবে।।
ধান…..আপামর বাঙালী তথা ভারতবাসীর ক্ষুন্নিবৃত্তি তথা উৎপাদন ও সম্পদ আহরণের অন্যতম উপাদান হল ধান। নদীমাতৃক বাংলার ভূমি এতই উর্বর ছিল সর্ব প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য শস্য হিসাবে ধানের উৎপাদন হত এবং এখনো হয়। সেই সুপ্রাচীন #পাণ্ডুরাজার_ঢিবি …..তারা ভাত খেতো। একই সঙ্গে মাংস, মাছ এবং ফলমূলও তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই প্রথমেই প্রধান শস্য ধানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করা উচিত। তার সঙ্গে যেসব প্রজাতির ধান চাষ বন্ধ হয়ে গেছে তাদের কথাও বলব।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় হতে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে উৎকীর্ণ প্রাচীন #করোতোয়া তীরবর্তী মহাস্থানের শিলাখণ্ড থেকে ধানের কথা পাই। এটি একটি রাজকীয় আদেশ এবং রাজার নাম অজ্ঞাত। যে স্থান হতে এই আদেশ দেওয়া হয়েছে তার নাম অজ্ঞাত। তবে এর অক্ষর দেখে শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডাকর মহাশয় অনুমান করেন এবং তার অনুমান সত্য বলে মনে করা হয়, যে আদেশ টি এসেছিল কোন #মৌর্য সম্রাটের নিকট হতে। আদেশ দেয়া হয়েছে পুন্দনগলের বা পুন্ড্রনগরের মহামাত্রকে তাঁকে শাসন উল্লিখিত আদেশ পালন করতে বলা হয়েছে।
লিপিতে উল্লেখ হয়েছে পুন্ড্রনগরে ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানে #সংবঙ্গীদের মধ্যে ( বিতর্কিত ভাবে ছবগীয় বা ষড়বর্গীয় ভিক্ষুদের মধ্যে) কোন দৈব দুর্বিপাক বসত দুর্ভিক্ষ ও নিদারুণ দুর্ভোগ দেখা গেছিল । লিপিতে এই দুর্বিপাক যে কি তা উল্লেখ করা নেই। লিপি অনুযায়ী এই দুর্গতি হতে ত্রাণের উদ্দেশ্যে দুটি উপায় অবলম্বন করা হয়েছিল- প্রথমটি কি তা হয়তো শিলাখণ্ডের প্রথম পংক্তিতে লেখা ছিল। কিন্তু সেই অংশটি ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যেতে তা জানতে পারা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়েছে গণ্ডক মুদ্রায় কিছু অর্থ সংবঙ্গীদের নেতা গলদনের হাতে দেওয়া হয়েছিল ঋণ হিসাবে।
দ্বিতীয় উপায় রাজকীয় ভান্ডার হতে দুঃস্থ জনসাধারণকে ধান দেওয়া হয়েছিল। খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য না কৃষির উৎপাদনের বীজ হিসাবে সে কথার উল্লেখ কিন্তু শিলালিপিতে করা হয়নি । কিন্তু এই ধান ঋণ সাবে দেওয়া হয়েছিল। কারন স্বরূপ লিপিতেএই আশার উল্লেখ আছে যে রাজকীয় আদেশের ফলে সমগ্র ভিক্ষুরা বিপদ কেটে উঠতে পারবে এবং জনসাধারণের মধ্যে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। তখন গণ্ডক মুদ্রার মাধ্যমে রাজকোষ এবং ধান দিয়ে কোঠাগার ভরে দিতে হবে ।
এ হতে উপলব্ধি করা যায় জনসাধারণের নিকট ধানই প্রধান উপজীব্য ছিল । দুর্ভিক্ষ দুর্গতির সময়ও ধানকে ঋণ স্বরূপ গ্রহণই ছিল জীবনের অন্যতম উপায়।
ধান গরিব জনগণের নিকট যে কি পরিমান কাম্য বস্তু ছিল তা আমরা চন্ডীমঙ্গল কাব্যেও পাই:
আছয়ে তোমার সই বিমলার মাতা
লইয়া সাজারু ভেট যাহ তুমি তথা।
খুদ কিছু ধার লহ সখীর ভবনে
কাঁচড়া খুদের জাউ রান্ধিও যতনে।
রান্ধিও নালিতা শাক হাঁড়ি দুই তিন
লবণের তরে চারি কড়া কর ঋণ।
সখীর উপরে দেহ তন্ডুলের ভার
তোমার বদলে আমি করিব পসার।
গোধিকা রাখ্যাছি বান্ধি দিয়া জাল-দড়া
ছাল উতারিয়া প্রিয়ে কর শিক-পোড়া।অথবা ঢেণ্ঢন পাদ রচিত চর্যাপদে সেই কোন ছোট বেলায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আমরা পড়েছিলাম….
