পশ্চিমবঙ্গে স্বজাতির আধিপত্য অথবা স্বখাত সলিলে সমাধি । কোনটি চাই আমরা ?

প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বপ্ন দেখে দুই বাংলা আবার একদিন একদেহে লীন হয়ে যাবে । এই স্বপ্ন দেখার লোকের অভাব নেই পশ্চিমবঙ্গেও । ভারতের অধীনে পশ্চিমবঙ্গে খেয়ে পড়ে সুখে বেঁচে থেকেও যাদের কলিজায় অখন্ড বাংলার খোয়াইশ এখনও দপদপায় তাদের একটি অংশ অবশ্যই তথাকথিত উদার-ধর্মনিরপেক্ষ । কেউ কেউ বামপন্থী মহানুভব‌ও বটে। পশ্চিমবঙ্গের ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ‌ও এক‌ই খোয়াবে মশগুল । কিন্তু লিবেরালদের সঙ্গে এদের পার্থক্য হচ্ছে , শুধু স্বপ্ন‌ দেখেই খালাস থাকার বান্দা এরা নয় । এরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস‌ও করে একদিন চাঁদতারা মার্কা সবুজ পাকসাফ নিশানের তলায় দুই বাংলা আবার এক হয়ে যাবেই । এবং স্বীয় আকিদা সফল করতে এদের অনেকেরই যে জানমান কবুল করা চেষ্টার ত্রুটি নেই সেই সংবাদ মিডিয়া মারফত মাঝেমধ্যেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় । তার উপর ঘরে ঘরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির নীরব বিপ্লব তো আছেই।

বাংলাদেশে যাদের ঈমানে ভ্যাজাল নাই তাদের সাফ জবান নব্বুই শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলামের শাসন কবুল হবে না তো কবুল হবে কোথায় । এদের যে ভাইবেরাদরেরা এই বাংলায় রয়ে গেছে তাদের দিল কা বাত‌ও আলাদা কিছু নয়। কিন্তু এই পাড়ে মালাউনদের পাল্লা যদ্দিন পাতলা না হচ্ছে ততদিন মনের আকিদা মনেই পুষে রাখতে হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের বেরাদরে ইসলামের সিপাহীদের কলিজুতে দরদের শেষ নাই। দুই বাংলা জোড়া লেগে গেলে যে এখন‌ই দরদের আরাম সম্ভব এই কান্ডজ্ঞান তাদের বিলক্ষণ আছে ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর ফেসবুক পেজে নিয়মিত নজর করলেই যে কেউ দেখতে পাবেন বাংলাপক্ষের বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের থেকেও দুই বাংলাকে এক করার তাগিদ বাংলাদেশের ইসলামিক গোষ্ঠী গুলির অনেক বেশি। তাহলে যা দেখা যাচ্ছে সেটা হল দুই বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও অখন্ড বাংলার স্বপ্নে বিভোর । আবার দুই বাংলার ইসলামিক গোষ্ঠী গুলিও অখন্ড বাংলার খোয়াইশে মশগুল

যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল কারণ বলে দাবি করা হয় সেই বাংলাদেশের মাথার ওপর একটি ছোট্ট সাদা কিস্তি টুপি ১৯৮৮ সালে পরিয়ে দিয়ে গেছেন দেশটির প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। টুপিটির নাম রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক হিন্দু আইনজীবী সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের অবলুপ্তি চেয়ে হাইকোর্টে আইনি নোটিশ দাখিল করায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝোলা থেকে ইসলামের বেড়ালটি লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দিতে হবে একজন মালাউনের মুখ থেকে এই দাবি শোনা মাত্রেই বাংলাদেশের কোটি কোটি পরহেজগার মুসলমানের নাকি ঈমানের দফারফা হয়ে গেছে। এই নাপাক দাবি লাগু তো দূরের কথা শোনাটাও কবিরা গুনাহের সামিল বলে মনে করে তারা।

