বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘একাত্তরের পর বাংলাদেশ থেকে কেউ ভারতে যায়নি। অসমে সদ্য ঘোষিত এন আর সি প্রসঙ্গে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ গাজিপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই— একাত্তরের পরে বাংলাদেশ থেকে কেউ ভারতে যায়নি। যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা আগেই গিয়েছেন। ওই দেশ থেকে যেমন এখানে এসেছে এখান থেকেও ওখানে গিয়েছে। কাজেই আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ নিউজ ঢাকার অনেক মিডিয়ায় এসেছে। এটিকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জোকস বলা যায়!
১৭ জুলাই ২০১৯ ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি নারী প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ৩৭ মিলিয়ন সংখ্যালঘু হারিয়ে গেছেন। ২৯ জুলাই ২০১১-তে ওয়াশিংটনে একহিয়ারিং-এ মার্কিন কংগ্রেসম্যান রবার্ট ডোন্ড বলেছেন, ১৯৪৭-র পর বাংলাদেশ থেকে ৪৯ মিলিয়ন সংখ্যালঘু মিসিং। ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. আবুল বারাকাত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশ থেকে ১৯৬৪-২০১৩ পর্যন্ত ধর্মীয় নির্যাতন ও বৈষম্যের কারণে ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগ করেছেন। ২০১৬-তে তিনি আরও বলেছেন, ৩০ বছর পর বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকবে না! এ মানুষগুলো ভারতে গেছেন।
অসমে এন আর সি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি হবে? পুরো ভারতে এন আর সি হবে? আমেরিকা-ইউরোপ অবৈধদের খেদাচ্ছে, ভারত অবৈধদের খেদাবে সেটি তার অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের ভয় কী? আর খেদিয়ে দেয়া কি একই সহজ? বাংলাদেশ কি পারছে। রোহিঙ্গাদের বিদায় করতে? বা রোহিঙ্গারা কি যেতে চাচ্ছে? মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী কারোও ভারতে আমার কথা নয়, কিন্তু এসেছে। ১২ আগস্ট ২০১৮-তেডেইলি স্টার পত্রিকা অসমে এন আর সি প্রসঙ্গে ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকা নরেন্দ্র মোদীর একটি উদ্ধৃতি ছেপেছে, যাতে মোদী বলেছেন, ‘অবৈধ অভিবাসী ঠেকানো ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির অঙ্গীকার ছিল।
ঠিক কত মানুষ ভারতে এসেছেন তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কেন এসেছেন, তা সবার জানা। বহুবিধ উপায়ে অত্যাচারিত হলেই কেবল মানুষ জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ সরকার ‘অর্পিত/শত্রু সম্পত্তি তফশিল ‘ক’ ও ‘খ’-তে অগুন্তি সংখ্যক হিন্দু মিসিংনাম ছাপিয়েছেন। এক একটি নাম অর্থাৎ এক একটি পরিবার। এরা ভারতে চলে গেছেন বলেই তো তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুযায়ী এই জমির পরিমাণ ২.৮ মিলিয়ন একর। পরিমাণটি আসলে আরও বেশি। এই সম্পত্তি সরকার হিন্দুদের থেকে নিয়ে মুসলমানদের দিয়েছে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর আইনটি বাতিল হয়েছে, সংখ্যালঘুরা সম্পত্তি বা ক্ষতিপূরণ পাবে কবে?
১৯৪৭ সালে আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা ছিল ১৯.৭ শতাংশ। ২০১১-এ আদমশুমারি অনুযায়ী সেই সংখ্যাটি নেমে হয়েছে ৯.৭ শতাংশ। এরপর বাংলাদেশে এখনো কোনো আদমশুমারি হয়নি। পিটিআই ২৩ জুন ২০১৬ ঢাকা থেকে এক রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্স-এর (বিবিএস) পরিসংখ্যানকোট’ করে বলেছে, ২০১৫-র শেষে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫.৮৯ কোটি, এর মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা বেড়ে ১.৭০ কোটি হয়েছে, যা ১০.৭ শতাংশ। পিটিআই প্রশ্ন করেছে, ২০১৪ সালে বিবিএস পরিসংখ্যান অনুযায়ী হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১.৫৫ কোটি, মাত্র এক বছরে সেটি বেড়ে ১.৭০ কোটি হলো কী করে?বিবিএস বলেছে, ‘রান্ডম স্যাম্পলিং’করে তারা হিন্দু সংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, এটি দিবালোকের মতো সত্য। কেন তারা দেশত্যাগ করেছন? এর সোজা উত্তর হিন্দুদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ায় তারা ফিরে আসেন। আবার দেশত্যাগ করতে হবে জানলে কি তারা ফিরতেন? তারা না ফিরলে কী হতো? বাংলাদেশের হিন্দুরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের কারণে। এই নির্যাতন সামাজিক, ধর্মীয় এবং সরকারি পর্যায়ে? সব সরকারের আমলে কমবেশি এই নির্যাতন চলছে। ২০০১-এর পর আওয়ামি লিগ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে ব্যাপক সোচ্চার ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা নির্যাতন বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে অত্যাচার অব্যাহত আছে, দেশত্যাগ চলছেই।
ডেইলি স্টার রিপোর্ট অনুযায়ী মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ৯ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গভর্নমেন্ট ফেইল্ড টু প্রটেক্ট এথনিক মাইনরিটিজ’। তিনি অভিযোগ করেন, “আমরা এখন বলতে পারি দেশ থেকে একটি সমাজকে বিতাড়িত করার পাঁয়তারা চলছে। তার অভিযোগ, সরকার এবং সরকার। সমর্থিত গোষ্ঠী এটি করছে। একই পত্রিকা ২০ নভেম্বর ২০১৬ অধ্যাপক আবুল বারাকাতের একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের নিউজ ছেপেছে। যেখানে অধ্যাপক বারাকাত বলেছেন, ‘৩০ বছর পর বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকবে না। তিন দশকের গবেষণার ফলাফল হিসাবে ড. বারাকাত দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পূর্বে দেশত্যাগের হার ছিল প্রতিদিন ৭০৫ জন। ১৯৭১-১৯৮১ পর্যন্ত তা ছিল ৫১২ জন; ১৯৮১-১৯৯১-এ সেটি দাঁড়ায় ৪৩৮ জন। কিন্তু ১৯৯১-২০০১-এ এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭৬৭ জন এবং ২০০১-২০১২-এ ৭৭৪ জন।
মানবতার এই অপমান বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ কখনো ছিল না, এখনো নেই।
সিতাংশু গুহ
(লেখক নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি)
2019-09-16