গত ৮ ডিসেম্বর থেকে ইউরোপে হইচই পড়ে গেছে। ‘মিউট্যান্ট’ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে লকডাউন আরও কড়াকড়ি করতে চলেছে ব্রিটিশ সরকার। স্পেন, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালিতেও আতঙ্ক। ব্রিটেন থেকে যাত্রিবাহী বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আসলে এই মিউট্যান্ট ভাইরাস কী? জিনের গঠনে কী বদল হচ্ছে? কতটা সংক্রামক এই নতুন প্রজাতি? বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা তাদের মতামত জানিয়েছেন।
মিউটেশন আসলে কী? কেন বদলায় ভাইরাস?
মিউটেশন মানে হল জিনের গঠনের রাসায়নিক বদল। জিনের একটা নির্দিষ্ট সাজসজ্জা আছে। প্রতিটি জীবদেহেই জিনের নির্দিষ্ট বিন্যাস আছে। যদি কোনওভাবে সেটা বদলে যায় বা এদিক ওদিক হয়ে যায়, তাহলে বলা হয় জেনেটিক মিউটেশন হয়েছে অর্থাৎ জিনের গঠন বিন্যাস বদলে গেছে। তখন সেই পরিবর্তিত জীবকে বলা হবে ‘মিউট্যান্ট’ (Mutant)।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই জিনের বদল বেশি হয়। বিশেষত ভাইরাস যদি সংক্রামক হয়, তাহলে বারে বারে সে তার জিনের সাজসজ্জা বদলে ফেলে। কারণ মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণীর শরীরের কোষে ঢুকতে হলে সেই কোষের রক্ষী প্রোটিন বা রিসেপটর প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে হয় ভাইরাসকে। কিন্তু একটা সময়ের পরে দেহকোষও সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সহজ কথায় বলতে গেলে, সেই ভাইরাসকে চিনে রাখে। ফলে পরবর্তী সময় চট করে আর সেই ভাইরাস কোষে ঢুকতে পারে না। তাই সে এক নতুন কৌশল নেয়। নিজেকে পাল্টে ফেলে। অনেকটা মেকওভার করার মতো। এমনভাবে নিজের সাজসজ্জা বদলে ফেলে যাতে কোষ আর তাকে চিনে উঠতে না পারে। আর দেহকোষ যদি ভাইরাসকে না চিনতে পারে, তাহলে সে অনেক সহজে কোনও বাধা ছাড়াই কোষের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। এই মেকওভারের জন্য জিনের গঠন বদলায় ভাইরাস। ফলে তার চরিত্রই বদলে যায়। সে হয়ে ওঠে আরও সংক্রামক। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনও ভাইরাস তার জিনের গঠন বদলে কতটা সংক্রামক হবে, সেটা নির্ভর করে কয়েকটা বিষয়ের ওপর যেমন, সে কীভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, কার শরীরে ছড়াচ্ছে এবং কত দ্রুত বিভাজিত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেন যতবারই জিনের গঠন বদলেছে, ততটাই বেশি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, শুরুতে যে ভাইরাল স্ট্রেন ছড়িয়েছিল উহান থেকে, তার সঙ্গে এখনকার ভাইরাল স্ট্রেনের বিস্তর ফারাক আছে। এর কারণই হল বারে বারে জিনের গঠন বিন্যাসে বদল ঘটিয়ে ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার রাস্তা খুঁজে নিয়েছে।
নতুন মিউটেশন কী হয়েছে? কোন ভাইরাল স্ট্রেন নিয়ে এত হইচই
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে নতুন ভাইরাল স্ট্রেন খুঁজে পাওয়া গেছে তার নাম বি.১.১.৭ ( B.1.1.7) । বৈজ্ঞানিক নাম VUI–202012/01। এই ভাইরাল স্ট্রেনের নাকি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা খুব বেশি। কারণ মানুষের শরীরে ঢুকলে খুব দ্রুত এসিই-২ (ACE-2) রিসেপটর প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে এই ভাইরাল স্ট্রেন কতটা বেশি সংক্রামক বা এর প্রভাবে কতটা জটিল রোগ হতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনও মেলেনি। শুধু জানা গিয়েছে, এই নতুন স্ট্রেন খুব তাড়াতাড়ি ছড়াতে পারে অর্থাৎ এটি ‘সুপার স্প্রেডার’ ।
