দ্বিতীয় পর্ব
রাঘব পন্ডিত চলে ঝালি সাজাইয়া
তিন বোঝারি ঝালি বহে ক্রম করিয়া।
রাঘব এবং তাঁর ভগিনী দময়ন্তী। চৈতন্যজীবনী গ্রন্থের অপরিহার্য কুশীলব। ইতিহাসে অমর হয়ে আছে #রাঘবের_ঝালি নামে। শ্রীচৈতন্যেদেবের নীলাচল অবস্থানকালে প্রতিবছর রথযাত্রার বেশ কিছুদিন আগে গৌড়ীয় চৈতন্যভক্তের দল প্রস্তুত হতো নীলাচল যাত্রার জন্য । তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বেশ কয়েক মাস জুড়ে নিরন্তর শ্রীচৈতন্যেদেবের সঙ্গলাভ এবং রথে জগন্নাথদেবকে দর্শন। চারমাস ধরে তারা জগন্নাথ ভূমে বাস করে চতুর্মাস্যা ব্রত উদযাপন করতেন। ওই সময় রাঘবের ভগিনী দময়ন্তী পাঠাতেন নানারকম মুখরোচক অম্লনাশক খাদ্যসামগ্রী । এমন করে প্রস্তুত হতো সেসব , যাতে মহাপ্রভু এক বছর ধরে উপভোগ করতে পারেন।
সেই ঝালিতে কি থাকতো ? ঝালিতে থাকতো ধনিয়, মৌরীর গুন্ডি, ঘি দিয়ে ভাজা শালি ধানের খই , ঘিয়ে ভাজা ফুটকলাই চূর্ণ, বিভিন্ন স্বাদের নাড়ু, আম কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি, চিঁড়ে মুড়ি, আমসত্ত্ব এবং গঙ্গার মাটি শুকিয়ে তক্তি। দময়ন্তীর এমন সেবা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল । শ্রীচৈতন্যদেব বলেতেন, “রাঘবের ঘরে রান্ধে রাধা ঠাকুরানী । “
শ্রী চৈতন্যদেব তাঁর নিত্য অবস্থান সম্পর্কে অঙ্গীকার করে বলেছিলেন –
শচীর মন্দিরে আর নিত্যানন্দের নর্ত্তনে
শ্রীবাস কীর্ত্তনে আর রাঘব ভবনে।
একদিন রাঘবভবনে সপার্ষদ মহাপ্রভু আসবেন। ঘাটে নৌকা ভেড়াবার পূর্বেই লোকমুখে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল তাঁর আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ল। অসংখ্য মানুষ সমবেত হলেন প্রভুদর্শনের আশায়। ঘাটে নামলেন মহাপ্রভু। সেদিন পেনেটির ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়েছিল।
রাঘব পন্ডিত আসি প্রভু লঞা গেলা
পথে যাইতে লোক ভীড় কষ্টে সৃষ্টে আইলা।
সংকীর্তনের সুরে আকাশ বাতাস , শঙ্খ , ঘন্টা, হুলুধ্বনিতে মুখরিত হল আকাশ বাতাস। মহাপ্রভু রাঘব ভবনে প্রবেশ করলেন।
দেবতা দ্বারকা নাথ মিলে দ্বিগঙ্গা নগরে
পাণিহাটি গঙ্গাতীরে স্থাপে ভক্তি ভরে।
চৈতন্য আনন্দ পায় দরশিয়া মুরতি
আলিঙ্গিয়া রাঘবেরে জানায় প্রীতি।
আনন্দের মুখরিত হয়ে উঠল চারিদিক। দূরদূরান্ত হতে উচ্চ নীচ , ধনী গরিব, নরনারী সকলে ছুটে এলেন কৃপাপিপাসু হয়ে। পণ্যহট্ট সেদিন কৃষ্ণপ্রেমের, চৈতন্যলীলার হাটবাজারে পরিণত হয়েছিল। সেই পেনেটির ঘাটে ভক্তগণ তাঁদের ভক্তির মাধ্যমে কিনে নিয়েছিলেন প্রেমঘন মূর্তি চলমান জগন্নাথকে। সেই সব ভক্তকুলের মধ্যে ছিলেন এক ডাকসাইটে জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। সেই উত্তরাধিকারীর জন্যই পানিহাটির চিঁড়ার মেলা আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
সপ্তগ্রামের জমিদার মজুমদার পরিবার। তাঁদের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন রঘুনাথ মজুমদার। পিতা গোবর্ধন মজুমদার এবং পিতৃব্য হিরণ্য মজুমদার। বঙ্গে নবাবী আমলে একসময় এঁরা রাজস্ব প্রতিনিধি ছিলেন। রাজস্ব আদায় করে রাজ কোষাগারে জমা দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত রূপে তাঁদের হাতে জমা হতে বার্ষিক প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। অথচ তাঁদের দীক্ষাগুরু ছিলেন শ্রী চৈতন্যদেবের দ্বিতীয়া সহধর্মিনী বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর পিতা সনাতন মিশ্র। আবার অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গেও তাঁদের আত্মীয়তা ছিল। সুতরাং , সেখানে সাধারণ মানুষের থেকে শোষিত অর্থের মোহ থেকে উক্ত দুই মজুমদার না বেরিয়ে আসতে পারলেও , কৃষ্ণ কিন্তু তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। ফলে, একমাত্র উত্তরাধিকারী রঘুনাথ শিশুকাল হতে সংসারের প্রতি , জাগতিক বস্তুর মোহের প্রতি বীতস্পৃহ ছিলেন। শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গলাভের আশায় উচাটন রঘুনাথ এই মহাযোগকে নষ্ট করতে রাজি হন নি।