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী ।হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥বেঙ্গসঁ সাপ চঢ়িল জাই ।দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাই ॥বলদ বিআএল গবিআ বাঁঝে।পীঢ়া দুহিঅই এ তীন সাঝে ।।জো সো বুধী সোহি নিবধী।জো সো চোর সোহি সাধী ॥নিতি নিতি সিআলা সিহে সম জুঝই ।ঢেন্ঢন পাএর গীত বিরলে বুঝই ॥
টোলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নাই;
অন্নহীন, নাই তবু ইষ্টির কামাই!
ব্যাঙ কি কামড় মারে সাপের শরীরে?
অথবা দোয়ানো দুধ বাঁটে যায় ফিরে?
বলদে বিয়ায় আর গাভি হয় বন্ধ্যা,
পিঁড়ায় দোয়ানো হয় তাকে তিন সন্ধ্যা–
যে জ্ঞানী সবার চেয়ে, অজ্ঞান সে ঘোর;
সবার চেয়ে যে সাধু, সেই ব্যাটা চোর!
শিয়াল–সিংহের যুদ্ধ চলে অনুক্ষণ–
লোকেরা বোঝে না, তাও বলেন ঢেণ্ঢন।
যা হোক, তো উক্ত শিলালেখ থেকে এই উপলব্ধি হয় যে ধানকে সম্পদ হিসাবে ঋণ দান করে রাজা উপায় অবলম্বন করেছিলেন।সেই জন্যই রাজকোঠাগারে দুর্বিপাক কাটানোর উদ্দেশ্যে ধান সংগ্রহ করে রাখা হত। তবে উল্লেখ্য বিপদে রাজা এই ধান বিনামূল্যে বিতরণ করেন নাই । অর্থ ও ধান ঋণ স্বরূপ দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে অসংখ্য লিপিতে যেমন ধানের উল্লেখ পাওয়া যায় না কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ধান ছিল একমাত্র উপজীব্য এবং শস্য বলতে ধানকেই বোঝানো হতো সর্বাগ্রে, তার নাম করবার প্রয়োজন হতো না । ধান একান্ত ভাবে বৃষ্টি নির্ভর । বাংলা তথা ভারত মৌসুমী জলবায়ুর দেশ। একটা সময় পর্যন্ত শুধু এই জলবায়ুর উপর ভিত্তি করেই ধান চাষ হত। রাজেন্দ্রচোলের #তিরুমলয় লিপিতে বঙ্গে অবিরাম বারিপাতের উল্লেখ আছে। #পাল লিপিতে সেই প্রসিদ্ধ পদ পাওয়া গেছে ” দেশে প্রাচি প্রচুর পয়সী স্বচ্ছমাপিয় তোয়ং”…..কবি জয়দেব বলেছেন #মেঘৈর্মেদুরমম্বরম। ঘন বর্ষার মেঘ মেদুর আকাশকে অভিনন্দন করেছেন।যদিও বারিবাহী মৌসুমী বায়ু কখনো ভালো ,কখনো অধিক, কখনো স্বল্প বৃষ্টি দেয় । সেজন্য অগণিত নদী খাল-বিলে সত্ত্বেও এদেশের লোকগানে, ব্রতকথা , মঙ্গল কাব্য, চর্যাপদে, নানা পূজাঅনুষ্ঠানে মেঘ ও আকাশের কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা ও পৃথিবীর নিকট পুষ্টিযুক্ত ভূমি প্রার্থনার বিরম নেই যুগ থেকে যুগান্তরে।
সেই কোন প্রাচীন কালে বৈদিক ঋষি মুনিরা তাই উচ্চারণ করেছিলেন মহামৃত্যুঞ্জয় মৃৎসঞ্জীবনি মন্ত্র
ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম।
উর্বারুকমিববন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ । ।
তারপর বাঙালীর জীবনে বারো মাসের তেরো পার্বন সেখানে পূজা, ব্রত , মঙ্গলকাব্য সবই প্রকৃতি বিষয়ক। সর্বত্রই মানুষ চান ধরিত্রী যেন হয় সুজলা সুফলা।
যেমন : #পৃথিবী ব্রত ….মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা বৈশাখ মাস ধরে একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। এটি চার বছর পরপর পালন করতে হয়। ব্রতের উদ্দেশ্য হল শস্য শ্যামলা ধরণী, বৃষ্টি সাংসারিক অমঙ্গল দূরীকরণ।
“এসো পৃথিবী, বসো পদ্মপাতে,
তোমার পতি শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হাতে
তিনি বৈকুণ্ঠেশ্বর নারায়ণ, আজকে পূজব তার দু’চরণ
খাওয়াব ক্ষীর, মাখন, ননী যেন জন্মে জন্মে হই রাজার রাণী
নাওয়াবো দুধে মাখাব ঘি জন্মে জন্মে হব রাজার ঝি।।”
আরো আছে #যমপুকুর ব্রত :
সুষনি কলমি ল ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে
মারল পক্ষী, শুকোয় বিল
সোনার কৌটো রূপোর খিল
খিল খুলতে লাগল ছড়
