নিউইওর্কের পাঠ্য পুস্তকে হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের পুণ্য চিহ্ন

স্বস্তিকাকে কলঙ্কিত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ

মানস রায় (Manas Roy)

পশ্চিমী দুনিয়াতে ‘স্বস্তিকা” মানে শুধু হিটলার, নাত্সী মতবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ইত্যাদি ইত্যাদি. স্বস্তিকা যে শুধু একটি “ঘৃণার চিহ্ন” বা symbol of hate. তাদের এই ভাবনা যে কত সংকুচিত, সীমিত এবং ভ্রান্ত সেটা বুঝিয়ে দিল নিউইওর্ক এবং আমেরিকার জাগ্রত প্রবাসী ভারতীয় সমাজ.

গত বছর নিউইওর্ক রাজ্যের সেনেট একটি বিল (A8545) প্রস্তুত করে, বিলের বক্তব্য এরকম – আমাদের রাজ্যে ও দেশে “ঘৃণা সম্পর্কিত হিংসা” (hate crime) এর সংখ্যা চিন্তাজনক ভাবে বাড়ছে. এই সামাজিক ব্যাধির নির্মূল করা আশু প্রয়োজন. আমদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই “স্বস্তিকা” এবং “ফাঁসীর দড়ি”(noose) চিহ্নর সঙ্গে ঘৃণা ও হিংসার যে ইতিহাস সংপৃক্ত হয়ে আছে তা জানে না. সুতরাং আমাদের উচিত আমাদের স্কুলের পাঠ্যক্রমে এই চিহ্ন গুলির ঘৃণ্য ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা যাতে আগামী প্রজন্ম একটি সহনশীল বহুজাতিয় সমাজের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে.

বিলটি আইনে পরিনত হলে নিউইওর্কের সমস্ত স্কুলে ক্লাস সিক্স থেকে টুএলভ এর সিলেবাসে “স্বস্তিকা” এবং “ফাঁসীর দড়ি”(noose) চিহ্নর সঙ্গে ঘৃণা ও হিংসার ইতিহাস পড়ানো বাধ্যতামূলক হবে.

ফাঁসীর দড়ি”(noose) চিহ্নর সঙ্গে জড়িত আমেরিকায় সাদা কালোর সংঘর্ষের ইতিহাস. তার আলোচনায় বিরত থাকছি, কারণ এই প্রতিবেদনের মূল বিষয় “স্বস্তিকা”.

হিন্দু ও ভারতকে হীন ভাবে দেখা বহুদিন ধরে আমেরিকার শিক্ষা ক্ষেত্র এবং অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে চালু বহুদিন. এই মনোভাবের একটা প্রধান কারণ ছিল হিন্দু ধর্ম ও ভারত সম্বন্ধে অজ্ঞানতা. আমেরিকায় অবস্থিত ভারতীয় ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্থাগুলি এই অজ্ঞানতা দূরীকরণের কোন সক্রিয় প্রচেষ্টা চালায় নি. আমেরিকায় প্রভূত সম্ম্পত্তির অধিকারী ও শিকাগোতে বিবেকানন্দ নিয়ে উচ্ছসিত একটি মিশনের ব্যর্থতা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য. ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আমেরিকার প্রতিনিধিদের নিস্ক্রিয়্তাও বহুলাংশে দায়ী.

গত দুই দশক ধরে হিন্দু ও ভারত বিরোধী প্রচারে যোগ দিয়েছে বাম-ইসলামিক জোট. শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এরা অতি সক্রিয়.

সুখবর হলো, সম্প্রতি প্রবাসী ভারতীয় সমাজের একটি অংশ এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছেন. এই কাজটা তারা করছেন বিভিন্ন উপায়ে. এর একটি অঙ্গ হল ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে আমেরিকা মানুষ ও রাজনীতিবিদদের পরিচিত করানো. সেই অনুসারে তারা নিউ ইঅর্কের সেনেট ও এসেম্বলীর সাংসদদের তারা অবহিত করিয়েছেন ‘স্বস্তিকা’র হাজার হাজার বছরের ইতিহাসকে.

