সামসুং তাদের কারখানা চিন থেকে ভারতে নয়ডাতে চালু করায় চিনের এখন মাথায় হাত অবস্থা

স্মার্টফোন নির্মাতা কোম্পানি সামসুং (Samsung) তাদের কারখানা চিন (China) থেকে ভারতে (India) নয়ডাতে সরিয়ে আনার ফলে চিনা শহর ভুতুড়ে গ্রামে পরিণত হয়েছে।শুধু ভারতেই নয় ভিয়েতনামেও সামসুং কারখানা চালু করায় চিনের এখন মাথায় হাত অবস্থা
গত বছর সামসুং তাদের বৃহত্তম কারখানা চিন থেকে সরিয়ে নয়ডায় নিয়ে আসে।ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির কাছাকাছি সামসুং কারখানা চালু করেছে।চিনে থাকতে তারা বছরে ছয় কোটি আশি লক্ষ হ্যান্ডসেট উৎপাদন করত।ভারতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুগুণ করা হবে বলে কোম্পানি আশা করে।এখানে বছরে বার কোটি মোবাইল উৎপাদন হবে বলে কোম্পানি-সূত্রে খবর।প্রতিটি ইউনিটে ধাপে ধাপে উৎপাদন বাড়ানো হবে।এবং ২০২০ সালের মধ্যেই উৎপাদন পূর্ণমাত্রায় শুরু হবে বলে জানা গিয়েছে।
সামসুং তাদের কারখানা সরিয়ে আনার পর চিনের (China) হুইজৌ শহর এখন ভুতুড়ে গ্রামে পরিণত হয়েছে।গত অক্টোবরে কোম্পানি তাদের তিন দশকের পুরানো ফ্যাক্টরি সরিয়ে ভিয়েতনাম ও ভারতে নিয়ে আসে।তারপর থেকেই হুইজৌ তার জৌলুস হারাতে শুরু করে।এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে।


হংকং কেন্দ্রীক “সাউথ চায়না মর্নিং পোষ্ট” এ খবর দিয়ে জানিয়েছে,সামসুং চলে যাবার পর শিল্পোন্নত শহরটি বর্তমানে পোড়ো জনপদের চেহারা নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে,সামসুং চলে যাবার মূলে রয়েছে দুই অর্থদানব চিন ও আমেরিকার মধ্যেকার অর্থনৈতিক ঠান্ডা লড়াই।বিশ্ববাণিজ্যে চিন যে একাধিপত্যের স্বপ্ন দেখত তা ভয়ঙ্কর ভাবে ধাক্কা খেয়েছে।শুধু তাই,বিশ্বব্যাপী যে-বাণিজ্যিক শৃঙ্খলে চিন পৃথিবীকে বাঁধতে চেয়েছিল সেটাও ছিন্ন হয়ে গেল।গত ত্রিশ বছর ধরে চিন দিবাস্বপ্ন দেখে এসেছে যে,বিশ্বে তারাই হবে উৎপাদন শিল্পের একচেটিয়া নিয়ন্তা।সারা বিশ্বে তারাই শুধু শিল্পদ্রব্য রপ্তানি করবে !


গত বছরই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ট ট্রাম্প (Donald Trump) চিনের সাথে বাণিজ্য-যুদ্ধ শুরু করেন।তিনি দাবি করেন যে,বিশ্বের বাণিজ্যিক চাহিদা আমেরিকাই পূরণ করবে।ট্রাম্প চিনের কাছে দাবি করেন যে,আমেরিকান কোম্পানি চিনে ব্যবসা করতে গেলে তাদের নিকট থেকে প্রবেশমূল্য কম নিতে হবে।চিন শর্তানুসারে সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে কিনা,তা নজরদারির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।এবং চিনকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে,সেদেশে মেধাবীদের সম্পত্তি রক্ষা,প্রয়োজনীয় প্রযুক্ত সরবরাহ ও মার্কিন কোম্পানির মালের উপর চিনা বাজারে বিশেষ ছাড় দিতে হবে


বাণিজ্যিক যুদ্ধের ইতি টানতে দুই দেশ একাধিক বার আলোচনায় বসলেও সমাধান হয় নি।যার ফলে গত কয়েক বছর ধরে চিনের উৎপাদন শিল্প লোকসানে চলতে থাকে।এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নগতি লক্ষ্য করা যায়।চিনের রপ্তানি বাণিজ্যও কমে যায়।
মর্নিং পোষ্ট” আরও জানিয়েছে যে,অনেক চাকুরিজীবীদের জোর পূর্বক হুইজৌ শহর ছাড়তে বাধ্য করা হয়।কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে জানান যে,তাঁরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।এবং ফ্যাক্টরিতে শেষ ফোনের প্যাকেজিংএর ছবিও তাঁরা সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।