আমার বাপ-ভাই(বা স্বামী)হোক লক্ষেশ্বর।।ব্রতের ছড়ায় যথেচ্ছ পাখি মারা, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার অতি জরুরি প্রসঙ্গও আছে।
আর যেমনটি আছে #পুণ্যিপুকুর ব্রত ….বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্রতগুলির অন্তর্গত একটি কুমারীব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি ঘরে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী কুমারী মেয়েরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ মাসের শেষদিন (সংক্রান্তি) পর্যন্ত একমাসব্যাপী এই ব্রত পালন করে। ব্রতের উদ্দেশ্য হল বৈশাখ মাসের খরায় যাতে পুকুর জলশূন্য না হয় অথবা গ্রীষ্মঋতুতেযেন গাছ না মরে।
আর আছে ইতু পূজা । সূর্যের অপর নাম আদিত্য। এই আদিত্য থেক ইতু শব্দটি এসেছে। শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি #ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত।আচার্য সুকুমার সেন একেবারে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন – ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপুজোর দৃষ্টান্ত। তাঁর মতে ঋকবেদীয় সূক্তগুলির নাম ছিল ইন্দ্রস্তূত। তার থেকে কালক্রমে ইন্দথথু> ইতু। ইন্দ্র বৈদিকযুগের প্রধান দেবতা। আবার বিয়ের দেবতাও ছিলেন তিনি। মেয়েদের ব্রত আচার কৃত্যে ইন্দ্র ক্রমশ স্থান লাভ করেন। ইন্দ্রের মত বরের কামনায় আজও ইন্দ্রদাদ্বশীর দিন মেয়েরা ইন্দ্রপুজো করে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। এই সময়ে রবিশস্য লাগানো হতো। কৃষির সঙ্গে প্রজনন সমার্থক। সুতরাং বোঝাই যায় ইতু আসলে সেই রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের কৃষি উৎসব।
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে ।
ইতুকথা একমনে শুন প্রাণ ভরে।।
পুজোর উপকরণ সেই শস্য। সরায় মাটি দিয়ে তাতে গোটা ধান, হলুদ, কলমী , হীনচে , কড়াই ইত্যাদি পুঁতে সারা মাস ব্যাপী জল দিয়ে পুজো করা হয়। সংক্রান্তির দিন অবধি সরা ভরে গাছ গজিয়ে ওঠে। এমন কত ব্রতর কথা বলব। সেই বারোমস্যা লক্ষী পূজা থেকে শুরু করে কোজাগরী লক্ষী পূজা , নবান্ন , মা দুর্গার বোধন থেকে নবপত্রিকা স্থাপন, নানান ষষ্ঠী পূজা ,মনসা পূজা , মাকাল ঠাকুর পূজা ইত্যাদি সর্বত্রই প্রকৃতির উপাসনা।
আখসোর হা/পোকামাকড় দূরে যা।/সগারে ধান টুনিয়া মুনিয়া/হামার ধান কাইঞ্চতা সোনা।’
ছড়ার সুরে এভাবেই লক্ষ্মীকে আহ্বান জানায় রাজবংশী সমাজ তাঁদের ডাক লক্ষ্মীপুজোয়। জমিদারি ব্যবস্থা যখন চালু ছিল তখন গ্রামের জোতদার বা জমিদাররা এই #ডাকলক্ষ্মী বা খেতি লক্ষ্মীর পুজো করতেন। পরবর্তী কালে প্রজারাও এতে অংশগ্রহণ করেন। মূর্তিবিহীন ডাকলক্ষ্মীর পুজো আদতে কৃষি উৎসব…….
লোকমুখে প্রচলিত, মূলত বিভিন্ন শস্যবীজের মান পরীক্ষার জন্য গ্রামবাংলায় এক সময় ভাঁজো বা ভাজুই উৎসবের সূচনা হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, বর্তমানে বীজ সংরক্ষণ, সংশোধন ও সর্বোপরি কৃষিতে এসেছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। ধারাবাহিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্র দখল করেছে উন্নত প্রজাতির উচ্চফলনশীল বীজ। সেই হিসেবে ওই উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা আজ আর নেই। তবু আজও মহাসমারোহে ভাঁজো ব্রত বা উৎসবে মেতে ওঠেন মহিলারা।
তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকেন। শস্য কামনায় ওই ব্রত করা হয় বলে ভাজুইকে ‘শসপাতার ব্রত’ও বলা হয়। ‘শস’ অর্থে শস্য আর ‘পাতা’ অর্থে বিছানো। পাত্রে শস্য বিছিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোই ওই ব্রতের উদ্দেশ্য।সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে ‘#ইন্দধ্বজ’ উৎসব বা #ইন্দপুজোর পরের দিন হয় ভাজু ব্রতের সূচনা। সেই হিসেবে ইন্দপুজোর পরিবর্তনের সঙ্গে ভাজুব্রতেরও সময়কালের হেরফের হয়। সাধারণত ছোট মেয়েরাই ওই ব্রত পালন করে থাকে। তবে কোথাও কোথাও বিবাহিত মেয়েদের মধ্যেও ওই ব্রত পালনের চল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ব্রত ‘বড়ো ভাজুই’ আর বাচ্চাদের ব্রত ‘ছোট ভাজুই’ হিসেবে পরিচিত হয়।
পশ্চিমবাংলায় #তুষ_তুষালী নামে একটি মেয়েলি ব্রত রয়েছে। অগ্রহায়ন মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে আরম্ভ করে পৌষ মাসের সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত এই ব্রত উদযাপন করতে হয় । পুজার পদ্ধতি সম্পর্কে আশুতোষ মহাশয় বলেছেন “এতে গোবর সঙ্গে তুষ মিশিয়ে কতগুলো নাড়ু তৈরি করা হয়। তারপর তাকে দূর্বা দিয়ে পুজো করার পর তা একটি মাটির মালসায় তুলে রাখতে হয়। তারপর মকর সংক্রান্তির দিন সেই গোবরের নাড়ু সমেত মালসা গুলো মেয়েরা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে কোন পুকুর কিংবা নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় ।কোন কোন জেলায় ছড়া বোলে নাড়ু গুলোর পুজো করা হয়।”ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, “তুষ তুষালী ব্রত কৃষি সংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা”।
পৌষ মাস হলো লক্ষী মাস। তুষ মানে ধানের খোসা। শস্যের সাথে সম্পর্কিত । শস্য কৃষি পরিবারের ঘরে তোলার পর এই পূজা হয় । কাজেই এ লক্ষ্মী পূজা ।অনেকে মনে করে #টুসু দেবী গঙ্গা দেবীর পূজা।
বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষশাখায় রাখি পরানোর কর্মোৎসব, #করমপরব বা করমডোর যা ভারতের বহু জনজাতি এখনও নিঃশব্দে পালন করে চলেছেন।ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমীতে দূর্বা ঘাসের পুজোর পর একাদশীতে অঙ্কুরিত বীজ, করমগাছ পুঁতে, শাল(সারিকরম) ও অরণ্যমায়ের বন্দনা করে মেয়েরা প্রথমে করমডালে ও পরে পরস্পরের হাতে রাখি বাঁধে।এই কর্মরাখির সখীরা বনে জঙ্গলে পরস্পরকে রক্ষা করে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, রাখিবন্ধন, শিল্পোৎসবের মিলিত আদিরূপ।আমরা ভুলে যাই যে মা দুর্গা নবপত্রিকা শাকম্ভরী অরণ্য মা বা জাহেরা (সাঁওতাল), সারণা (ওঁরাও) বা ধরতী মায়ে (মুন্ডা)।বিল্ববৃক্ষ মূলে ডালিম, কদলী, কচু শস্য দূর্বাঘাস-অথবা চার-পাঁচ স্তরে বনস্পতি বৃক্ষ গুল্ম বীরুৎলতা নিয়ে মাটি পাথর আঁকড়ে ধরা মা (সিংহ, হাতি, ময়ূর, হাঁস, পেঁচা, সর্প, মহিষ, নীলকণ্ঠ পাখি প্রাণিকুল নিয়ে দশ হাতে দশ দিক থেকে, অসুর থেকে অশুভ থেকে সৃষ্টি রক্ষা করে চলেছেন)।
করম পরবে দেশজ গুল্ম ও বৃক্ষ রোপণে এই অরণ্যউৎসবের সূচনা হত, যা এখন শুধু করম গাছের খুঁটি বা দুর্গাপূজার কলাবউ পোঁতায় সীমাবদ্ধ।
বীজবপন, ধানরোপণ, বৃক্ষরোপণের কর্ম পরব বিলাপগাথা নয়। করম বিনতির প্রাচীন গান— ‘সিংচান্দ, বৃষ্টি, সবুজ ধানখেতের হাওয়ায়, অরণ্য মায়ের দয়ায় করম ধরম দু’ভাই পেল জীবন’। ‘প্রথম বৃষ্টিতে অঙ্কুরিত গাছ, গত বছরে জন্মানো গাছের পাতারা দুলছে। এসো, ওকে জাহের থানে (পবিত্র ভূমি)-তে পুঁতি’। “সবুজ অরণ্যের শান্তির হাওয়া, শিশুদের দয়া কর’। ‘আম জাম কাঁঠাল গাছে পাকা পাকা ফল, খেয়ে অরণ্য মাকে পুজো করি নাচি গাই’। ‘জলে ভেসে গেছে মাঠ, ঘরে বসে ঝুড়ি বোনা এখন আমার করম’।
