দীপ্তাস্য যশ
আচ্ছা আমরা অনেকেই নিশ্চয় জানি দীপিকা পাড়ুকোনের পরবর্তী সিনেমা ৮৩। ভারতীয় ক্রিকেট দলের ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় নিয়ে এই সিনেমা। বিগ বাজেট ফিল্ম।
আমরা নিশ্চয় এও জানি যে এই সিনেমায় অন্যতম লগ্নীকারী রিলায়্যেন্স এন্টারটেইনমেন্ট।
এবার একটা আপাত অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি। জর্জ সোরোস সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি দাভোস সম্মেলনে জানিয়েছেন ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উত্থ্বানকে তিনি ভালো চোখে দেখছেননা। একে প্রতিহত করতে তিনি এক বিলিয়ান ডলার বিনিয়োগ করবেন।
সব কাগজেই প্রথম পাতাতেই ছাপা হয়েছে গতকাল দাভোস সম্মেলনে বিলিওনেয়ার জর্জ সোরোসের বক্তব্য। তিনি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধ করেছেন। তবে বাংলা কাগজগুলো যথারীতি এই এক বিলিয়ন ডলারের অংশটি চেপে গেছে। তবে খবরের পেছনেও কিছু খবর থাকে এবং মূল খবর জানতে গেলে এই খবরের পেছনের খবরগুলিকে একটু বিশ্লেষন করতে হয়। তেমনিই জর্জ সোরোস কাল দাভোস সম্মেলনে যা বলেছেন তার পেছনেও কিছু কারন আছে এবং সেটি অবশ্যই “সংবিধানের লঙ্ঘন” নয়। কারন সোরোসদের সংবিধান একটাই। তা হোল ব্যবসা। আখির পয়সা বোলতা হ্যায়। এই কারনগুলি একটু খতিয়ে দেখলেই মূল উদ্দেশ্যটি প্রকাশ হয়ে পরে।
বিশ্লেষনের শুরুটা বরং করা যাক একটি স্থানীয় খবর দিয়ে। তাহলে হয়ত বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে জর্জ সোরোসকে এবং তার উদ্দেশ্যটি। কারন কর্পোরেট এফেয়ার্স কখনই সোজা বিষয় নয়। খুবই জটিল।
সাল ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের বাম সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এলেন মমতা ব্যানার্জী। ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরেই একটি সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তা হোল হলদিয়া পেট্রোকেমে রাজ্য সরকারের শেয়ার ছেড়ে দেন এবং হলদিয়া পেট্রোকেমের পরিচালন ক্ষমতা পুরোপুরি চ্যাটার্জী গ্রুপের হাতে চলে যায়। আপাতভাবে এতে কোন অসুবিধা নেই। থাকার কথাও নয়। কারন সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়। সরকারের কাজ নীতি নির্ধারন করা। দেশের মানুষকে পরিষেবা দেওয়া। কিন্তু তাও এই ঘটনার পেছনে কিছু ঘটনা আছে যা নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবা দরকার।
আচ্ছা বলুন তো কোন ঘটনায় বামেদের পতনের শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে? ১০০ জনে ৯০ জন উত্তর দেবেন নন্দীগ্রামের গুলি চালনার ঘটনাই বামেদের পতনের মূল কারন। ঠিকই বলবেন। এবার বলুন তো এই নন্দীগ্রামের ঘটনা কেন ঘটেছিল? সবারই মনে আছে নন্দীগ্রামে পেট্রোকেমিক্যাল হাব তৈরি করার জন্য জমি অধিগ্রহন করাকে কেন্দ্র করে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সূচনা এবং পরবর্তীকালে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর নন্দীগ্রামের নিরীহ সাধারন মানুষদের উপরে নৃশংস, নির্লজ্জ আক্রমণ। যার তুলনা হতে পারে মরিচঝাঁপীর সাথে। এরপর সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। আন্দোলন নন্দীগ্রাম থেকে ছড়িয়ে পরে পুরো পশ্চিম বাংলায়।
আচ্ছা এবার একটু ভাবুন তো যে বুদ্ধিজীবীরা সামান্য কিছু সাম্মানিক আর কোন একটা পদলাভের আশায় মুখ্যমন্ত্রীর পেছনে দাঁড়িয়ে তালি বাজিয়ে কা কা ছি ছি গাইতে পারেন, যে বুদ্ধিজীবীদের সিংহভাগ বাম সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন ৩৪ বছর ধরে এবং তার দ্বারা নিজেদের সমাজে বুদ্ধিজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কোন জাদুবলে হটাত তাদের মেরুদন্ড গজিয়েছিল নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের সময়ে?
উত্তর একটাই, তা হোল “আখির পয়সা বোলতা হ্যায়”। এবার একটু মনে করুন গতকাল জর্জ সোরোস কি বলেছেন। তিনি বলেছেন এক বিলিয়ান ডলার তিনি ইনভেস্ট করবেন ভারতে জাতীয়তাবাদের উত্থ্বানকে প্রতিহত করার জন্য। তার একটা বড় অংশ ব্যয় করা হবে এই বুদ্ধিজীবীদের ব্যাকিং দেওয়ার জন্য। কিভাবে ব্যাকিং দেওয়া হবে? কখনও সরাসরি টাকা দেওয়া হবে। আবার কখনও ম্যাগসাইসাই বা বুকার পাইয়ে দেওয়া হবে এবং তাদের সমাজে বুদ্ধিজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তারা হবেন আমাদের লোকাল গার্জেন। তারা আমাদের বোঝাবেন জাতীয়তাবাদ কতো খারাপ। একই ভাবে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও তাদের নানা ভাবে পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তার পরিবর্তেই তারা নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। না হলে স্কচসেবনকারী এই “সর্বহারাদের” কোথায় কোন গাঁয়ে কটা গরীব চাষা গুলি খেয়ে মরল না বাচল তাতে তাদের কিছু যায় আসেনা।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাথেই লক্ষ্য করার মতো উপস্থিতি ছিল বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলির। এবার আবার প্রথম প্যারাগ্রাফের শেষ লাইনগুলো পড়ুন। জর্জ সোরোস বিশ্বের সব থেকে বড় ফিলানট্রপিস্টদের মধ্যে একজন। সারা পৃথিবী জুড়ে বেশীরভাগ বড় বড় এনজিও যেমন গ্রীন পীস বা পেটা এনার অর্থানুকুল্য পেয়ে থাকে। এবার চেইনটা বোঝা গেল? জর্জ সোরোস পয়সা ঢালবেন গ্রীন পীস বা পেটার মতো বড় বড় সংস্থাগুলোতে। যেগুলো নামেই এনজিও। আদতে এরা সবাই বিশাল কর্পোরেট সংস্থা। এরা আবার সেই পয়সা নানাভাবে ডিস্ট্রিবিউট করে দেবে মাঝারি এবং ছোট এনজিওগুলোর মধ্যে এবং গড়ে উঠবে একটা নেটওয়ার্ক। যে নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে সামাজিক আন্দোলনের নামে কখনও বন্ধ করে দেওয়া হবে কল কারখানা আবার কখনও গরীব চাষিকে ঠকিয়ে গড়ে উঠবে কলকারখানা। অর্থাৎ ইনভেস্টরের স্বার্থ বজায় রাখতে যা যা করা দরকার তা এরা করবে।
মনে হতেই পারে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। কোথায় হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল আর কোথায় জর্জ সোরোস আর কোথায় নন্দীগ্রাম। যতসব আবোল তাবোল কথা। আপাতভাবে দেখলে তাই মনে হবে। কিন্তু ঐ যে শুরুতেই বলেছি খবরের পেছনেও খবর থাকে। এবার আসি সেই পেছনের খবরের কথায়। হোলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের অন্যতম অংশীদার ছিল চ্যাটার্জী গ্রুপ। চ্যাটার্জী গ্রুপের অন্যতম ইনভেস্টার বা বিনিয়োগকারী জর্জ সোরোসের সোরোস গ্রুপ। চ্যাটার্জী গ্রুপের মূল শর্ত ছিল যদি এই প্রকল্পের কোন পার্টনার কখনও তার শেয়ার ছেড়ে দিতে হয় তাহলে প্রথমে বাকী অংশীদারদের কাছে প্রস্তাব দিতে হবে। তারা যদি কিনতে অপারগ হয় তবেই এক মাত্র বাইরের কাউকে এই শেয়ার বিক্রি করা যেতে পারে।
