লক ডাউনের পরেই খাদ্যবস্তুর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে বউ ঠিক করেছিল দুপুরে ও রাতের খাওয়ায় একটাই তরকারি, ডাল আর ডিম বা সম্ভব হলে মাছ, ব্যাস্!
ঠিকই ছিল কিন্তু কিচাইন করে দিলেন শ্বশুরমশাই। ইয়া ঢাউস একটা লাউ নিয়ে হাজির হলেন। যা দেখে আমার পিত্তি বিপুল পরিমাণে জ্বলে গেল। আমার অপছন্দের বস্তুর লিস্ট বানালে লাউ এক নম্বরে থাকবে। আর এই লাউয়ের যা সাইজ তাতে অন্তত দুদিন চার বেলা খেলেও এই লাউ উঠবে কিনা সন্দেহ।
আমি শ্বশুরমশাইকে রাগে গরগর করে বললাম, “আপনি লাউ ছাড়া আনার মতো আর ভাল কিছু পেলেন না?”
শ্বশুরমশাই বললেন, “আরে বুড়ুই তো বলল একটা ভাল দেখে লাউ কিনে দিয়ে যেতে। ও খুব ভালবাসে আর তুমি তো কোনও দিন বাজার থেকে আনো না। খেয়ে দেখো খুব ভাল লাগবে। আর শরীরও ঠান্ডা হবে।”
.
সকালে কাজুর মা এল। কাজুর মা অনেক আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। এখন বয়স হয়ে গেছে, হাঁটতে পারে না ভাল করে। বউ এটা-ওটা দিল।
আমি দেখলাম এই সুযোগ। তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে লাউটা বের করে কাজুর মাকে দিয়ে বললাম, ” নিয়ে যাও এটা, খেও।”
তারপর বউয়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই সময় যার যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে দুস্থ অভুক্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
কাজুর মা খুব খুশি হয়ে বলল, “কী সুন্দর আর কত্ত বড় লাউ! বেঁচে থাকো বাবা। কিন্তু এত বড় লাউ আমি বয়ে নিয়ে যেতে পারবনি।”
লাউ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বুড়ি কিছু টাকা নিয়ে চলে গেল।
আমি কুরুক্ষেত্রে পরাজিত দুর্যোধনের মতো গদার বদলে লাউ হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
পরদিন আবার একটা সুযোগ এসে গেল। আমাদের বাড়িতে মুড়িওয়ালা এল। দূরে গ্রামে থাকে। খুব খারাপ অবস্থা। লুজ মুড়ি বস্তায় করে বিক্রি করে। কেউ এখন লুজ মুড়ি কিনছে না। সবাই প্যাকেট মুড়ি কিনছে।
শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি বউকে বললাম, “এই সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত, বলো?”
দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে লাউটা বের করে এনে ওর হাতে দিয়ে বললাম, “এটা তুমি নিয়ে যাও। এই অসময়ে রান্না করে খেও। যদিও লাউ আমাদের খুবই প্রিয় তাও এই সময় তোমারই এটা বেশি দরকার।”
বউ আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত। বলল, “আর কিছু লাগলে বলো। আমাদের কাছে অল্পই আছে, তবু তার থেকেই যতটা পারব দেব।”
যাক বাবা বাঁচা গেল! লাউটার একটা হিল্লে হয়ে গেল। এখন এই লক ডাউনের বাজারে অন্তত লাউ খেয়ে কাটাতে হবে না।
মুড়িওয়ালা বলল, “লাউ না গো, একটুকুন সর্ষের ত্যাল যদি দিতে পারেন খুব কাজে লাগত। ঘরে ত্যাল নাই মোটে।”
লাউটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুড়িওয়ালা এক লিটার তেলের পাউচ নিয়ে চলে গেল। বউও দরজা বন্ধ করে আমার হাত থেকে লাউটা ছিনিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে গেল। অর্থাৎ আজ লাউয়ের ঝোল!
অতটা লাউ কিভাবে একদিনে শেষ করা যায় ভাবতে ভাবতে আমি বিকেলে বউকে বললাম, “একটা টিফিনকৌটোয় লাউয়ের তরকারি ভরে দাও। তোমার মা-বাবাকে দিয়ে আসি। ওঁরা কত্ত ভালবাসেন।”
এইভাবে সেইদিনই লাউ থেকে মুক্তির একটা পাকা বন্দোবস্ত হল। আমার মন যৎপরোনাস্তি খুশ হয়ে গেল।
.
পরদিন সকালে কেউ দরজায় কড়া নাড়ায় আমি গেলাম দরজা খুলতে। বউও গেল পেছন পেছন, কে এসেছে দেখতে।
দরজা খুলে দেখি মুড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে এক মুখ হাসি নিয়ে।
বলল, “কাল বাবু বলছিলেন লাউ খেতে খুব ভালবাসেন তা বউকে বলতেই বউ বলল, ঘরে এত লাউ হয়েছে যাও না দুটো দে এসো। আর মাঝে মাঝেই দে আসবে দুটো করে।”
বলে দুটো পেল্লাই সাইজের লাউ আমায় ধরিয়ে দিল। বউ ঘরে গিয়ে কিছু টাকা এনে মুড়িওয়ালার হাতে গুঁজে দিল।
রাগে আমার গা থরথর করে কাঁপছে। বউ দরজা বন্ধ করে একটা ফিচকে হাসি দিয়ে বলল, “ওগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে কতক্ষণ! ভাল করে ধুয়ে ফ্রিজে রেখে দাও। আজ থাক কাল রাঁধব।”
নাহ্ লাউয়ের জন্যই মনে হয় শেষমেষ গৃহত্যাগ করতে হবে… এই জন্যই গানেও আছে “সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী…”
©বাসু মুখোপাধ্যায়