‘করমগাছ, তোমার কুঠারে ডালপালা কাটব, শীতের জ্বালানি ঘরে তুলব। ডগা কাটলে গাছ ঝোপড়া, পাশে কাটলে লম্বা’। ‘শহরে লোকে আমায় দেখে, অরণ্যে যখন ফিরি, জাহেরা (অরণ্যমা) আমায় দেখে’। ‘জীবন কম হলে, জাহেরা দেয় জীবন আর শান্তি’।
অথর্ববেদের পৃথিবীত সূক্তে(১২/১/৬) বলা হয়েছে
“বিশ্বমভরা বসুধানী প্রতিষ্ঠা হিরন্যবক্ষা জগতো নিবেসিনী।বৈশ্বনরং বিভ্রতি ভূমিরগ্নিমিন্দ্র ঋষভা দ্রবিনেনোদধাতু।”
শ্রাবণে আমন ধান রোপণ এবং পাট জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত দৃশ্য।
খনার বচনে রয়েছে,
‘শ্রাবণের পুরো, ভাদ্রের বারো/ধান্য রোপণ যতো পারো’,
‘আষাঢ় কাড়ান নামকে/ শ্রাবণে কাড়ান ধানকে’
‘পান পুঁড়লে শ্রাবণে/ খেয়ে না ফুরায় বারণে’
‘বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলুদ রুইবে/ অন্য কাজ ফেলিয়া থুইবে? আষাঢ়-শ্রাবণে নিড়াই মাটি/ ভাদরে নিজাইয়া করবে খাঁটি’
“ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, বিফল জনম তার নাহি যার চাষ”- মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের গৌরব কবি কংকন মুকুন্দরাম প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে বিখ্যাত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে এভাবেই অগ্রহায়ণ বন্দনায় চাষের কথা বলতে মত্ত হন। সে যুগের কৃষিজীবী বাংলার গোলাঘর এই মাসে ধানে ধানে পূর্ণ হয়ে উঠতো। অর্ধ-সহস্রাব্দ পরের বাংলার চিত্রও সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা মাত্র যেন। সুজলা-সুফলা বাংলা তথা ভারতের প্রধান কৃষি ফসল ধান আর তা থেকে প্রক্রিয়াজাতকৃত ভাত প্রধান খাদ্য।বাঙালি হিন্দু সমাজের বিশ্বাস অণুযায়ী, অগ্রহায়ণ মাস বিবাহের পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। পশ্চিমবঙ্গেরলোকসমাজে অগ্রহায়ণ মাসকে ‘লক্ষ্মীর মাস’ মনে করা হয়। এই কারণে এই মাসেই নবান্ন উৎসব ও লক্ষ্মীপূজার বিশেষ আয়োজন করা হয়। আদিকাল থেকেই #নবান্ন উৎসব উদযাপন করতো গ্রাম বাংলা। ধান কাটা সারা হলে গ্রামবাংলায় পড়বে নিমন্ত্রণ এর ধুম। কৃষানী বধূ ও কন্যারা খেজুর রসে নতুন পায়েশ, নকশী পিঠা ইত্যাদি তৈরি করবে। এসব বিলোবে পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের। এটিই #মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণের চিরায়ত ঐতিহ্য।ঠিক তেমনি রাঢ় অঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামে পূজা হয় ধানশুয়রী দেবীর। অবাক লাগছে? ইনি বাস্তু দেবি। যেমন, ক্ষেত্রপাল , আখিন দুয়ারি , বন বুড়ি তেমনি ধান শুয়ারী। অগ্রহায়ণের সময় ধান কাটার আগের এইসব ক্ষেতে র বাস্তু দেবদেবীর পূজা প্রদান করা হয়।
এবার আসি মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য মধ্যযুগীয় কাব্য গুলিতে। এই গুলি পড়লে জানা যায় বাঙালী জীবনে ধানকে কত গুরুত্ব প্রদান করা হত।
#চৈতন্যভাগবতে’ বৃন্দাবন দাস লিখেছেন :
এ শিশু জন্মিলে মাত্র সর্ব দেশে দেশে।
দুর্ভিক্ষ ঘুচিল বৃষ্টি পাইল কৃষকে॥
সেকালেও ধানের দাম ওঠা-নামা করতো।
কহো বলে যদি ধান্যে কিছু মূল্য চড়ে।
তবে এগুলোর ধরি কিলাইমু ঘাড়ে॥
সেকালের বাংলা সাহিত্যে কৃষি কথার ঘাটি চিত্র পাই ‘মঙ্গলকাব্যে।’ ‘মনসামঙ্গলে’ মনসা, ‘ চন্ডীমঙ্গলে’ চন্ডী, ধর্মমঙ্গলে’ ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচার কথাই বড় কথা। কিন্তু তারই মাঝে মাঝে কবিগণ কৃষিকেন্দ্রিক বাঙালি জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন। দেবী #মনসার পুজো হচ্ছে। ঘট বসানো হয়েছে। কবি হরিদত্ত লিখলেন :
