চাঁদের একপক্ষ কালের হিসেবে ১৪ দিনের মেয়াদ ফুরিয়েছে। এখন নিকষ কালো আঁধার চাঁদের দক্ষিণ পিঠে। চন্দ্রযানের বিক্রমের ঘুম ভাঙেনি। সঠিক সময় ব্রেক কষতে না পেরে ল্যান্ডার বিক্রম যে চাঁদের পিঠে হার্ড ল্যান্ডিং (Hard Landing) করেছে থুড়ি মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেটা নিশ্চিত করেছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোও। চন্দ্রযানের এক সৈনিক বিক্রম রণে ভঙ্গ দিয়েছে ঠিকই, তবে সক্রিয় আছে আর এক বিশ্বস্ত সৈনিক অরবিটার। পৃথিবীর কক্ষে পাক খেতে খেতেই চাঁদের পাড়ায় সতর্ক চোখ রেখেছে সে। আর তার হাই সেন্সর ক্যামেরা এবং লার্জ এরিয়া সফট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটারে (CLASS) ধরা দিয়েছে চাঁদের মাটিতে ঘটে চলা আজব কাণ্ডকারখানা।
বিক্রমকে জাগানোর কাজ যে বন্ধ করে দিয়ে দিয়েছে অরবিটার এমনটা মোটেও নয়। গত ২৯ দিনে একবার চাঁদের দক্ষিণ পিঠের উপর পুরোপুরি পাক খেয়েছে অরবিটার। পুরোটা পরিক্রমা করতে তার সময় লেগেছে মোট ৬দিন। তার মধ্যেই দক্ষিণ মেরুর আনাচেকানাচে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে সে। অরবিটারের ডেটা বলছে, বিক্রমের ট্রান্সমিটার অকেজো। অ্যান্টেনা রেডিও সংযোগের ক্ষমতা হারিয়েছে। সোলার প্যানেলকে অ্যাকটিভ করার উপায় নেই, কারণ সূর্যের আলো এখন সরাসরি চাঁদের দক্ষিণ পিঠে পড়ছে না। কাজেই বিক্রম আর রোভারের কাজের বেশ কিছুটা করতে হয়েছে অরবিটারকেই। তার স্পেকট্রোমিটার চাঁদের মাটিতে খনিজের সন্ধান তো পেয়েছেই, তাদের মধ্যে চার্জড পার্টিকলের (প্রোটন-ইলেকট্রন) নিরন্তর বদলও লক্ষ্য করেছে।
অরবিটারের লার্জ এরিয়া সফট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (CLASS) দেখেছে, দক্ষিণ পিঠে চাঁদের ধুলো (Lunar Dust) বা রেগোলিথের (Regolith) মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, টাইটানিয়াম এবং আয়রনের মতো খনিজ মৌল। তাদের অণু-পরমাণুর মধ্যে নিরন্তর ধাক্কাধাক্কি, মারামারি চলছে। উত্তেজিত হয়ে উঠছে ইলেকট্রনেরা। এক্স-রে স্পেকট্রোমিটারের চোখে ধরা পড়েছে, এই ইলেট্রনেরা এতটাই উত্তেজিত, যেন মনে হচ্ছে তারা নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল, এই রেগোলিথের মধ্যেই মেটাল অবজেক্ট (Metal Object) বা ধাতব বস্তুরও চিহ্ন রয়েছে। যার থেকেই অনুমান করা যায় ল্যান্ডার বিক্রম এই এলাকাতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে।
বেঙ্গালুরু ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের অধ্যাপক নিরুপম রায় বলেছেন, মহাজাগতিক রশ্মির বিকিরণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে চাঁদের ধুলো রেগোলিথ। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বা অন্য কোনও মহাজাগতিক রশ্মি চাঁদের মাটিতে সরাসরি আছড়ে পড়ার সময় এই সূক্ষাতিসূক্ষ ধূলিকণাগুলিকে আঘাত করে। ফলে এগুলির মধ্যে বিদ্যুৎ তরঙ্গ তৈরি হয়। গরম হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য ধূলিকণাগুলো তড়িৎ ঋণাত্মক কণা বা ইলেকট্রন ছাড়তে থাকে। তাপমাত্রার ফারাক এবং মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে বিরাট এলাকা জুড়ে ধুলোর ঝড় শুরু হয়। এই ধুলোর ইলেকট্রোস্ট্যাটিক ফোর্স চুম্বকীয় স্তর (Magnetic Field) তৈরি করে। চন্দ্রযানের ল্যান্ডার বিক্রম এখন এই স্তরের মধ্যে আটকে রয়েছে।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সবটা না পারলেও অরবিটারের আটটি পে-লোডের মধ্যে এই এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার চন্দ্রপৃষ্ঠের এমনই কিছু ঘটনা সামনে আনতে পারবে। পৃথিবীর কক্ষপথে অরবিটারের জীবনকাল যতদিন, তার মধ্যে চাঁদের দক্ষিণ পিঠের আরও অনেক রহস্যের পর্দা খুলবে অরবিটার।