বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে। স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা, নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সৃষ্টি এবং মনুষ্য জাতির মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে সেই জন্যপ্রকৃতির সংরক্ষণ করাটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলে জানিয়েছন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সরসঙ্ঘচালক ডা: মোহন ভাগবত।ভারতীয় সভ্যতায় প্রকৃতির গুরুত্বকে সম্মান দিতে এবং মানুষকে সে প্রকৃতি রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে একটি পরিবেশ সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘হিন্দু আধ্যাত্মিক এবং সেবা ফাউন্ডেশন।বাংলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মনোরম। বছরের বিভিম্ন সময় প্রকৃতিদেবী বিভিম্নভাবে তার রূপ পরিবর্তন করেন। সেই পরিবর্তনকে লক্ষ্য করে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে বারো মাসে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই ছয় ভাগকেই ষড়ঋতু বলা হয়। ছয় ঋতু বা বারো মাসেই বাঙালি হিন্দুদের বিভিম্ন পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। সে জন্য বলা হয়, বাঙালি হিন্দুদের বারো মাসে তের পার্বণ। হিন্দুর সব পূজা-পার্বণের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ পার্বণ বা উৎসব দুর্গাপূজা শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয়। সে জন্য একে শারদীয় উৎসব হিসেবেও অভিহিত করা হয়। দুর্গা মাতৃরূপে মহাশক্তি মহামায়া, দেবী যোগমায়া। দেবী শুধু মানবকুলেরই আরাধ্য নন, তিনি দেবতাদেরও আরাধ্য। তিনি নিখিল বিশ্বের অধিশ্বরী, ইষ্ট ফলদায়িনী, সর্বদর্শিনী। তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কারিণী। তিনি সত্যের রক্ষাকর্তা, দুষ্টের বিনাশকারিণী। আদিকালে ভগবান বিষুষ্ণ ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির মানসে দেবী মহাশক্তির ধ্যান করেন। বিষুষ্ণ যোগনিদ্রায় নিরতা, তার নাভীপদ্মে ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রতীক্ষায় রত। এমন সময় বিষুষ্ণর কর্ণমূল থেকে নির্গত মধু-কৈটভ যখন ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত, তখন ব্রহ্মা আত্মরক্ষার্থে মহাদেবী, মহাশক্তি যোগমায়া দুর্গার স্তব করেন। পরবর্তীকালে কল্পে কল্পে দেবী স্তবের মাধ্যমেই পূজিতা হয়ে এসেছেন। যুগে যুগে মুনি-ঋষিগণ ধ্যান, স্তব ও যজ্ঞের মাধ্যমে দেবীর আরাধনা করেছেন।
মাতৃবন্দনার ইতিহাস যে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আছে তার প্রমাণ আমরা বিভিম্ন ধর্মগ্রন্থে পাই। প্রাচীন সভ্যতায় পৃথিবীর বিভিম্ন স্থানে বিভিম্ন নামে ও বিভিম্ন রূপে মাতৃ আরাধনার নিদর্শন পাওয়া গেছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিম্ন অঞ্চলে বিভিম্ন নামে ও বিভিম্ন মূর্তিতে মহাশক্তি মহামায়া পূজিতা হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। ধর্মীয় বর্ণনা মতে, দেবী ১০৮ নামে অভিহিতা। যেমন- আদ্যাশক্তি, যোগমায়া, মহামায়া, বাসন্তী, কাত্যায়নী, দুর্গা, চামুন্ডা, শিরদুতি, গৌরী, কৌষিকা, ছিম্নমস্তা, অম্বিকা, জগদম্বা, শিবানী, পার্বতী, উমা, বিশালাক্ষী ইত্যাদি। বিভিম্ন বেদ-পুরাণের ভাষ্যে দেখা যায়, দেবী কখনও দ্বিভুজা, কখনও চতুর্ভুজা, কখনও অষ্টভুজা, কখনও দশভুজা আবার কখনওবা অষ্টাদশভুজা। ভারতবর্ষের বাইরে বিভিম্ন দেশে হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকেই দুর্গারই অনুরূপ দেবীপূজার প্রচলন ছিল। যেমন- গ্রিসের রুহীদেবী, এশিয়া মাইনরের ‘শিবিলি দেবী’, মিলরের ‘ইন্থাদেবী’, ক্রেটদ্বীপের ‘সিংহবাহিনী দেবী’, জাপানের ‘চনাষ্ঠিদেবী’, চীনের ক্যান্টন শহরে ‘শতভুজাদেবী’। এ দেবীদের আকৃতি প্রায় দুর্গাদেবীর অনুরূপ।