‘হেঁটে ধান্যের সরা/ উপরে বিচিত্র ঝারা/ সে না ঘটে চন্দন দিয়া।’
পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয়গুপ্ত তার ‘#মনসামঙ্গলে’ এক দরিদ্র ক্ষেতমজুরের কথা বলেছেন। বলেছেন তার মালিকের কথাও। সম্পন্ন চাষি জনাই ম-ল। সে নিজ হাতে চাষ করতো না। তার চাষ করে দেয় চাঁদ বেনে। চাঁদের বড় অভাব। সামান্য ভাতের জন্যে সে এল জগাই এর কাছে। জগাই বলল :
এত শুনি ম-লিয়া কহে চাঁদের কাছে।
আগে কর্ম করিবার ভাত পাবে পাছে॥
এতেক ভাবিয়া ম-ল মনে মনে পাছি।
ধান্য নিড়াইতে চান্দের হাতে দিলো কাঁচি॥
ফসল নষ্টের কথাও কবি মুকুন্দ বলেছেন। প্রচন্ডবৃষ্টিতে কলিঙ্গের ক্ষেতে ফসল হেজে যাচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বড় দুঃখের কথা নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা না দিলে অত্যাচার নেমে আসবে। কবি লিখছেন :
বুলান ম-ল বলে শুনে মোরে ভাই।
হাজিল বিলের শস্য তারে না ডরাই॥
মসহাত করিল রাজা দিয়া ঘাট দড়ি।
প্রথম আঘনে চাহি তিন তেহাই কড়ি॥
কৃষিজীবী সমাজের আরও বিবিধ চিত্র পাই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের কাব্য ‘#শিবায়ণে’। সেখানে বলা হয়েছে- চাষাবাদেও নানা ঝামেলা আছে। নানা উদ্বেগ আছে। তাই শিব বলেছে, চাষ না করে ব্যবসা করাই ভাল। কিন্তু স্ত্রী পার্বতী বুঝিয়েছে যে ‘পুঁজি আর প্রবঞ্চনা বাণিজ্যের মূল।’ তাই শিব চাষই করলো। ইন্দ্রের কাছে জমির পাট্টা নিলো। কুবেরের কাছে বীজধান নিলো। শূল ভেঙে হাল তৈরির হলো। বাঘ ও বৃষ জুড়ে লাঙ্গল চলল। মাঘের বৃষ্টিতে ধান রোপণ করা হলো। বৈশাখে জেগে উঠল কচি ধান। সেই ধান দেখে শিবের আনন্দের সীমা রইল না :
হর্ষ হৈয়া হর ধান্য দেখে অবিরাম॥
ধান দেখে সে ক্ষেতেই পড়ে রইল। সংসারের কথা ভুলেই গেল …. ধান্য দেখ্যা রহিল পাসর্যা পরিজন॥
তারপর থেকে শিব মেতে গেল চাষে। এবিষয়ে তার যোগ্য অনুচর হলো ভীম। ভীম সারাবছর চাষে খাটতে লাগল। কখনও সে হাল বাইছে, কখনও ধান রুইছে, কখনও ধান কাটছে, কখনও ধান ঝাড়ছে, কখনও সে ধান বেঁধে রাখছে পুড়ায়।
‘#ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের ধর্মঠাকুর নিজেই কৃষি দেবতা। বৃষ্টির দেবতাও। তার কৃপায় কৃষক ভাল ফসল পায়। সপ্তদশ শতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী তার ‘ধর্মমঙ্গলে’ ধান, কাপাস, কলাই ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। মানিকরাম গাঙ্গুলি বিপর্যস্ত কৃষি জীবনের স্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন। তিনি বলেছেন যে
, মাহুদ্যা রাজা হয়ে
জবুল জমির জমা বেশি করে ধরে। যে না দেয় তার সদ্য গুণাগার করে॥
ক্ষেতে হাল খন্দ সে বেচে লয় সব। বিব্রত হইল প্রজার পেয়ে আধি ভব॥
দেশ ছেড়ে দেশান্তরে পালাইয়া গেল। শহর নগর গ্রাম শূন্যময় হল॥
‘#শূন্যপুরাণে’ও চাষের অনেক কথা। এখানেও চাষি শিব। সে মুগ তিল সরষে আখ কাপাস প্রভৃতি চাষ করছে। এখানেও তাকে সাহায্য করছে ভীম, কিংবা হনুমান। এখানেও ভীম হাল বাইছে ধান রুইছে, ধান কাটছে, ধান ঝাড়ছে।
চাষ করিতে যায় ভোলানাথ বল্লুকা কুলে গো। কোথায় আছো গৌরী দেবী দাওনা শঙ্খের ধ্বনি গো।। আগে চলে দেব ভোলানাথ শেষে নারদ গো। বল্লুকা কুলে আসি তারা উপনীত হলো গো ।
হাল জোড়ে হাল জোড়ে দেব ভোলানাথ গো ।সিংগা বাজায় দেব ভোলা বাঁশের উপর বসে গো।।এক চাষ , দুই চাষ, তিন চাষ দিল গো।।।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবীর কেন্দ্রীক লোকায়ত পালা গান গুলির মধ্যে বিশিষ্ট পালা গান হল চাষী মহাদেব। এই দেবপালার অন্তর্গত। বাংলা তথা ভারতের লৌকিক সমাজে মহাদেব কৃষি সহায়ক দেবতা হিসেবে পরিচিত যুগ থেকে যুগান্তরে।
