দূষণমুক্ত পৃথিবীই ‘বসুন্ধরা দিবস’ পালনের উদ্দেশ্য

সমগ্র বিশ্বব্যাপী 22 এপ্রিল দিনটিকে বিশ্ব বসুন্ধরা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি পৃথিবী মাতার সম্মানে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং পৃথিবীকে নিরাপদ বসবাসযোগ্য রাখতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে 22 এপ্রিল দিনটি পালন করা হয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অঙ্গীকার আজও প্রাসঙ্গিক। কবি লিখেছেন – ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার|’ কবির এই অঙ্গীকার চিরন্তন। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার দাবিতেই বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘বসুন্ধরা দিবস’|
‘কবি’কে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়। সৃষ্টিকর্তা সবসময়ই চান তাঁর সৃষ্টি যেন ‘সুজলাং – সুফলাং- মলয়জ –শীতলা’ থাকে| সৃষ্টিকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য সৃষ্টিকর্তা সদা সচেষ্ট থাকেন| তাই এই ধরিত্রী মাতাকে সুন্দর রাখা ও ধরিত্রী মাতার নবজাতককে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কবি সক্রিয় হয়েছেন। ধরিত্রী মাতার পরিবেশকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য অঙ্গীকার করেছেন। কারন কবি জানেন, সুস্থ পরিবেশ না হলে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে না। প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটবে না। মৌলিকত্ব আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে হৃদয় জয় করতে পারবে না। এর জন্য চাই দূষণমুক্ত, সন্ত্রাস মুক্ত দুর্নীতি মুক্ত, পরিবেশ । যেখানে মানুষ প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
মনের আনন্দে শিল্পী গাইবেন তাঁর গান , সৃষ্টির নানা পসরা সাজিয়ে বসবেন সৃষ্টিকর্তা, শিশুরা খেলবে, ঘুরবে, ফিরবে নিজের মতো করে, নারীরা পাবেন সম্মান, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা। গুণীরা পাবেন যোগ্য সম্মান। প্রকৃতির আঁচলের স্পর্শে পৃথিবী মাতার কোলে বিশ্রাম নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন শান্তিতে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করতে পারে । এমনকি এক সুস্থ পৃথিবীর দাবি তুলেছে সৃষ্টিশীল আত্মা ও কবি মন।
সানফ্রান্সিস্কোতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তি কর্মী জন্ ম্যাককনেল ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটা দিন উৎসর্গের জন্য প্রস্তাব করেন। পৃথিবী মাতার জন্য উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন হিসেবে ২১ শে মার্চ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ১৯৭০ সালে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন ও ডেনিস হেইসের উদ্যোগে প্রতি বছর 22 এপ্রিল দিনটি ‘বসুন্ধরা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের ১৯২ দেশে ‘এই দিবস ‘পালিত হয়।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ আ্যাসেম্বলির ৬৩ তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ইকোলজিক্যাল চাহিদার মাঝে ভারসাম্য অর্জনের জন্য প্রকৃতির সাথে মানুষের সুসঙঙ্গতিতে সহায়তা করা এবং পৃথিবীর ইকো-সিস্টেমকে রক্ষা করা।

বিশ্বকে দূষণমুক্ত ও সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্যই এই ‘দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র মানুষ থাকেন না। মানুষ ছাড়া এই পৃথিবী আরও নানান প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদের ঠিকানা। সেই কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলাই আমাদের এই ‘ দিবস’ পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে ‘বসুন্ধরা দিবস’ উদযাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন শান্তিদূত জন ম্যাককনেল। পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা , পরিবেশের নানাবিধ সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য জনগণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির অত্যন্ত প্রয়োজন।
সম্প্রীতি মানবজীবন কঠিন ও অভাবনীয় সত্যের মুখোমুখি হয়েছে ‘করোনা’ভাইরাসের দৌলতে। পৃথিবীর মাতা নিজেই সক্রিয় হয়েছেন দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরীর জন্য। তাই ‘করোনা’ ভাইরাসের মতো একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাসকে মানব সমাজে হাজির করিয়ে আধুনিক উৎশৃঙ্খল বেহিসাবি প্রযুক্তি নির্ভর; দূষণ সৃষ্টিকারী মানবজাতিকে শিক্ষা দিতে চাইছেন। যানবাহন,মানুষের ভিড় সবকিছু মৃত্যুর ভয় দেখয়ে বন্ধ করেছেন।মানবজাতীর উন্মত্তাকে থামিয়ে দিয়ে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত করেছেন। ওষুধি উন্নতির জন্য উন্নতির মত্ততা ও বিশ্বের বিত্তবান শ্রেণীর ভোগবাদী জীবনযাত্রা এবং কোলাহলপূর্ণ সংস্কৃতির বিশ্বায়ন, প্রাণ ও প্রাণী সম্পদকে এমন ভাবে ব্যবহার করে এসেছে, যা থেকে জন্ম নিয়েছে জীবনের বিপক্ষে বিরত যুদ্ধের ইতিহাস। মানুষের পরিচয়ে, আজ এক বিপুল সম্ভাবনাময় ক্রেতা সম্প্রদায়। মূল্যবোধহীন জীবনযাত্রার পরিণতি রূপে। উপকরণের আচার্যের প্রকোপ বিদ্ধ, পৃথিবীর বৃহত্তম সম্পদভোগী দেশগুলি এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোন সমাধান দিতে পারছে না, তারা অসহায়। লাগামছাড়া প্রয়োজন মেটাতে অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন করতে হয়েছে প্রধানত দুটি কারণে – এক ভোগবাদী জীবনযাপন সংস্কৃতির জন্য এবং দুই পৃথিবীতে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য। এই বিপুল জনবিস্ফোরণ চাহিদা মেটাতে শুরু হয়েছে সামঞ্জস্যহীন উদযাপন। এর ফলে বিপুল ক্ষতিকারক বজ্র পদার্থের সৃষ্টি হয় – যা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবজগতের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। বর্তমানে অতি উন্নত দেশ এবং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রায় সকলেই এই বিষয়ে কম বেশি দায়ী। পৃথিবীতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক জঞ্জাল জমে এবং মারাত্মক ক্ষতিকারক গ্যাসীয়, তরল, কঠিন রাসায়নিক যৌগগুলি বিস্তৃত হয়ে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে আবহাওয়া, জীব গঠন এবং ভবিষ্যতের পৃথিবীকে।
এই গভীর সংকট কালে সুস্থ মানুষের জীবনযাত্রার পথ খুঁজতে ‘বসুন্ধরা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভোগবাদ ও ক্রেতা সংস্কৃতির থেকে সরে এসে পরিবেশ রক্ষার দিকে নজর দেওয়ার জন্যই বিশ্বব্যাপী এই উদ্যোগ। একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টা| আর এই পৃথিবী যদি আমার সুন্দর হয়ে ওঠে তাহলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সকলেই বলবেন ‘মরিতে চাহি না, এই সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।

সরোজ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.