এই নির্দিষ্ট শর্তটি নিয়েই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যের জমানায় চ্যাটার্জী গ্রুপের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টালবাহানা শুরু হয়। একদিকে চ্যাটার্জী গ্রুপ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য সংস্থার পুরো নিয়ন্ত্রন নিতে চায়। কারন ভারতে এবং বিশ্বের বাজারে প্লাস্টিক প্যাকেজিং-এর চাহিদা তখন বাড়ছে দ্রুতহারে। কিন্তু নিয়ন্ত্রনের নানা জটিলতার কারনে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল তাদের ব্যবসা সেই অনুপাতে বাড়াতে পারছেনা। অপরদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দী রিলায়েন্স গ্রুপ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি বর্তমানে রিল্যায়েন্স যদিও প্লাস্টিক প্যাকেজিং কাঁচামালের সব থেকে বড় উৎপাদক কিন্তু তাদের ব্যবসার বেশীরভাগটাই ভারতের বাইরে। ভারতে এই মার্কেটে সব থেকে বেশী ব্যবসা করে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল। তাই সেই সময়ে একদিকে নিয়ন্ত্রন নিয়ে নানা জটিলতা। তার উপরে আবার শিল্পের জন্য বুদ্ধবাবু নন্দীগ্রামে জমি দিতে চাইছেন সেলিম গ্রুপকে পেট্রোকেমিক্যাল হাব খোলার জন্য। যার বিনিয়োগ হলদিয়ার থেকে অনেকটাই বেশী। মিতসুবিশি যদিও আগে থেকেই ছিল কিন্তু তাদের ব্যবসা অনেকটাই কম ভারতবর্ষে।
এই সময় তাই ব্যবসায়িক স্বার্থেই চ্যাটার্জী গ্রুপের হলদিয়া পেট্রোকেমকে সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে নেওয়া দরকার ছিল এবং তারা চাইছিলনা সেলিম গ্রুপ তাদের পেট্রোকেম হাব স্থাপন করুক। কারন তার মানেই কম্পিটিশান। সেই কারনেই প্রথমে নানা এনজিও সংস্থাগুলির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করানো হয়। তারপরে সিপিএমের “ঐতিহাসিক ভুলের” পরে (যথেষ্ট সন্দেহ আছে মিডিয়াবুম না হলে হার্মাদ বাহিনীর এই কীর্তিকলাপ আদেও এভাবে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পরত কিনা) স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী ঝাঁপিয়ে পরেন ময়দানে। সেই মমতা আজও আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয়। তখনও তিনি ভাইপোর ভবিষ্যৎ চিন্তায় এতোটা ব্যাকুল হননি।
এই সময়েই চ্যাটার্জী গ্রুপ এই আন্দোলনকে অক্সিজেন দিতে মমতার সমর্থনে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী এবং এনজিওগুলোকে প্রভাবিত করে আন্দোলনে নামায়। যার ফলশ্রুতিতে বাম সরকারের পতন এবং মমতা ব্যানার্জীর “অষ্টম বাম” সরকার গঠন। এই পালা বদলের পরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার হলদিয়া পেট্রোকেমে তাদের অংশীদারীত্ব চ্যাটার্জীগ্রুপকে বিক্রি করে দেয় এবং চ্যাটার্জীগ্রুপ হলদিয়া পেট্রোকেমের নিয়ন্ত্রন নেয়। বলা বাহুল্য এতে অবশ্যই সোরোস গ্রুপ যারা কিনা চ্যাটার্জী গ্রুপে অন্যতম বিনিয়োগকারী ছিল তাদেরও স্বার্থ রক্ষা হয়। অবশ্যই এই স্বার্থরক্ষার্থে বর্তমান সরকার পশ্চিমবঙ্গের পাট শিল্পকে ধীরে ধীরে শেষ করে যথাসাধ্য সহায়তা করেছে।
তবে এতো গেল একটা দিক। আরও একটা দিক আছে। তা হোল মনমোহন সিং-এর সেই সময় করা আমেরিকার সাথে নিউক্লিয়ার ডিল। এই ডিলটি অবশ্যই চায়নার স্বার্থের পরিপন্থী ছিল এবং সেই কারনে ভারতে চীনের সেই সময়ের সব থেকে বড় বন্ধু কমিউনিস্টরা চায়নার স্বার্থরক্ষার্থে বিরোধ শুরু করে। এই বিরোধেও অবশ্য জর্জ সোরোসের স্বার্থহানির কারন ঘটেছিল। কারন জর্জ সোরোসের বিনিয়োগের একটা বড় অংশ আছে ইউরেনিয়াম মাইনিং-এ। আর ভারতে বিভিন্ন পরমানু প্রকল্পে ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের একটা বড় অংশ বাইরে থেকে। কারন ভারতের ইউরেনিয়াম সঞ্চয়ের দ্বারা এই বিপুল চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