‘স্বস্তিকা’ শব্দের উতপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘স্বস্তি’ থেকে. ‘সু’ (শুভ) এবং ‘অস্তি’ এই দুই শব্দের সন্ধি ‘স্বস্তি’. অন্তত তিন হাজার বছর আগে থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত এই শব্দ ‘স্বস্তি’ বা তার ভিন্ন প্রচলন ‘স্বস্তিকা’. বেদ ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যে এই শব্দের বহু ব্যবহার লক্ষ করা যায়. শুভকামনা, সুস্বাস্থ, উন্নতি ইত্যাদি অর্থে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে. হিন্দু গৃহের প্রবেশ পথ, শুভ কার্য আজও সুসসজ্জিত করা হয় ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নর দ্বারা.

বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ‘স্বস্তিকা চিহ্ন’. কোথাও একে ভগবান বুদ্ধের পদচিহ্ন, কোথাও ধম্মচক্র হিসেবে বন্দনা করা হয়.

জৈন ধর্মের সপ্তম তীর্থঙ্কর সুপারসাভন্থর চিহ্ন হিসাবে গণ্য হয় ‘স্বস্তিকা’. জৈন ধর্মের ‘প্রতীক’ও বলা হয় একে. জৈন ধর্মের পুস্তক, অনুষ্ঠান অলংকৃত হয় স্বস্তিকা চিহ্নে.

এই চিহ্ন শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির অঙ্গ বা এই উপমহাদেশের নয়, এই চিহ্নর ব্যবহার ও সমাদর বহু যুগ ধরে বহু দেশে হয়ে আসছে.

চীনা ও জাপানী লিপিতেও রয়েছে স্বস্তিকার প্রভাব. ইওরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে – ডেনমার্ক, বেলারুস, স্লোভাকিয়া, রাশিয়া …. কোথায় না ? শেষ রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী আলেক্জেন্দ্রা ফিদেরোভনা গৃহের দেওয়াল দরজা পর্দা সুশোভিত করতেন স্বস্তিকা অঙ্কন করে. প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্য ও মুদ্রায় পাওয়া গিয়েছে স্বস্তিকার অস্তিত্ব.

এমন কি খোদ আমেরিকার মূলবাসী রেড ইন্ডিয়ান বা আমেরিকান ইন্ডিয়ানরাও ‘স্বস্তিকা’কে শুভ-ভবিষ্যত এর চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছে.

নিউইওর্কের রাজনীতিবিদদের সামনে প্রবাসী ভারতীয়রা জোরালো ভাবে তুলে ধরলেন স্বস্তিকার এই হাজার হাজার বছরের দুনিয়াজোড়া পুণ্য ইতিহাস এবং বর্তমানেও ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে স্বস্তিকার প্রয়োগ. তাকে অগ্রাহ্য করে শুধু গত শতাব্দীর মধ্যভাগে এক উন্মাদ শাসকের এই পুণ্যচিহ্নের অপব্যবহারকে মুখ্য করে তুলে স্কুল ছাত্রদের শেখানোর উদ্যোগ যে একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতীকের অবমাননা এবং ইতিহাসের মিথ্যাচার সেটাও জানালেন রাজনীতিবিদদের. পৃথিবীর প্রায় দুশো কোটি হিন্দু বৌদ্ধর অপমান এবং নিউইওর্ক রাজ্যের এক লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভুত ছাত্রছাত্রীদের স্বস্তিকা ব্যবহারের গ্লানি বন্ধ করার অনুরোধ জানায় প্রবাসী ভারতীয় সমাজ.


বৌদ্ধ স্বস্তিকা

এই প্রচেষ্টায় ফল ফলেছে. বিলটি আপাততঃ ঠান্ডা ঘরে চলে গেছে.

নিউইঅর্কের রাজনীতিবিদদের ধন্যবাদ জানিয়েছে ‘হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন’, যে সংস্থা উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছিল.



প্রাচীন গ্রীক মুদ্রায় স্বস্তিকা

তবে এখনই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হওয়ার সময় আসেনি. বিলটিকে আবার আনার চেষ্টা চালাতে পারে ভারত ও হিন্দু বিরোধী শক্তি. প্রবাসী ভারতীয় সমাজকে সতর্ক থাকতেই হবে.

নিচে দেশে বিদেশে স্বস্তিকার কিছু চিত্র দেওয়া হল.

ক্যালিফোর্নিয়া (California)

4 আগস্ট, 2020

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.