সরাসরি চাষের কথা না থাকলেও ‘#শাক্ত পদাবলী’তে চাষেরই শ্রেষ্ঠ কথাটি রূপকাশ্রিত হয়েছে-
মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।।
কালীনামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না।
সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।
অদ্য অব্দশতান্তে বা, ফসল বাজাপ্ত হবে জান না।
লক্ষ্মণ সেনের আনুলিয়া, তর্পণ দিঘি ,গোবিন্দপুর ও শক্তিপুর এই চারিটি তাম্রশাসনে একটি #মঙ্গলাচরণ শ্লোক আছে, যেটিতে ধান্যপজীবী বাঙালীর আন্তরিক আকুতি ধ্বনিত হয়েছে বলে মনে করলে অনৈতিহাসিক উক্তি করা হয়না ।
বিদ্যুদ্ যত্র মণিদ্যুতিঃ ফণিপতের্বালেন্দুরিন্দ্রায়ুধংবারি স্বর্গতরঙ্গিনী সিতশিরোমালা বলাকাবলিঃ।ধ্যানাভ্যাসসমীরনোপনিহিতঃ শ্রেয়হনঙ্কুরোদ্ভূতয়েভূয়াদ বঃ স ভবার্তিতাপভিদুরঃ শম্ভোঃ কর্পদ্দাম্বুদঃ।।
ফণিপতির মণিদ্যুতি যাহাতে বিদ্যুৎ স্বরূপ , বালেন্দু ইন্দ্রধনু স্বরূপ, স্বর্গতরঙ্গিনী বারি স্বরূপ, শ্বেতকপালমালা বলাকা স্বরূপ, যাহা ধ্যানাভ্যাসরূপ সমীরণ দ্বারা চালিত এবং যাহা ভবার্তিতাপভেদকারী, শম্ভুর এমন কদর্পরূপ অম্বুদ তোমাদের শ্রেয় শস্যের অঙ্কুরোদগমের কারণ হউক।
লক্ষণসেনের আনুলিয়া শাসনে বহু ব্রাহ্মনকে গ্রাম দানের উল্লেখ আছে । এইসব গ্রাম ছিল নানা শস্যক্ষেত্র ও উপবন শোভায় অলঙ্কৃত। প্রচুর পরিমাণে শালিধান্য উৎপাদন হত। কেশব সেনের ইদলপুর শাসনেও দেখা যাচ্ছে রাজা অনেক ব্রাহ্মণকে বহু গ্রাম দান করেছিলেন। এসব গ্রামে সুন্দর বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ছিল , সে ক্ষেত্রে চমৎকার ধান উৎপন্ন হতো।
#রামচরিত কাব্যের কবি প্রশস্তিতে ধানের খলা বা মাড়াই স্থানের ইঙ্গিত আছে এবং গোলাকার সাজানো কাটা ধানের উপর দিয়ে গরু বা বলদ ঘুরে ঘুরে হেঁটে কি করে ধান মাড়াই করত তার উল্লেখ আছে। কালিদাসের #রঘুবংশ কাব্যে ধান উৎপাটন করে আবার রোপন করার পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা আছে। ইক্ষুক্ষেত্রের ছায়ায় বসে কৃষক রমণীগনের শালী ধান পাহারা দেবার কথা বলা হয়েছে।
ধান বিশেষ করে #শালি ধান এবং ইক্ষু সম্পর্কে কবির কল্পনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছে। শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত নামক সংকলন গ্রন্থে বিভিন্ন বাঙালি কবির জলবায়ু প্রসঙ্গে দুজন বাঙালি কবি রচিত দুটি শ্লোকে বর্ষায় ধানক্ষেত, হেমন্তের শালি ধানের স্তুপ, আখ মাড়াই কল ইত্যাদি নিয়ে যে কবির কল্পনা বিস্তারিত হয়েছে তা অনবদ্য। এঁদের একজন হলেন কবি জয়দেবের শ্যালক যোগেশ্বর ,অন্য জন অজ্ঞাত নামা। সেই অজ্ঞাত নামা কবির মধুর বাস্তব চিত্রের কবিতাটি উল্লেখ করলাম।
শালিচ্ছেদ- সমৃদ্ধ হালিকাগৃহাঃ সংসৃষ্ট নীলোৎপল-স্নিগ্ধ শ্যাম যব প্ররোহ নিবিড়ব্যাদীর্ঘ সীমোদেরাঃ।মোদন্তে পরিবৃত্ত ধেন্বনডুহচ্চাগহাঃ পলালৈরনবৈঃসনসক্ত ধ্বনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রাম্য গুড়ামোদিনঃ।।
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয়;
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময়
চারিদিকে এখন সকাল—
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;
মাঠের ঘাসের ’পরে শৈশবের ঘ্রাণ—
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান।
এবার আমি কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত ধানের নাম বলবো, তাদের জাতের নাম বলবো এবং তাদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করবো…. এই সমস্ত ধান কিছু চাষ হয় কিছু লুপ্ত হয়ে এসেছে আর আর কিছু লুপ্ত হয়ে গেছে ।
