পর্ব ৪
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস একটি সুদীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ঔপনিবেশিকতার সাক্ষী হয়ে রয়েছে । কিন্তু তারপরেও তারা আজও সনাতনী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে ,এটি সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ঘটনা । এ প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ” রবীন্দ্রনাথসংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যমদেশ ” গ্রন্থটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিন মাসব্যাপী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলি ভ্রমণ করেছিলেন। তখন তাঁরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং সামাজিক তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত গ্রন্থটি অধ্যয়ন করলে জানতে পারা যায়, ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ডাচদের বহু অংশে মিল থাকলেও একটি বিষয় অমিল ছিল তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন কবিগুরু এবং আচার্য মহাশয়। সেই অমিলই ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সভ্যতাকে আজও সজীব রাখার একটি প্রধান কারণ।
ডাচ জাতীয় শাসকরা বালিদ্বীপের মানুষকে শাসন করার সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় সামাজিক আচার অধিকারে কিন্তু হস্তক্ষেপ করেনি। ভাষাচার্য সুনীতিকুমারের রচনা পড়লে দেখা যায় যে তিনি লিখছেন – “ডাচেরাও ওদের অনেক অধিকার অব্যাহত রেখেছে , ওদের প্রাচীন রীতিনীতি হস্তক্ষেপ করেনি, ওদের অর্থনৈতিক সুবিধা সব বজায় রেখেছে । ডাচ পতাকার তিনটি রং লাল, নীল, সাদা। বালিদ্বীপের লোকেরা বলেন এ ঝাণ্ডার তলায় দাঁড়াতে আমাদের কোন লজ্জা নেই ।এ তো আমাদেরই দেবতার রং নিয়ে সৃষ্টি। ব্রহ্মার লাল, বিষ্ণুর নীল এবং শিবের সাদা রঙ নিয়ে তৈরি।”
জাভা এবং বালি দ্বীপের হিন্দুরা অত্যন্ত বীর জাতি। তাঁরা সরল কিন্তু দেশভক্তি আত্মসম্মানে অত্যন্ত দৃঢ়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এই দ্বীপপুঞ্জগুলি ভ্রমণ করে লিখেছিলেন , ” ভারতবাসীর পক্ষে এই দেশ এক তীর্থ স্বরূপ । ”
ইন্দোনেশিয়া বিশেষ করে ,বালি, জাভা, যোগ জাকার্তা প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরলে উপলব্ধি করা যায় যে , ” আহা কি দেখিলাম – জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না । ” বাল্মিকী রামায়ণের দেখা যায় বীর সুগ্রীব তাঁর দূতদের যবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন মা সীতার অন্বেষণের নিমিত্ত। এই যবদ্বীপই সেই জাভা ,সুমাত্রা, বালি! প্রাচীন তামিল মহাকাব্যে #মণীমেখলায় – এ এই যবদ্বীপ এবং তার রাজধানী #নাগপুরমের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রামায়ণের প্রভাব ও অনুশীলন বৃদ্ধি পায় ইন্দোনেশিয়ায়। রামায়ণ নানা প্রকার #কাকাবীণ লিখিত রূপের থেকেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এখান চারুকলায় বা নৃত্যনাট্য রূপে। বালি এবং জাভাতে নৃত্য, গীত ,ছায়ানাটকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তেমনি এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সামাজিক রীতিনীতি পরিলক্ষিত হয়।
স্বামীজি বলেছিলেন, ” ভারতের মুখ্য ভাবই হচ্ছে ধর্ম। যেমন সংগীতের একটা প্রধান সুর থাকে, সেইরূপ প্রত্যেক জাতেরই একটি মুখ্য ভাব থাকে, অন্যভাবগুলি তার অনুগত হয়। ভারতের মুখ্য ভাবই হচ্ছে ধর্ম সমাজ সংস্কার এবং অন্য সবই গৌণ।”
সেই ধর্মভাবকেই বালিদ্বীপের অধিবাসীরা আজও অনুসরণ করে চলেছেন। বালিদ্বীপের মানুষজন তাদের দৈনিক জীবনযাত্রায় এখনো সুপ্রাচীন সনাতনী আচরণ বজায় রেখেছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো বালি দ্বীপের কন্যারা সকালবেলায় বেতের টুকরি করে চাল ফল-ফুল দিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে সদর দরজার বাইরে রেখে দেন। প্রতিদিন প্রকৃতির আরাধনা থেকে গৃহদেবতার অর্চনা , দিনের শুরু হয় এইভাবে। এখানে দিনে তিনবার ঈশ্বর উপাসনা পদ্ধতি আজও অনুসৃত হয়।