বাংলাদেশে দেবীপূজার ইতিহাস বহু প্রাচীন। ঐতিহাসিকগণের মতে, সহস্রাধিক বছরকাল আগে থেকে বাংলাদেশে মাতৃদেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। যদিও সেগুলো স্তব, ধ্যান ও যজ্ঞের মাধ্যমে। আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের যেরূপে মাকে আরাধনা করি তার প্রবর্তক রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। রাজপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শ ও বিধান অনুযায়ী ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ৯ লাখ (মতান্তরে সাড়ে আট লাখ) টাকা ব্যয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে মহাসমারোহ সর্বপ্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করেন। এ উপলক্ষে তিনি তার রাজ্যের ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব প্রজাকে নববস্ত্র ও কয়েক দিনব্যাপী প্রসাদ বিতরণে আপ্যায়ন করেন নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য। রাজা কংসনারায়ণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজশাহীর ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণও ৯ লাখ টাকা ব্যয় করে বসন্তকালে বাসন্তী পূজা করেন। তারপর থেকেই বাংলাদেশে রাজা-জমিদাররা মহাসমারোহে দুর্গাপূজা করে আসছিলেন। এ পূজা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ততোধিক জাঁকজমকপূর্ণ বলে সাধারণের মধ্যে এর প্রচলন ছিল না। ইংরেজ শাসনকালে তাদের কৃপায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কলকাতাকেন্দ্রিক বড়লোকদের মধ্যেও এ পূজার প্রচলন ছিল না। তবে এ পূজা ধীরে ধীরে জনসাধারণের মধ্যে প্রবেশ করে। ১৭৯০ সালে শান্তিপুরে (নদীয়া-পশ্চিমবঙ্গ) ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলিত হয়ে প্রথম এ পূজার প্রচলন করেন। তখন থেকেই এটি বারোয়ারি (বার ইয়ারি অর্থাৎ বার বন্ধু) পূজারূপে আখ্যা পায়। মাতৃপূজা সার্বজনীনতা প্রাপ্ত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম যে দুর্গাপূজা করেন সে পূজায় তিনি উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব সব মানুষকে সম্পৃক্ত করেন। তখন থেকেই তা সার্বজনীনতা লাভ করে এবং বর্তমানে আমরা সেই সার্বজনীন মাতৃবন্দনাই করে থাকি।
একজন মায়ের সব সন্তানই সমশ্রেণির হয় না। কেউ ধনী, কেই গরিব, কেউ বিদ্বান, কেউ মূর্খ হয়। কিন্তু মাতৃস্টেম্নহ সব সন্তানের প্রতিই সমান। মাতৃপীযূষ সবাই সমভাবেই পায়। তেমনই আমাদের এই মাতৃদেবী তার সব সন্তানকে সমস্টেম্নহে দেখেন। তিনি কাউকে অধিক ভালোবাসেন না আবার কাউকে ঘৃণাও করেন না। তাই আমরা দেখতে পাই মায়ের পূজায় যেমন লাগছে রাজদ্বারের মাটি, তেমনি সমাজের ঘৃণ্য পতিতা দুয়ারের মাটি না হলেও মায়ের পূজা পূর্ণতা পায় না। মায়ের পূজার যেমন সংশ্নিষ্টতা থাকে সমাজশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, তেমনি সংশ্নিষ্ট থাকে কুম্ভকার, কর্মকার, নরসুন্দর, বাদ্যকার, ফুলমালী, ভুঁইমালী, মালাকারসহ বহু শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাতৃপূজায় যে প্রসাদ বিতরণ করা হয় তার তাৎপর্য হচ্ছে যে গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষ তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার সারা বছর খাদ্য ফলমূলাদি পায় না, পূজার কয়েক দিন সামান্য হলেও তারা তা পাচ্ছে। এতে একদিনে যেমন দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষায় কিছুটা হলেও তারা সহযোগিতা পাচ্ছে। তেমনি সমাজের সব স্তরের লোকের মিলনের ফলে সামাজিক সাম্য বিরাজ করছে। এভাবেই মাতৃপূজা আমাদের সার্বজনীন সামাজিক আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করছে।