১. খরা সহনশীল ধান : এই ধরনের ধানের জাতের নাম কেলাস, ভূতমুড়ি, জটা, গোড়া, কাখড়ি, কেলে, আঁশকাটা , কটকি, আসনালয়। এই ধরনের ধান কিছুদিন বৃষ্টি না হলেও বেঁচে থাকে। আউশ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অল্প খেলে পেট ভরে যায় ।
২. গভীর জলের ধান , জলের সঙ্গে গাছ বাড়ে : লক্ষ্মীদীঘল, মেঘি, কাটারাঙি, কলামোচা , শোলে , হোগলা, হড়মানোনা ।বেশিরভাগ মোটা চাল, মুড়ি ভালো হয় ।এই সমস্ত ধানের সঙ্গে মাছ, গেঁরিগুগলি চাষ করা যায় ।
৩. গভীর জলে ৫ থেকে ১৫ দিন ডুবে থাকতে পারে : লাঙ্গলমুঠি, কৈজুরী, ব্যাত, মাছরাঙা, ডুবরাজ , পানিধান ,নারায়নকামিনী। ধানগুলো বেশিরভাগ মোটা চালের হয়। মুড়ি ভালো হয় এসব ধান থেকে । ১০ থেকে ২২ ফুট খড় হয়।
৪. বন্যার পর দেরিতে লাগানো ধান : কামিনীভোগ, হোগলা, গানজিয়া ।আশ্বিন মাসে ধান লাগিয়ে পৌষ মাসে কাটা হয়।
৫. মাঝারি সরু চাল : চামরমনি,দুধেশ্বর ,বলরামশাল, ঝিঙাশাল, কাটারিভোগ। এগুলো সরু চাল। সুস্বাদু । ৯ থেকে ১৩ মন বিঘায় ফলন হয় । খড় ভালো পাওয়া যায়।
৬. আউশ ধান : বাঁশগজাল, কেলেবোরো , পরী, ষাটিয়া, আউশ পাঁজালি। অনেক চালের খোসার রং লাল ।ভিটামিন ও লোহা সমৃদ্ধ । পুষ্টিকর।
৭. দেশি বোরো : লাঠশাল ,গুলিগাঁটি , লালবোরো , কালোবোরো , দুধেশ্বর। অনেক চাল লাল। এক কালি করে চারা লাগিয়ের চাষ করলে ভালো ।
৮. সুগন্ধী ধান : কলোনুনিয়া, লালাবাদশাভোগ, গোবিন্দভোগ, কালোজিরা, তুলাইপাঞ্জি , রাধতিলক । ছোট, সামান্য মোটা।পায়েস , ভোগের জন্য খুব ভালো।
৯. বেশি ফলনের ধান : কেরালা সুন্দরী, আঁশফল , বহুরূপী , রাবনশাল , বাংলা পাটনাই, আদান শিল্পা। ১৬ থেকে ২০ বিঘায় ফলন। আদান শিল্পা খুবই সুগন্ধী।বিঘায় ফলন ১৪ মন।
১০. স্বল্প মেয়াদী ধান : পারি , পারা , কেলাস , মুগোজাই , ডুবরাজ, তুলসা, ষাটিয়া, শেষফল। ৮০ থেকে ১১০ দিন লাগে। সব দেশিধান নুইয়ে পড়ে না।
১১. খিচুড়ি চাল : বাঁশফুল । এটি সুগন্ধী। খিচুড়ি রান্নার সময় চালটি লম্বালম্বি ভাবে ভেঙে যায়।
১২. লবণ সহনশীল ধান : তালমুগুর, নোনাবখরা, নোনাকাটি, SR26B , ক্যানিং ৭ , নোনাশাল। লবণাক্ত জমিতে , সুন্দরবন অঞ্চলে এই ধান চাষ করা যায়।
১৩. ১০০ পাশকাঠি যুক্ত : মেলহিটে । খুব বিস্ময়কর ধান। নাগাল্যান্ড এ ধাপ চাষে এই ধানের পাশকাঠি হয় ১০০ থেকে ১৫০ টি। এক কালি করে লাগায়।
এর মধ্যে বলতে গেলে বেশ কিছু ধানই কৃষকেরা আর চাষ করেন না। নীচে কিছু ধানের নাম বলব যেগুলো লুপ্ত প্রায় বা লুপ্ত হয়ে গেছে:
লম্বা শুঁড়ওয়ালা শ্যামলা রঙা বোরো ধান, জাবরা , পানিকলস, ভাসামানিক, কুমোর কানাই, আবিরমান, কাখুড়িয়া, পাটনাই, রূপশাল ,ঝিঙাশাল, কাঁকুরবিচি, জংলীজটা, গন্ধমালতি, বাদশাভোগ, কবিরাজশাল, বোম্বাই মুগাই, সীতাভোগ, বাদকলমকাঠি, সীতাশাল, রঘুশাল, ভীমশাল, নোনা, সাঁচি, বেলমুচি, ভুতিয়া, অগ্নিবান, রাশপাঁজর, লক্ষ্মীকাজল, ছাতিপাঁজর, তিলক কাছাড়ি, কামোদ, বাঘনখ, জামাই নাড়ু, তালমীর, মেঘনাথ, পায়রা পালক, খেঁজুরকান্দি, ধনরাজ, মধুমালতি, মাল শিরা, তুলাইপঞ্জি, কালাভাত, জলড্যাপা, পাইজাম, ছোটডাচ, বিরল, পঙ্খীরাজ, রাধতিলক,মিনি কবিরাজ, হলদিজাম, ফুলপাকরি, বচিধান, কালোনুনিয়া, কাটারিভোগ, বাহাদুর ভোগ ইত্যাদি……
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে –
হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ –
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার ইতিহাস : আদি পর্ব
বাংলার সংস্কৃতি : লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়