ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট আসলে অতি দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই, মার্কিনি গণতন্ত্রের বড় চ্যালেঞ্জ

চিনে প্রেসিডেন্ট সোশ্যাল মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করে দেন, আর আমেরিকায় সোশ্যাল মিডিয়া প্রেসিডেন্টকে ‘ব্যান’ করে দেয়। গত শুক্রবার ট্যুইটার এবং ফেসবুক বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে এই মেসেজটা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে খুব ঘুরছে।

এটা যতটা চিন এবং আমেরিকা গণতন্ত্র কোথায় দাঁড়িয়ে তা বোঝায়, আবার ততটাই বোধহয় হোয়াইট হাউসের বাসিন্দার জন্য অপমানজনক। আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিহাসে যা যা দাগ রেখে গেলেন, তার তুলনায় হয়তো এই ট্যুইটারের তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া কিংবা ইউটিউবে তাঁর ব্যক্তিগত চ্যানেলকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া কিছুই নয়।

লিখলেন– সুমন ভট্টাচার্য
প্রায় আড়াইশো বছরের মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যাঁকে মার্কিন আইনসভা ‘হাউস অব কংগ্রেস’ দু’বার ‘ইমপিচ’ করল। এটা ঠিক যে আগামী সপ্তাহেই জো বাইডেন পরবর্তী প্র্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন, তাই এই সাত দিনের জন্য ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ’-এ ট্রাম্পকে ‘ইমপিচ’ করার কোনও প্রভাব পড়বে না।

আর মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টকে ‘ইমপিচ’ করতে গেলে কংগ্রেসের দুই কক্ষকেই তাতে সম্মতি দিতে হবে। ‘হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ’ এর পাশাপাশি সেনেটেরও অনুমোদন লাগে। কিন্তু যতদিন মাইক পেন্স ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন, ততদিন সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।

আর বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ৬ই জানুয়ারি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশ উপেক্ষা করতে শুরু করলেও, ডেপুটি হিসাবে তিনি তাঁর ‘বস’-এর ‘ইমপিচমেন্ট’ চান না। তাই সেনেট-এ বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘ইমপিচমেন্ট’ গৃহীত নাও হতে পারে।

কিন্তু যেভাবে ‘হাউস অব রিপ্র্রেজেনটেটিভ’এ রিপাবলিকানরাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, যদি সেটা সেনেটেও ঘটে, তা হলে কি হবে? যদি রিপাবলিকান সেনেটররাও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দেন, এবং এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ভোটাভুটিও হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু মার্কিন আইনসভার দুই কক্ষই প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্টের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দেবে।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত যেটুকু হয়েছে, অর্থাৎ দ্বিতীয়বারের জন্য ‘হাউস অব রিপ্র্রেজেনটেটিভ’ একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘ইমপিচ’ করেছে, তাও ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা। এবং মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য লজ্জাকরও বটে। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের বসবাসের কালকে হয়তো এই ‘ইমপিচমেন্ট’ কমিয়ে দিতে পারেনি, কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদটির গরিমা বা রাজনৈতিক গুরুত্বকে যে অনেকাংশেই হ্রাস করে দিয়েছে, তা নি:সন্দেহে বলে দেওয়া যায়।

গত সপ্তাহে খাস ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পরেই, সেদেশের ওপিনিয়ন পোল অনুযায়ী যে শুধু বিদায়ী প্র্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা কমেছে তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্য অনেক দেশই মার্কিন মুলুককে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করতে শুরু করেছে।

অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী চিন তো তির্যক মন্তব্য করেইছে, এমনকি ইরান বা ইরাকের থেকেও টিকা-টিপ্পনি ধেয়ে গিয়েছে। যে আমেরিকা এতদিন পৃথিবীর অন্য সব দেশকে গণতন্ত্রের সবক শেখাতো, সেই দেশের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের সমর্থকরা ভাবী প্রেসিডেন্টের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত শিলমোহর দেওয়াকে বাতিল করে দিতে আইনসভাতে ঢুকেই হামলা চালাচ্ছে, এমনতর ঘটনা তো এর আগে ঘটেনি।

অতএব এই দগদগে ক্ষত মার্কিন গনতন্ত্রের ইতিহাসে রয়ে যাবে। পাশাপাশি এটাও সত্যি ট্রাম্পেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এই সবকিছুর পরেও আইনসভার অধিবেশন জারি রেখেছেন, এবং ভোর রাত অবধি চলা সেই অধিবেশন ট্রাম্পের সমস্ত আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে জো বাইডেনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়াকে নিশ্চিত করেছে।

গত এক সম্পাহ ধরে শুধু যে রিপাবলিকান দলের একটা বড় অংশ বিদায়ী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন এমনটাই নয়, তার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট যাতে আর ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্য না করতে পারেন সেইজন্য তাঁর অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

এ্টাই আবার মার্কিন গণতন্ত্রের শক্তিও বটে। ট্যুইটার পাকাপাকিভাবে ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে, ফেসবুক, স্নাপচ্যাট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, ইউটিউব ট্রাম্পের নিজস্ব চ্যানেলকে বন্ধ করে দিচ্ছে… এই সবগুলিই অভূতপূর্ব ঘটনা।

অভূতপূর্ব শুধু মার্কিন মুলুকের নিরিখে নয়, গোটা বিশ্বজুড়েই এই মুহুর্তে এই নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। নভেম্বরে নির্বাচনের পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং নির্বাচনের বিরুদ্ধে যাবতীয় বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল এই সবকিছুই বোধহয় রাজনৈতিক কৌশল। ২০২৪-এর নির্বাচনে তিনি যাতে আবার রিপাবলিকান প্রার্থী হতে পারেন এবং হোয়াইট হাউসে ফিরে তাঁর ‘দুনিয়া শাসন’ চালিয়ে যেতে পারেন, তারই রাস্তা তৈরি করছেন এই প্রাক্তন রিয়েলএস্টেট ব্যবসায়ী।

কিন্তু নিজেকে ‘ঠিক’ প্রমাণ করতে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন গণতন্ত্রের উপর যে আক্রমণ চালিয়েছেন, তা সেদেশের রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব সংকট ডেকে এনেছে। সেই সংকট প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিপজ্জনক প্রবণতাগুলিকে নিয়ে।

ট্রাম্প তো আসলে রিপাবলিকান পার্টিকে অতিক্রম করে নিজেকে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এমন এক ‘আইকন’-এ পরিণত করেছিলেন, যার তুলনা মেলা ভার। সেই আইকন যে সরাসরি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এবং মার্কিন গণতন্ত্রকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবে, তা কেউ ভাবেনি।

কিন্তু এই পরিস্থিতি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্পের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে দিচ্ছে মার্কিনি গণতন্ত্রকেও ভাবতে হবে, অতি দক্ষিণপন্থা কি কি বিপদ ডেকে আনতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.