মর্নিং পোষ্ট” এ-ও জানিয়েছে,সামসুং-এর ছেড়ে যাওয়া বিপুল পরিমাণ জমি ফাঁকাই পড়ে আছে।অন্য কেউ শিল্প স্থাপনের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে।ইতিমধ্যেই হুইজৌ-এ অন্যান্য কোম্পানিগুলি তাদের ৬০ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।এবং আগামিতে এভাবেই চলবে বলে “মর্নিং পোষ্ট” অভিমত ব্যক্ত করেছে।


চিনে ১০০-র বেশি উৎপাদন শিল্পের কর্মপরিবেশের উপর নজরদারি চালায় ” ইন্সটিটিউট অফ কনটেমপোরারি অবজার্ভেসন” (Institute of Contemporary Observation) নামক সংস্থা।তার প্রধান
লিউ কাইমিং জানিয়েছেন, ” সামসুং ছিল বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বড় উৎপাদক কোম্পানি।যারা সমস্ত পরিবেশ বিধি,নিয়োগ বিধি মেনেই ফ্যাট্করি চালাত।গত কুড়ি বছর ধরে তারা হুইজৌ,গুয়ানডাং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কারখানা গড়ে তোলে।


এই শিল্পাঞ্চলের প্রায় ১০০টা কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।সামসুংয়ের মতো বড় ফ্যাক্টরি শুধু নয়,এমন কি ছোট ছোট দোকান,রেস্তোরাঁও বন্ধ হয়ে চলেছে।
হুইজৌ শিল্পাঞ্চল বন্ধ হবার ফলে,হুইজৌ-এর পুবে ১০০কিলোমিটার দূরের শিল্পাঞ্চল চ্যানগ্যান এর ডুংগুন শিল্পতালুকে গিয়ে হাজার হাজার কর্মহীন শ্রমিক,অফিসাররা গিয়ে ভীড় করছেন।চিনের অন্যতম বড় রোবট উৎপাদক গোষ্ঠী,শেনঝেন কেন্দ্রীক জানুস ইন্টেলিজেন্ট গ্রুপ তাদের কারখানা উৎপাদন দৈনিক তিন ঘন্টা করে কমাতে বাধ্য হয়েছে।


স্থানীয় ব্যবসায়ি লি হু জানিয়েছেন,”আমাদের ব্যবসা আগষ্ট মাস নাগাদ ৮০ শতাংশ কমে যায়।সেপ্টেম্বরে এসে সেটা আরও নেমে যায়“।তিনি আরও জানান,” সামসুং বন্ধ হয়ে যাবার ফলে এখানকার ফার্মেসি,হোটেল,সুপার মার্কেট,বাড়িভাড়া,যুবকদের দোকান সবই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”


দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেক্ট্রনিক জায়ান্ট কোম্পানি সামসুং ১৯৯২ সালের আগষ্ট মাসে স্থানীয় সরকারের সাথে চুক্তির মাধ্যমে হুইজৌতে ফ্যাক্টরি শুরু করে।
পরের বছরই কোম্পানি ঘোষিত মূলধন হয় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।তখন থেকেই সামসুং সর্বশেষ প্রযুক্তি সংবলিত ইলেক্ট্রনিক্স গ্যাজেটস উৎপাদন শুরু করে।১৯৯০ এ স্টেরিও প্লেয়ার,২০০০সালের প্রথমেই MP3 প্লেয়ার এবং ২০০৭ সালে স্মার্টফোন বানানো শুরু করে সামসুং।তাদের প্রতিটি দ্রব্যই ক্রেতার সন্তুষ্টি বিধানে সমর্থ হয়।
হুইজৌ-র জনৈক রিয়াল এস্টেট ব্রোকার কোম্পানির সেলস ম্যানেজার
হুয়াং ফুমিন বলেন,” সামসুং তার কর্মী-আধিকারিকদের স্বাচ্ছন্দের প্রতি খুবই দৃষ্টি রাখত।এখানেই ছয়-সাত তল যুক্ত ১০০টি কর্মী-আবাসন বানিয়েছিল সামসুং।যার প্রতিটা ফ্লর ছিল ১০০০ বর্গ মিটারের।ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার সাভে সাথেই আবাসনগুলির দাম কমতে শুরু করে।প্রথমে ৪.৫ মিলিয়ন চাইনিজ ইয়েন থেকে আগষ্টে এসে ৩.৮-তে নামে।বর্তমানে সেগুলির প্রতি কেউ আর আগ্রহ দেখান না।”


২০১১-তে সামসুং এর স্মার্টফোন বিক্রির দিক দিয়ে বিশ্বে এক নম্বরে উঠে আসে।হুইজৌ ও তিয়ানজিন ফ্যাক্টরি থেকে ওই বছর মোট ৭০.১৪ মিলিয়ন প্রোডাক্ট সামসুং রপ্তানি করেযার মধ্যে ৫৫.৬৪ মিলিয়ন ছিল স্মার্টফোন
“মর্নিং পোষ্ট” জানিয়েছে যে অক্টোবরের ৩ তারিখে সামসুং তার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।এক বছরের মধ্যেই হুইজৌ থেকে রপ্তানির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন চাইনিজ ইয়েনের ২৭ শতাংশ কমে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.