জর্জ সোরোসের বিনিয়োগের একটা বড় অংশ যায় ইউরেনিয়াম ট্রেডিং-এ। ক্যামেকো কর্পোরেশান, যা কিনা বিশ্বের সব থেকে বড় যোগানদার ইউরেনিয়ামের তাতে সোরোস গ্রুপের একটা মোটা বিনিয়োগ আছে। স্বাভাবিক ভাবেই ভারত আমেরিকার মধ্যে নিউক্লিয়ার ডিল হলে ক্যামেকো কর্পোরেশান সেখান থেকে বেশ মোটা টাকার ব্যবসা পাবে। এমতবস্থায় বামেরা এই নিউক্লিয়ার ডীলের বিরোধ শুরু করলে তা সোরোস গ্রুপের ব্যবসার পক্ষে ভালো নয়। কারন বামেরা যদি তাদের এই আন্দোলন জারি রাখতে পারে তাহলে ইউরেনিয়াম ট্রেডিং-এর এক বিশাল ব্যবসা চায়না মারফত হয় তা বজায় থাকবে। ফলে সোরোসের লোকসান। তাই এই সমস্যা দূরীকরণে বামেদের শক্তিহীন করাটা জরুরী ছিল সেই সময়ে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের পতন ঘটানো জরুরী ছিল।
সেই সময়ে সংসদে বামেদের যে ৬১টি আসন ছিল তার বেশীরভাগটাই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত। কেরালাতেও বামেরা শক্তিশালী কিন্তু সেখানে তাদের পশ্চিমবঙ্গের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। সেই কারনেই পশ্চিমবঙ্গে বামেদের পতন জরুরী ছিল। তাই নন্দীগ্রাম থেকে যা শুরু হয়েছিল তা ক্রমশ ছড়িয়ে পরে সিঙ্গুর এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশে। জায়গায় জায়গায় গড়ে ওঠে জমিরক্ষা কমিটি। ধাক্কা খায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যের যাবতীয় শিল্পোদ্যোগ। এই পরিকল্পনা সফল করতে বিশেষ বেগও পেতে হয়নি সোরোসদের। অনিল বিশ্বাস পরবর্তীকালে সিপিএমের নিয়ন্ত্রন তখন বিমান, বিনয়দের হাতে। তারা ভাবলেন মরিচঝাঁপী, বিজন সেতু ট্রিটমেন্ট দিয়েই তারা সব ঠাণ্ডা করে দেবেন। মন্দাক্রান্তার মতো কিছু ঝড়তি পড়তি বুদ্ধিজীবী তখনও তাদের ক্যাম্পে আছে। তাদের দিয়ে ভিডিও বানিয়ে ধর্ষিতা মেয়ের বাবাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হোল। কিন্তু তারা এটা বুঝলেন মানুষ অনেকদিন আগে থেকেই সিপিএমের ঔদ্ধত্য, লোকাল কমিটির অত্যাচারে বিরক্ত, ক্রুদ্ধ। এমতবস্থায় তারা একটি বিকল্প শক্তির সন্ধানে আছে। সেই বিকল্প শক্তির সন্ধান দেওয়া হোল মানুষকে মমতা ব্যানার্জীর উত্থ্বান ঘটিয়ে। অনেকে হয়ত বলবেন মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার ইতিহাস অনেক পুরনো। সেটি অবশ্যই ঠিক কথা। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য সেই সময়ে এক বিশাল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী, এনজিও এবং অতিবাম সংগঠনগুলির সমর্থন না পেলে মমতা ব্যানার্জীর পক্ষে সিপিএমকে সরানো সম্ভব হতোনা। ২০০১-এর বিধানসভা ভোট তার সাক্ষী।
সোরোসের এই এনজিও নেটওয়ার্কের মোদী জমানায় কিভাবে ধাক্কা খেয়েছে তা বোঝানোর জন্য একটি উদাহরন দেব। ভারতবর্ষের অন্যতম বড় এনজিও ছিল কম্প্যাশন ইন্টারন্যাশানাল। আমেরিকার কোলারাডোর এই খৃষ্টান চ্যারিটি সংস্থাটির অন্যতম ডোনার জর্জ সোরোস। নরেন্দ্র মোদী সরকার এনজিওগুলিতে বিদেশী অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে কড়াকড়ি শুরু করার পর এই সংস্থাটি ভারতে তাদের কার্যকলাপ বন্ধ করে। এরকম আরও বহু আছে।