বিশ্ব আজ সন্ত্রাসকবলিত। নররূপী অসুরকুলের তান্ডবে সারাবিশ্ব আজ প্রকম্পিত। এই সন্ত্রাসকবলিত বিশ্বে মা আসছেন তার শান্তির বারতা নিয়ে। আসুন, আমরা সমবেতভাবে মায়ের পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে প্রার্থনা করি, যেন কৃপাময়ী মায়ের কৃপায় নব অবয়বপ্রাপ্ত অসুরকুল ধ্বংস হয়। বসুন্ধরা আবার যেন অমিয় শান্তিধারা বরিষণে সুষমামন্ডিত হয়ে ওঠে।
এ পূজা আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমাদের সমগ্র চেতনায় সংযুক্ত হয়ে মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো আমাদের চৈতন্য সত্তাকে আলোড়িত করে তোলে। এ পূজা আমাদের সমগ্র জাতিসত্তায় মনুষ্যত্বের জাগরণ সৃষ্টি করে। এর প্রতিটি মন্ত্রে আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে আরম্ভ করে বিশ্বজীবনের মঙ্গল বার্তা উচ্চারিত হয়ে থাকে। আমাদের এ পূজা মানবকল্যাণের পূজা, বিশ্ব কল্যাণের পূজা।
আজ আমাদের সমাজের সর্বত্রই দেখা যায় অমঙ্গলের ঘনঘটা। বাতাসের প্রতিকূল স্রোতে আজ আমরা যেন এক অঘ্নিকুন্ডে বাস করছি। চারদিকে অশুভ শক্তির প্রবল উত্তাপে আমরা দিশেহারা। কীভাবে এ অঘ্নিবলয় থেকে বের হওয়া যায়- পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সমাজের সর্বত্রই দেখা যায়, ধর্মের নামে চলছে অধর্ম। কল্যাণের নামে চলছে অকল্যাণ। কথা ও কাজের কোনো মিল নেই। আমরা প্রেমের কথা বলি, কিন্তু হূদয়ে বিন্দুমাত্র প্রেম নেই; ভালোবাসার কথা বলি, কিন্তু ভালোবাসার চিহ্নমাত্র নেই, ভক্তির কথা বলি- কিন্তু তিলমাত্র ভক্তি নেই। আমাদের আছে শুধু সংকীর্ণ মন। সেই মন যেন মাকড়সার জালের বিস্তার করে আছে লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, অকৃতজ্ঞতা, পঙ্কিলতা, জিঘাংসা, কৃতঘ্নতা ইত্যাদিতে।
আজ আমাদের চারদিকে অশান্তির আগুন বিরাজ করছে- এর মূল কারণ কী? এর মূলে রয়েছে আমাদের হূদয়ে অশুভ শক্তির ছায়া। যার ফলে আমাদের মনুষ্যত্বকে সমূলে বিনাশ করে ফেলেছে। এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্যই মা আনন্দময়ী দুর্গার ধরাধামে আগমন। মা দুর্গা স্বহস্তে অসুর শক্তিকে বিনাশ করে সবার হূদয়ে আনন্দের জোয়ার ভাঙানোর জন্য মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হন।
অশুভ শক্তির উত্থানকে ধ্বংস করে যিনি সব দুঃখ, দুর্গতি, শত্রুভয় নাশ করেন তিনিই হচ্ছেন দুর্গা। জগজ্জননী, দুর্গতিনাশিনী মায়ের কাছে আমাদের নিবেদিত অর্ঘ্য হচ্ছে, দুর্গোৎসবের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমাদের জন্য বয়ে আনে শান্তি, আনন্দ, সহিষুষ্ণতা ও সম্প্রীতির অমোঘ বন্ধন।
একবার আবার আমাদের জড়ের সাথে যুক্ত হয়ে আমরা প্রকৃতি বন্দন করি।
১) প্রকৃতি পূজা করার শত শত বছর ধরে আমাদের পরম্পরা চলে আসছে।
২) আমাদের বিশ্বাস যে সমস্ত মানুষ,সমস্ত জীব, এমন কি বৃক্ষ- লতাও আমাদের কাছে পূজনীয়।
৩) কিন্তু প্রকৃতির দোহনের জন্য সন্তুলন নষ্ট হয়ে গেছে।
৪) এর বিপরীত প্রভাবও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
৫) বৃক্ষ – লতার পুজো করে প্রকৃতির আরাধনা করে আমরা তার রক্ষা করার সংকল্প নেই।
অখিল ভারতীয় স্তরে
পর্যাবরণ সংরক্ষণ গতিবিধি তথা হিন্দু আধ্যাত্মিক এবং সেবা ফাউন্ডেশন দ্বারা আয়োজিত কার্যক্রম
প্রকৃতি বন্দন
২৯ আগস্ট ,২০২১
সময়: সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা
রবিবার
নিজের বাড়িতে অথবা পাড়ায় যে কোন গাছ অথবা টবে লাগানো চারা গাছের পুজো করতে হবে। আপনি নুতন চারা গাছও লাগাতে পারেন।
Register for Prakriti Vandana/ প্রকৃতি বন্দন রেজিস্ট্রেশন লিংক
https://bit.ly/3lhlkBi
sankalp. paryavaransanrankshan. org