এখন দেখে নেওয়া যাক কী ধরনের বদল হয়েছে জিনের বিন্যাসে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথম মিউটেশনকে বলা হচ্ছে N501Y। এটি এক ধরনের মিউটেশন যেখানে দেহকোষের রিসেপটর প্রোটিনের ACE-2 সঙ্গে ভাইরাসের স্পাইক (S)প্রোটিনের জোট বাঁধার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। সহজভাবে বললে, আর শক্তপোক্তভাবে দেহকোষকে আঁকড়ে ধরতে পারে ভাইরাস এবং কৌশলে কোষের ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ৬৯-৭০Del মিউটেশন। মানে হল স্পাইক প্রোটিনের ভেতরেই সবচেয়ে বেশি বদল ঘটিয়েছে ভাইরাস। স্পাইক প্রোটিন অসংখ্য অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। যার মধ্যে ৬৯ ও ৭০ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোড একেবারে মুছে দিয়েছে ভাইরাস। সহজ করে বলতে হলে, স্পাইক প্রোটিনের ভেতরে দুটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের অস্তিত্বই মিটিয়ে দিয়েছে। এর কারণ একটাই, কোষকে ফাঁকি দেওয়া।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আরটি-পিসিআর টেস্টে করোনা পরীক্ষা করার সময় ভাইরাল জিনোম শণাক্ত করা হয়। পিসিআর টেস্ট ভাইরাসের জিন চিহ্নিত করে বলে দেয় যে করোনা পজিটিভ না নেগেটিভ। কিন্তু এইভাবে অ্যামাইনো অ্যাসিডর কোড মুছে দেওয়ার ফলে ভাইরাসের একটা নির্দিষ্ট জিনের বিন্যাসই বদলে যাচ্ছে। ফলে সেটা আর আরটি-পিসিআর টেস্টে ধরা পড়ছে না। গবেষকরা বলছেন, চিন্তার কারণ হল যদি নতুন ভাইরাল স্ট্রেন কারও শরীরে থাকে, তাহলে পিসিআর টেস্টে সবসময় করোনা পজিটিভ রিপোর্ট নাও আসতে পারে। তবে এই বিষয়ে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেই বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
কীভাবে জিনের গঠন বদলায় করোনাভাইরাস?
জেনেটিক মিউটেশনও নানা প্রকারের হয়। কোথাও ডিএনএ-র একটা বেস পেয়ার বদলে যায় যাকে মিসেন্স মিউটেশন বলে, এমন প্রক্রিয়াতেই আবার ননসেন্স মিউটেশন দেখা যায়। কোথাও আবার নতুন ডিএনএ যোগ হয়ে ইনসারশন হয়। এর আগে দেখা গিয়েছিল কোরনার পাঁচ জিনই বেশি সংক্রামক। এই জিনগুলো হল–IFNAR2, TYK2, OAS1, DPP9 এবং CCR2। গবেষকরা বলছেন, করোনা তার জিনের সামান্য অংশেই বদল ঘটাচ্ছে, কিন্তু তার প্রভাব হচ্ছে মারাত্মক।
স্পাইক প্রোটিনের ৬১৪ পজিশনে (অ্যাসপারেট থেকে গ্লাইসিন)এই বদলটা হচ্ছে বেশি। S-D614 ও S-G614 প্রোটিনের মধ্যে এই বদলটা দ্রুত হচ্ছে। এই দুই প্রোটিনই মানুষের দেহকোষের রিসেপটর প্রোটিন অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (ACE-2) এর মাধ্যমেই কোষে ঢুকে প্রতিলিপি তৈরি করে। এই বদলের ফলে তারা আরও দ্রুত রিসেপটর প্রোটিনের সঙ্গে জোট বেঁধে কোষে ঢুকতে পারছে। গবেষকরা বলছেন, এই মিউটেশনের কারণে মানুষের শরীরে নতুন রিসেপটর প্রোটিনও খুঁজে নিতে পারে ভাইরাল স্ট্রেন।
জিনের একটা রিডিং ফ্রেম থাকে, তাতে তিনটে বেস থাকে। প্রতি বেসে একটি করে অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোড থাকে। এই অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোড গুলো বদলে দিচ্ছে ভাইরাস। এতে তার লাভ হল, কোড বদলে গেলে সে আবার নতুন করে জিনের গঠন সাজিয়ে নিতে পারব। তার চেহারাও বদলে যাবে। হিউম্যান ট্রান্সমিশন বা এক মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে হলে এই বদলটা দরকার। জিনের বিন্যাস এভাবে বদলে ফেলার কারণেই ভাইরাস মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে, ফলে করোনার রিইনফেকশনও দেখা যাচ্ছে বলে মন গবেষকদের।