ভারতে সোরোসদের ব্যবসা কি? উত্তর হোল কোন একটি নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিনিয়োগ আছে। অনিল আম্বানীর এন্টারটেইনমেন্ট সংস্থা রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্টে তারা প্রায় ১০০ মিলিয়ান ডলার বিনিয়োগ করেছে ২০০৮ সালে। এবার তাহলে বোঝা গেল প্রথম লাইনে দীপিকা পাড়ুকোনের উল্লেখ করা হয়েছে আর কেনই বা দীপিকা পাড়ুকোন জেএনইউ-তে গেছিলেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো কাগজেও সোরোসের বিনিয়োগ আছে। আশা করি আপনাদের সবারই মনে আছে এই সেই বিখ্যাত হেডিং, “ডিভাইডার ইন চীফ”। যাতে কিনা নরেন্দ্র মোদী একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে কালিমালিপ্ত করার প্রবল প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। জর্জ সোরোস সারা বিশ্বের প্রায় ৩০ টি প্রথম সারির মিডিয়া হাউসে বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়াও ভারতে রিয়াল এস্টেট, লিজিস্টিকস ক্ষেত্রেও সোরোস গ্রুপের বিনিয়োগ আছে। একটা মোটা অংকের বিনিয়োগ আছে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে। রাজনীতিতে নাক গলানোর অভ্যেসটি অবশ্য সোরোসের নতুন নয়। এর আগে ২০০৪ সালে জর্জ বুশকে হারানোর জন্য লিবেড়ালপন্থী এই ব্যবসায়ী প্রায় ২৭ মিলিয়ান ডলার লাগিয়েছিলেন। সোমালিয়া, কসোভোতে জঙ্গিদের মদত দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি তার নিজের দেশ হাঙ্গেরি থেকেও তিনি এইসব কারনে বিতাড়িত। সেখানে তার ইউনিভার্সিটি, ব্যবসা সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই মহামান্য ব্যক্তিটি হটাত ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের উত্থান নিয়ে এতো ভাবিত কেন। অবশ্যই তিনি ক্যা বা এনআরসি নিয়ে ভাবিত নন। কারন সে সব ভাবনা থেকে পয়সা আসেনা। তিনি চিন্তিত তার ব্যবসায়িক ক্ষেত্র নিয়ে। একটা কারন হোল এম্যাজন। এম্যাজনে সোরোস ফান্ড ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের একটা বড় বিনিয়োগ আছে। নতুন ই কমার্স আইনের ফলে এম্যাজনের একচেটিয়া ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই জর্জ সোরোস ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উত্থান নিয়ে চিন্তায় পরেছেন। আফটার অল বিপ্লব নয় পয়সা বোলতা হ্যায়।
বামেরা জর্জ সোরোসকে নিয়ে এই মূহুর্তে উদ্বেলিত তার মোদী বিরোধী অবস্থানের কারনে। কিন্তু যেহেতু তাদের নন্দীগ্রাম আন্দোলনের এই পেছনের খবরগুলি নিয়ে সঠিক ধারণা নেই তাই তারা জানেননা যে জর্জ সোরোস যে মোদী বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন সেখানে কানহাইয়া বা ঐশীদের জায়গা বিশেষ নেই। জায়গা আছে শরজিল ইমামদের। যাদের মুখ হিসাবে তুলে ধরার জন্য ১২০ কোটি টাকা খরচা করা হয়। কারন সেই ইনভেস্টমেন্ট আবার তাকে ডিভিডেন্ড দেবে আরব দুনিয়ার পেট্রো মার্কেটে। ফলে তিনি সুবিধা পাবেন তার বাকী প্রতিদ্বন্দীদের থেকে। মনে করা হয়ে পেট্রো প্রোডাক্টে প্রায় ১০০০ বিলিয়ান ডলার নানাভাবে বিনিয়োগ করেছেন জর্জ সোরোস।
আপাতত বামেরা জর্জ সোরোস নিয়ে উদ্বেলিত হলেও তাদের এ থেকেও লাভের সম্ভাবনা বিশেষ নেই। কারন জর্জ সোরোস বামেদের বিশেষ অক্সিজেন জোগাবেননা। কারন তিনি জানেন সেটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। তিনি তাই ভরসা রাখছেন শরজিল ইমামদের উপরে। যারা ক্রমাগত সংখ্যা বাড়িয়ে এই দেশের রাজনীতি, সমাজনীতিকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় এবং জর্জ সোরোস চান রাজনৈতিক ক্ষমতাকে হাতে রেখে ভারতের মতো একটি বৃহৎ বাজারের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।