রাজাকার পরিবারের দখলে বিলীন হচ্ছে লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন

মৌলভীবাজার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী বিপ্লবী লীলা নাগের ১১৯তম জন্মবাষির্কী বুধবার (২ অক্টোবর)। 

১৯০০ সালের এই দিনে উপমহাদেশের নারী জাগরণের প্রতিকৃত এই নারী জন্মগ্রহণ করেন। লীলা নাগের জন্ম ভারতে হলেও তার পৈত্রিক নিবাস ছিল মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা পাঁচগাঁও গ্রামে। লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন তার বাড়িটি এখন রাজাকার পরিবারের ভোগ দখলে রয়েছে।

জানা যায়, তাদের বাড়ি পাঁচগাঁওয়ে হলেও তার বাবা গিরিশ চন্দ্র নাগ উপনিবেশিক ভারতের আসামের গোয়ালপাড়া মহকুমার প্রশাসক থাকায় তারা সেখানেই থেকেছেন।তবে শৈশবকালে পাঁচগাঁও গ্রামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে লীলা নাগের অনবদ্য ভূমিকা ছিল। সেসময় এই বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল।

লেখিকা শাহনাজ নাসরিন তার এক গ্রন্থে লিখেছেন যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে লীলা প্রথমে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তার সামাজিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অবিচ্ছিন্ন বাধার মুখোমুখি হলে অবশেষে দেশ ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন বলে জানা যায়।

সরেজমিনে লীলা নাগের স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িতে দেখা যায়, ১৯৩৮ সালে লীলা নাগের বাড়ির পাশে তার মা কুঞ্জলতা নাগের প্রতিষ্ঠিত কুঞ্জলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় রয়েছে। লীলানাগ কিংবা তার পরিবারের স্মৃতি বহন করার মতো একমাত্র এই বিদ্যালয়টিই রয়েছে। তার বিপরীতে লীলা নাগের জরাজীর্ণ চৌচালা ঘরটি প্রায় ভেঙে গেছে। ঘরে চালা ঠিক রেখে সেখানে ধানের বীজ ও পুরনো জিনিসপত্র রেখেছেন এই বাড়ির ভোগ দখলদার রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে আবদুল মুনিম চৌধুরী। একে একে ঘরটির দেয়াল ও ছাদ ধসে পড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ ভারতের কলকাতায় চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে তার কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় পরিত্যক্ত বাড়িটি স্থানীয় পাঁচগাঁও ইউনিয়ন অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাড়িতে মোট ৪.৩৯ একর জমির ওপর ছিল। যার মধ্যে একটি পুরানো বাংলো এবং একটি পুকুর রয়েছে। বর্তমানে এলাকার কথিত রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে আবদুল মুনিম চৌধুরী এই বাড়িটিতে বসবাস করে আসছেন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাঁচগাঁও গণহত্যায় জড়িত ছিলেন লীলা নাগের বাড়ি দখলকারী আলাউদ্দিন চৌধুরী। আলাউদ্দিন চৌধুরী রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে অপহরণ, বন্দি, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাঁচগাঁও গণহত্যায় জড়িত চার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু এর আগে ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে আলাউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ায় অভিযোগে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।

সরকারি নথি থেকে জানা যায়, লীলা নাগের পৈত্রিক বাড়িতে মোট ভূমি ছিলো ৫.৯৭ একর। পাকিস্তান শাসনামলে তারা বাড়ি থেকে চলে গেলে ১৯৬৭ সালে আসাম থেকে আলাউদ্দিন চৌধুরী এসে বাড়িটি দখলে নেন। পরবর্তীতে আইনি প্রক্রিয়ায় এর দখল রাখতে চেয়েও তিনি ব্যর্থ হন।

১৯৬৭ সালে মহকুমা প্রশাসকের কাছে বাড়িটি লিজের জন্য ৫০/৬৭ নম্বর আবেদনে আলাউদ্দিন চৌধুরী ও আকমল আলী আবেদন করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন চৌধুরী আকমল আলীর বিরুদ্ধে আপত্তি করেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালে আলাউদ্দিন মোট ১২টি এসএ দাগে ৪.৩৯ একর ভূমি লিজ পান। এর পরের বছর থেকে আলাউদ্দিন সরকারকে লিজ মানি পরিশোধ না করায় ইজারা বাতিল করে সরকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে বিভিন্ন মামলা ও আপিলের মাধ্যমে বাড়িটিতে ভোগ দখল ও স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন আলাউদ্দিনের উত্তরসুরীরা। 

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৮ জুন জেলা প্রসাশনের ৮৯০ নম্বর স্মারকে সরকারি কৌঁসুলির (জিপির) কাছে মামলার অগ্রগতি জানতে চাওয়া হলে কোনো জবাব মেলেনি।

বর্তমানে বাড়িতে দখলে থাকা আবদুল মুনিম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তার বাবা বাড়িটি  ইজারা নেওয়ার পর ১৯৬৫ সাল থেকে তার পরিবার এখানে বসবাস করছেন। এই বাড়িতে লীলা নাগের যে ঘরটি আছে সেটাকে সরকার সংরক্ষণ করতে পারে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। 

লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক বিজিত দেব বলেন, লীলা নাগের এই স্মৃতিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও সেখানে একটি জাদুঘর নির্মাণ করার দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। তার আগে এই বাড়ি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ ব্যাপারে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌসী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বাড়িটি নিয়ে পুরনো একটি মামলা চলমান থাকায় আমরা সেখানে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিনা। এর একটা সুরহা হলে পরে আমরা ভাবতে পারি যে সেখানে কী করা হবে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.