সেদিন রাত্রে রঘুনাথ সব ত্যাগ করে পালিয়ে এলেন পেনেটি। কিন্তু সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ রঘুনাথ মজুমদারের আর প্রব্রজ্যা গ্ৰহণ করা হল না। উপনিষদেই আছে বিদ্যা স্বরূপ মায়া এবং অবিদ্যা স্বরূপ মায়া উভয়কেই জানতে হয়, গ্ৰহণ করতে হয়। তবেই একজন মানুষের জীবনে যৌগিক উন্নতি হয়। তাই শ্রী চৈতন্যদেব রঘুনাথ কে গ্ৰহণ করলেন না। তিনি চাইলেন বৈভবশালী জমিদারের উত্তরাধিকারী মায়াবাদের ঐশ্বরিক অর্থ জেনে আসুন। চাইলেন রঘুনাথের আরো ধৈর্য এবং তিতিক্ষার পরীক্ষা।
ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যূতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।’ (মুঃ উঃ, ২/২/১০)
সেথায় (সমাধির অবস্থায়) সূর্য নেই, চন্দ্র তারকা বা বিদ্যুৎ নেই। অগ্নিও নেই। (আত্মার) সেই জ্যোতিতে সবকিছুই বিভাসিত― জ্যোতিষ্মান। সেই জ্যোতিষ্মানকে জানতে হলে মহামায়ার নানারূপকে , তাঁর এই সুবিশাল মায়ার সংসারকে জানতে হবে তো।
‘আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
অনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি।’ (তৈঃ উঃ,৩/৬/১)।
অনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম। সেই আনন্দ থেকেই এই ভূতবর্গ জন্মগ্রহণ করে―আনন্দকে অবলম্বন করে। আনন্দের মধ্যেই তারা অবস্থান করে। পরিশেষে আনন্দেই বিশ্বজগৎ-জীব-মানুষ-দেবতা সবই লয়প্রাপ্ত হয়। এসব তাঁদের অনুভূতি। এখানে কোনো বিধি নেই। আছে কেবল সত্যের অনুভব, সত্যের নিষ্ঠিক বর্ণনা, সত্যের অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা। সেই ব্রহ্মকে জানতে ব্রহ্মময়ীকে জানা আবশ্যক।
তাই রঘুনাথকে প্রভু বললেন –
স্থির হইয়া ঘরে যাও না হও বাতুল
ক্রমে ক্রমে পায় লোকে ভবসিন্ধু কূল।
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া
যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্ত হইয়া।।
দারুণ প্রত্যাখ্যাত রঘুনাথ নয়নের জলে ভেসে চলে গেলেন সপ্তগ্রাম। রঘুনাথকে ফিরে পেয়ে মজুমদার জমিদারিতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। একমাত্র উত্তরাধিকারী সন্ন্যাস পথ হতে সরে এসেছে সংসার জীবনে, সুবিশাল জমিদারির একমাত্র মালিকানা স্বাভাবিক জীবন ছন্দে ফিরে এসেছে , স্বয়ং মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্ৰহণ হতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেই আনন্দে জমিদার বাড়ি সারাগ্রামকে মাছ ভাত খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্রসঙ্গত , এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে আজও একটি ভক্ষ্য মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর পয়লা মাঘ সপ্তগ্রামের কৃষ্ণপুুুুর গ্রামে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর শ্রীপাটে সরস্বতী নদীর তীরে বসে সেই মেলা।
ক্রমশঃ
© দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. Panihati heritage : panihati chida utsav
২. চৈতন্যময় পানিহাটি: রসিক রং
৩. মিথ পঞ্চদশ