নব্বুই ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের ঈমানে চোট দিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ টিকবে না এই কান্ডজ্ঞানের প্রমাণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক বলে খ্যাত শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা নিজের রাজনৈতিক জীবনে বারেবারেই দিয়ে থাকেন। ২০১৬ তে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের রিট খারিজ করে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম যথারীতি বহাল থাকবে। এবার রিটের ওপর শুনানি শুরুর আগেই ওই হিন্দু আইনজীবীকে আইনি নোটিশ প্রত্যাহারে বাধ্য করে মালাউনের নাপাক নজর থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে হাসিনা রেজিম । রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ কীভাবে গলা জড়াজড়ি করে এক‌ই ঘাটের পানি খায় এই প্রশ্নে আমাদের লিবেরালরা নিরুত্তর। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কত হ‌ইচ‌ই উঠল অথচ দেখুন বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মুখে কোন‌ও রা নাই । তারা ব্যস্ত হিন্দির আগ্রাসন ঠেকাতে। অথচ রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের নব্বুই শতাংশ বাঙালি মুসলমানের অবস্থান কোনও রাখঢাক না করেই সালিশি মানবো কিন্তু তালগাছটা আমার গোছের । অর্থাৎ বাঙালি-বাঙালি ভাইভাই তো বটেই কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে কবুল করার পরেই ।

সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের সংযোজনেই বাংলাদেশের ইসলামিক শিবির থেমে নেই। বাংলাদেশে সমাজ -সংস্কৃতির ইসলামিকরণ যে কত দ্রুতহারে ঘটে যাচ্ছে এই সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের অনেকেরই কোন‌ও ধারণা নেই। বাংলাদেশের মডারেট মুসলমানদের‌ও প্রিয় নায়ক এখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান , যিনি স্বপ্ন দেখেন মুসলিম উম্মাহ আবার দুনিয়া শাসন করবে । বাংলাদেশে বসে এরাই কিন্তু খোয়াব দেখে পশ্চিমবঙ্গ দখলে নেবার । সাতচল্লিশে কলকাতা হাতছাড়া হ‌ওয়ার দুঃখ যাদের এখনও যায় নাই তাদের মনে দুই বাংলা এক করার স্বপ্ন থাকবে না তো কাদের মনে থাকবে ?

সাতচল্লিশে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন অখন্ডবঙ্গের টোপ না গিলে বঙ্গভঙ্গের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন ঘরপোড়া বাঙালিহিন্দু যদি এতদিনেও তা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয় তবে বাঙালিহিন্দুর চেয়ে আত্মঘাতী জাতিগোষ্ঠী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই । বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের যে ইসলামিক সংগঠন গুলি গ্রেটার ইসলামিক বাংলাদেশ বা বাংলাস্তানের অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে তলে তলে কাজ সারছে তাদের ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। কারণ তারা যেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সেটা আমল করতেই জেহাদি জোশ নিয়ে লেগে রয়েছে । কিন্তু এক‌ই বৃন্তে দুটি কুসুমের ছেলে ভোলানো ছড়া দিয়ে বাঙালিহিন্দুর রক্তাক্ত ইতিহাস ঢেকে রেখে যেই পশ্চিমবঙ্গবাসী বালখিল্য লিবেরালরা বাংলা ভাগের জন্য আজ শ্যামাপ্রসাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে তাদের জন্য আমার করুণা হয় । যাদের বাপঠাকুর্দা পূর্ববঙ্গ থেকে পিতৃমাতৃদত্ত আপন প্রাণটি কোন‌ক্রমে বাঁচিয়ে শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়ে এদের জন্ম দিয়ে বংশরক্ষায় সক্ষম হয়েছে , সোর‌ওয়ার্দী-শরৎ বোসের অখন্ড বাংলার প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন সাতচল্লিশে পশ্চিমবঙ্গ ছিনিয়ে আনলেন এই জন্য তাদের মনে আজ দুঃখের শেষ নেই । ভারতমাতার অঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের নিরাপদ ক্রোড়ে আপন কল্লা স্বস্থানে রেখেই ধনেজনে , বাড়িগাড়ি হাঁকিয়ে গুষ্টি নিয়ে সুখে থাকার পরেও কী কিউট এই দুঃখবিলাস ! তাই না ?

ছেচল্লিশের শরতে নোয়াখালীর ভয়ংকর হিন্দুনিধন থেকে পