পর্ব ২
কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবের সময় কপিলামঙ্গল গান গাওয়া হয়। কার্তিক মাসে অমানিশার দিন থেকে সূচিত হয় গোধন পূজার দ্বিতীয় পর্ব। এই উৎসব চলে ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন পর্যন্ত। মোট পাঁচ দিনের এই পার্বণ টি কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত । যথা – ক. গোঠপূজা , খ. গরয়্যা , গ. বুড়ি বাঁদনা , ঘ. খুঁটান, ঙ. গোয়াল পূজা , চ. কপিলামঙ্গল গান।
বাঁদনা পরবের সূচনা হয় গোঠপূজা দিয়ে । অবশ্য তারও আগে একটি লোকচার পালিত হয়। তার নাম #ঘাওয়া । অমাবস্যার সূচিত হবার পূর্বে হয় এই ঘাওয়া- র অনুষ্ঠান ।
এই পর্বে গাই – গোরুকে স্নান করিয়ে সিংয়ে তেল সিঁদুর মাখানো হয়। গোয়াল পরিষ্কার করা হয় । গাই গোরুর মাথায় ধানের শীষ দিয়ে তৈরি অলংকার বা #মেড় পরানো হয় । নতুন ধানের শীষ দিয়ে বাগাল বা রাখালরা এইসব মেড় প্রস্তুত করে। অনেক সময় শোলার মেড়ও পরানো হয় । এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে রাঢ়ভূমের প্রতিটি জনজাতিগোষ্ঠীর আপন আপন গৃহের দেওয়ালে অলংকরণ পর্ব শুরু হয় । একে দেওয়াল চিত্র বলে । দেওয়ালে গোবর , এল্যামাটি ছঁচ দিয়ে পিঠানি বাটার সঙ্গে বিশেষ ধরনের পাতার রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় রং। তা দিয়ে রাঢ়ভূমির প্রতিটি জনজাতির গৃহের দেওয়াল সজ্জিত হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে চিত্রময় ।সেখানে কুড়মি, মাহাতো ,সাঁওতাল কোন বিভেদ থাকেনা।
গোঠ পূজা হয় অমাবস্যা তিথিতে। ঢেঁকিতে আতপ চাল কুটে গৃহস্থরা পিঠা তৈরি করেন। সেই পিষ্টক নিয়ে নৈবেদ্য সাজানো হয়। গোঠপূজার দিন গাই-গোরুর মাথায় ধানের বা শোলা দিয়ে বানানো মেড় পরানো হয়। গোয়াল জুড়ে দেওয়া হয় আল্পনা। এই আল্পনার মিশ্রণ তৈরি হয় চাল ও ডাল বেঁটে। বাড়ির উঠোনেও এই আল্পনা দেওয়া হয়। সন্ধ্যা বেলায় বাড়ির সদর দরজার দুপাশে প্রদীপ জ্বালা হয়। এরপর শুরু হয় গোধনের বরণ করা বা চুমান বা বাঁদনা।
গৃহস্থ বাড়ির বৌ- ঝিরা #আঙ্গাডাঙ্গা নামে একটি বৃত্তাকার ফলক আলতা বা লালরঙে চুবিয়ে গাই-গোরুর গায়ে ছাপ দেয়। এতে পশুগুলির গায়ে লালরঙের অলঙ্করণ ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে শঙ্খ বাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গৃহবধূরা ধান- দূর্বা- হলুদ ও আম্রপল্লব দিয়ে গাই-গোরুদের বরণ করেন। একে বলে #চুমান। চুমান বা বরণ ক্রমশ গ্রাম্য বাঁদনা শব্দে পরিণত হয়েছে।
তবে বন্দনা এই শব্দটি থেকে বাঁদনা শব্দটি আসেনি। রাঢ়ভূমে বহু স্থান নাম বান্দা বা বাঁদা শব্দ যুক্ত। যেমন – বান্দাগাল, বান্দাজাম, মাছবান্দা ইত্যাদি। বান্দা শব্দের অর্থ বরণ। সেই থেকে বাঁদনা শব্দটি এসেছে। আগে রাঢ়ভূমের নানা জনজাতির বিবাহানুষ্ঠানে #বাঁদানি_পণ বসতো। অর্থাৎ, বর কনেকে কিছু অর্থ দিয়ে বরণ করা। রাঢ়ভূমে এসময় অনেক সম্ভ্রান্ত গৃহের #জামাই_বাঁদনা অনুষ্ঠান হয়।