থাইদেশের যেরকম #স্বওয়াদিখা অর্থাৎ স্বস্তিকা জানিয়ে মানুষজনকে সম্ভাষণ করা হয়, তেমনি বালিতে সম্ভাষণ করা হয় #সুঅস্তি বলে। এখানে বড় বড় পন্ডিত পুরোহিতরা, বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন, অনুষ্ঠানাদি সূচনার আগে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে পূজা-উপাসনা ও ধ্যান সহযোগে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা শুরু করেন। আমাদের দেশ বড় বড় পন্ডিত, বুদ্ধিজীবীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই রকম ঈশ্বর আরাধনা করা কোনদিনও সম্ভব হবে বলে কল্পনাও করা যায় না । কিন্তু বালি দ্বীপে আজও তা সম্ভব । তাইতো স্বামীজি বলেছিলেন , “আমি ধর্মকে শিক্ষার ভিতরকার জিনিস বলিয়া মনে করি । “
এই যে ধর্মাচরণ তা আসলে ধারণ করে আছে প্রাচীন সনাতনী জাভা সভ্যতা-সংস্কৃতি দ্যোতনাকেই। তা ধারণ করে আছে ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যময়তাকে , বিশ্বাস আত্মমর্যাদাকে।সেজন্য বোধকরি সমগ্র বালি দ্বীপে জাভাতে আজও রামায়ণ-মহাভারত বেদ উপনিষদ পুরাণ শিক্ষাদর্শন এত প্রাসঙ্গিক।
শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে যায়, কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষ , বৃহত্তর ভারত , সর্বোপরি সনাতনীদের নিকট আর লেশমাত্র শুষ্ক হয় না। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তা পঠিত হয়, মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তার সমান সমাদর। ধন্য সেই কবিযুগলকে, কালের মহাপ্রান্তরের মধ্যে যাঁদের নাম হারিয়ে গেছে, কিন্তু যাঁদের বাণী বহুকোটি নরনারীরর দ্বারে দ্বারে আজিও অজস্রধারায় শক্তি ও শান্তি বহন করছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলিমৃত্তিকা অহরহ আনয়ন করে অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্তভূমিকে আজিও উর্বরা করে রাখছে।
জাভা , বালিদ্বীপের সভ্যতায় রামায়ণের মিশ্রণও ঠিক এই ভাবেই ঘটেছে। এখানে সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক অনুষ্ঠানে রামায়ণ পাঠ করা একটি বিশেষ প্রথা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কিছু লৌকিক আচরণের কথা- যখন কোনো শিশুর জন্ম হয় বালিতে তখন #মোচোপাত নামক একটি অনুষ্ঠান করা হয়। এটি অনেকটা আমাদের নামকরণ বা অন্নপ্রাশনের মত অনুষ্ঠান। ভারী সুন্দর করে সাজানো হয় পূজার উপকরণ দিয়ে । সেই অনুষ্ঠানে কিছু কিছু বিশেষ অংশ ও বাক্য পাঠ করা হয় রামায়ণ থেকে , এটি #কাওই বা #ক_ঈ ভাষায় লেখা। প্রতিটি খণ্ড পাঠের শেষে, সেই খণ্ডের দার্শনিক ব্যাখ্যা কি তা বুঝিয়ে বলা হয়।
বেবাচান নামক, এই ধরনের আরেকটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে কোনো একজন সুপন্ডিত সুর করে কাওই ভাষায় রামায়ণ পাঠ করেন আর একজন অনুবাদ করে দেন স্থানীয় ভাষায়। একটি ব্যাপার এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য , এখানে যেভাবে রামায়ণ পাঠ করা হয় , সেই ধরনের সঙ্গে উত্তর ভারতের তুলসীদাসী “রামচরিত মানস” পাঠের ধরনের খুব মিল পাওয়া যায়।
জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে । এগুলি যেমন মানব জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একইভাবে জরিত রামায়ণ-মহাভারত । এই বেবাচান শব্দের মূল উৎপত্তির এখনো সঠিক জানতে পারা যায় নি , কিন্তু বেবাস বলে একটি শব্দ ইন্দোনেশিয় ভাষায় পাওয়া যায়; যার অর্থ হল মুক্তি বা আত্মস্বাধীনতা। সেই ক্ষেত্রে যখন এই ভারতীয় মহাকাব্যের পাট হয় তা এক প্রকার মোক্ষ বা সার্বিক মুক্তি সম্পর্কে আমাদের যে প্রাচীন দর্শন তাকে তুলে ধরে।
অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী, গা লো সেই-সব পুরানো গান—
বহুদিনকার লুকানো স্বপনে ভরিয়া দে-না লো আঁধার প্রাণ ।।
হা রে হতবিধি, মনে পড়ে তোর সেই একদিন ছিল
আমি আর্যলক্ষ্মী এই হিমালয়ে এই বিনোদিনী বীণা করে লয়ে
যে গান গেয়েছি সে গান শুনিয়া জগত চমকি উঠিয়াছিল ।।
আমি অর্জুনেরে— আমি যুধিষ্ঠিরে করিয়াছি স্তনদান ।
এই কোলে বসি বাল্মীকি করেছে পুণ্য রামায়ণ গান ।
আজ অভাগিনী— আজ অনাথিনী
ভয়ে ভয়ে ভয়ে লুকায়ে লুকায়ে নীরবে নীরবে কাঁদি,
পাছে জননীর রোদন শুনিয়া একটি সন্তান উঠে রে জাগিয়া !
কাঁদিতেও কেহ দেয় না বিধি ।।
হায় রে বিধাতা, জানেনা তাহারা সে দিন গিয়াছে চলি
যে দিন মুছিতে বিন্দু-অশ্রুধার কত-না করিত সন্তান আমার—
কত-না শোণিত দিত রে ঢালি ।।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. রামায়ণ – দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্ন
২. Ramayana–An Instrument of Historical Contact and Cultural Transmission between India and Asia
৩. 1971.Traces of an Old Sundanese Ramayana Tradition in Indonesia