শেখ হাসিনার সরকারের পেছনে মূল রাজনৈতিক শক্তি কি হেফাজতে ইসলাম?

বাংলাদেশের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অকপটে স্বীকার করেছেন, যাদের পেছনে বেশি রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে, সরকার তাদের কথা বিবেচনা করতে বাধ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক আলোচনা সভায় ২০১৭ সালে উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নির্দেশে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকে হিন্দু ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মুসলমান লেখকদের কবিতা ও গদ্য রচনা বাদ দেওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মন্ত্রী সরকারের ওপর মৌলবাদী এই সংগঠনের চাপের কথা তুলে ধরেন। হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে (পড়ুন নির্দেশে) ২০১৭ সালে যখন সরকার হিন্দু ও অসাম্প্রদায়িক মুসলমান লেখকদের রচনা বাদ দেন, তখন মহিবুল হাসান মন্ত্রীসভায় ছিলেন না। তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এক কালের কট্টর বামনেতা, নব্য আওয়ামি লিগ নেতা নুরুল ইসলাম নাহিদ। হেফাজত সরকারের কাছে তালিকা পেশ করে বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান, জ্ঞানদাসের ‘সুখেরও লাগিয়া’, শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকেটা দুলছে’, সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ কাহিনি’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’, কাজি নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’, এস ওয়াজেদ আলির ‘রাঁচি ভ্রমণ’, বাউল লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, জসিমউদ্দিনের ‘দেশ’, হুমায়ুন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তাফার ‘প্রার্থনা’, সানাউল হকের ‘সভা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর খতিয়ান’সহ আরও কয়েকটি লেখা বাদ দিতে হবে। পাঠ্যবইয়ের এক বিরাট অংশ ছাপা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নির্দেশ মান্য করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সেইবইগুলো ধ্বংস করা হয়, ছাপা হয় নতুন পাঠ্যবই। হেফাজতে ইসলামের তালিকা অনুযায়ী এই লেখাগুলো বাদ দেওয়া হয়, যুক্ত হয় হেফাজতের নির্দেশিত নতুন ইসলামি ভাবধারার লেখা। এক বিরাট ক্ষতি স্বীকার করতে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তিন মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু ধমক খেয়েছেন।
শাসক আওয়ামি লিগ নেতারা অভিযোগ করে আসছিলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ও এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থেকে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীত অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা কালে পাঠ্যবইয়ে হাত দেয়নি। পাঠ্যবইয়ে ‘ইসলামের হাত পড়লো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামি লিগ সরকারের আমলে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরেছেন, তিনি চট্টগ্রামের আওয়ামি লিগ নেতা ও তিনবারের নির্বাচিত মেয়র প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। তিনি রাজনীতির অতো মারপ্যাচ হয়তো বোঝেননি। স্বীকার করে নিয়েছেন, তত্ত্বগত সুপারিশগুলির বাস্তবায়ন করতে গেলে যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রয়োজন হয়, সেই পরিস্থিতিটা আমরা এনে দিতে পারছি না। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারছে। তাদের শক্তি আমাদের চাইতে বেশি।
আওয়ামি লিগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫৭টি আসন (সংরক্ষিত মহিলা আসন বাদে) তাদের দখলে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আওয়ামি লিগ সরকারের নির্দেশে। বলা যায়, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সরকারের দখলে। বিএনপি-জামায়াতকে গত দশ বছর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার কণ্ঠ অত্যন্ত ক্ষীণ। অথচ মহিবুলের কথায় পরিষ্কার হলো আওয়ামি লিগ নয়, ক্ষমতার মূল শক্তি হেফাজতে ইসলাম। আওয়ামি লিগ সরকার ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ও ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলেও বাস্তবায়িত করতে পারেনি। ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে হেফজত মাঠে নামে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত রাজধানী অচল করে দিয়েছিল। আওয়ামি লিগ তখন এই হেফাজত বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির মদতে সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলনে নামে বলে অভিযেগ করেছিল। কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল হেফাজতের বিরুদ্ধে। সেই হেফাজত কালক্রমে মজবুত রাজনৈতিক শক্তি’র অবস্থান নিয়ে আওয়ামি লিগের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। জামায়াতে ইসলাম বিএনপিকে দিয়ে যা করাতে পারেনি, হেফাজত আওয়ামি লিগকে দিয়ে তা করিয়ে নিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত নান্দনিক ভাস্কর্য সরানো হয়েছে, বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে নির্মিত ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না (রচয়িতা হিন্দু বলে), জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না, সেই মাদ্রাসার ডিগ্রি সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক। শক্তি’-র আগামী অ্যাজেন্ডা কী শতভাগ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আওয়ামি লিগকে সামনে রেখেই?
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.