শ্বশুরগৃহে জামাতাদের শুভমাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করে শাশুড়ি শ্বশুর ধান – দূর্বা- হলুদ ও অর্থ দিয়ে বরণ করেন। একেই জামাই – বাঁদনা বলে।
উল্লেখ্য যে , বাঁদনা পরব রাঢ়ভূমের প্রতিটি জনজাতি গোষ্ঠী, সম্প্রদায় পালন করেন। সাঁওতাল প্রমুখ জাতিগোষ্ঠীই পাঁচদিনের বাঁদনা পরব পালন করেন কার্তিক মাসে। তবে কেবল কার্তিকেই হয় এমন নয়। অনেক গ্রামে এই পৌষেও বাঁদনা পরব পালিত হয়। পৌষ মাসের দিনটি ধার্য করে গ্রামে লায়া বা পুরোহিত। সব নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করে সন্ধ্যার পর তারা ঢাকঢোল বাজিয়ে গাই- গোরুকে গান শোনানো শুরু হয়। একে জাগরণ পর্ব বলে।
প্রসঙ্গত , রাঢ়ভূমের সকল জাতিগোষ্ঠীর গৃহেই প্রথম দিন বরণের সময় বাংলা এবং সাঁওতালিতে গাই- গোরুকে গান শোনানোর পালা চলে। গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা , কোথাও কোথাও বাদ্যসহ বাগাল – বাঙ্গড়ের দল সুর করে গোয়ালে গাইতে থাকে বাঁদনার গান। গানগুলি হয় সংলাপধর্মী এবং প্রশ্নোত্তর ধাঁচের । যথা –
অহিরে –
কোনে তো গাইধনীকে সিরিজিল বাবু হো
কোনে তো আল্য নাম হাঁয়
কোনে তো তো ঘরে ঘরে বাঁটল
মর্তভুঁয়ে দিল ছাঁঁপুলায়।
অহিরে –
ভগবানে সিরজিল গাইধনীকে
বাবুহো মহাদেবে আনল নামহাঁয়
নিজে গরায়্যা ঠাকুর ঘরে ঘরে বাঁটল
মর্তভুঁইএ দিল চাঁপুলায়।
অহিরে –
কিয়া লাগি সিরজিল গাইধনীকে ?
কিয়া লাগি আনল নামহাঁয়?
কিয়া লাগি ঘরে ঘরে বাঁটল ?
মর্তভূমে দিল ছাঁঁপুলায় ?
অহিরে-
শুদ্ধ লাগি গাইধানীকে সিরজিল
বাবুহো – পালন লাগি আনল নামহাঁয়
দুধা লাগি গাইধনী ঘরে ঘরে বাঁটল
মর্তভূমে দিল ছাঁঁপুলায়।
এই গান যাঁরা গায় , তাঁদেরই #ধাঁগড় বলে। অর্থাৎ, ধাঁগড় শব্দটির অর্থকে আমরা শহুরে সমাজ যার অর্থকে করেছি অত্যন্ত বিকৃত। গোধন কে উক্ত গানে গাইধনী উচ্চারণ করা হয়েছে।
গরু বাঁদনার পরের দিন হল বিশ্রাম। এ দিন বাগাল – রাখাল, গোধন সকলের বিশ্রাম। এইদিন বাগাল – রাখালরা দল বেঁধে গৃহস্থ বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মিঠাই- মুড়কি – গুড়পিঠা আদায় করে। অনেক গ্রামে এই দিন গরায়্যা বা গেরাম ঠাকুরের পূজা হয়। গরাই বা গরায়্যা হলেন গ্রামের কুল দেবতা বা দেবী। তিনিই গ্রাম রক্ষাকারী। তিনি গোধন, ধনধান্য রক্ষা করেন। অনেক গ্রামে এই দিন শালগাছের ডাল পুঁতে গ্রাম দেবতা বা দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা করা হয়। পূজার পর গেরাম বা গরাই থানে গ্রামের যত গোরু আছে তাদের নিয়ে আসা হয়। এসব গোরুর মধ্যে যে গোরুটি প্রথম পূজিত স্থানে পা দেয় তার গায়ে সিঁদুর মাখানো হয়। কারণ, সেই বাঁদনা পরবকে নিয়ে আসে। রাত্রে বেলায় গোয়ালে গোয়ালে প্রতি বাড়ির লোকেরা গোরুদের শিং এ তেল মাখায়। হাঁড়িয়া পান করে গোয়ালে গান গায় –
তিহিঞ দলে উস সেদা দল বা দোল পুখরিরে।
গাপা দলে বঙ্গান সারাং অডাঃ তালাঃ
সাং বান্দ বাত নাড়িরে।
অর্থাৎ , আজ আমরা স্নান করলাম বড় পুকুরে । কাল পূজা করব বড় ঘরের মাঝে। মেঝেতে পূজা করব।
বাঁদনা পরবের তৃতীয় দিন দুপুরের সময় নিজ নিজ বাড়িতে পূজা হয়। এই দিন কেবল গোরু নয়, শূকর , মোরগ ইত্যাদি গৃহে যত গৃহপালিত আছে তাদেরও পূজা করা হয়। পূজা শেষে খাওয়া দাওয়া হয়। বিকাল বেলায় শুরু হয় খুঁটান বা খুটান। কুলহি অর্থাৎ জনাকীর্ণ গ্রামের পথে খুঁটিতে বাঁধা হয় গোরু বা মোষ। এদের কাড়া বলে। এদের নাকে ধোঁয়া দেওয়া হয়। ধোঁয়া দেওয়া হলেই এরা গুঁতোতে আসে। তখন বাদ্য সহযোগে গান করে যে খোঁটায়। যেমন –
অহিরে ,এতদিন চরাল্যাম বাছা
অহড়ে বহড়ে
এতদিন ঘুরাল্যাম বাছা
ডিঙ্গরে ডহরে ।
অহিরে, রণে বনে গজরয়ে বাঘা – বাঘিনিরে
কোনঠানে গরজায় ষাঁঁড়?
মানভূম ও বাঁকুড়া প্রতিটি জনজাতির গ্রামে খুটান উৎসব হয়। বাউরি – মাহাত – ভূমিজ ইত্যাদি জনজাতিগোষ্ঠী মানুষও খুটান করে। এই দিন অনেকেই সন্ধ্যাবেলায় সহরায়ের গান নাচ করে। গভীর রাত পর্যন্ত ধামসা মাদল তালে তালে মেয়েরা সমবেতভাবে নাচ করে। চতুর্থ দিনটি হল বয়স্ক আমোদের পর্ব। পঞ্চম দিনটিতে বাঁদনা সমাপ্তি। নৃত্যগীতের মধ্যদিয়ে সাঁওতাল মেয়েরা বাঁদনাকে বিদায় জানায়।
এখানে উল্লেখ্য যে , খুটানের দিনটিতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। গরু খুটানোর দিনটিকে #বুড়ি_বাঁদনাও বলে। সাঁওতালেরা পাঁচদিন বাঁদনা পরব পালন করলেও , অন্যান্যদের বাঁদনার পার্বণ তিনচার দিনের। তবে পাঁচদিন ধরেই প্রতি গৃহে আল্পনা দেওয়া হয়। উঠোন থেকে একেবারে সদর1 দরজা পর্যন্ত চালগুঁড়ি ও পিটুলীর মিশ্রণ দিয়ে নানা রকমের অপূর্ব আল্পনা আঁকা হয়। রাঢ়ভূমির বিচিত্রবর্ণ শোভিত দেওয়াল চিত্র সমাহার দেখা যায়। তবে বাঁদনার লোকাচারের কম বেশি পার্থক্য দেখা যায় এলাকা বিশেষে।
যেমন – শ্রী রণেন্দ্রবিজয় দাস লিখেছেন, প্রথম দিন গ্রামের সমস্ত গোরুকে আনা হয় বাঁদনার স্থানে। গোরুপালটি ওই স্থানের উপর দিয়ে চালান করা হয়। পুরোহিত বা নায়কে বা লায়া একটি মুরগির ডিমের খোসা ওই স্থানটিতে রেখে দেন। যে গোরুটির পায়ে খোসাটি লাগে সেই গরুটিকে ধরে সিঁদুর মাখানো হয়। তাকে প্রণাম করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই গোরুর মালিককে সৌভাগ্যবান চিহ্নিত করে তার কাছে তিন সের মদ দাবি করা হয়। সন্ধ্যায় সকলে মিলে গোরুর পাল নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল)
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা
২. কপিলামঙ্গল
৩. বাংলার পট ও পটুয়া
৪. ঋগ্বেদ
৫. মনুসংহিতা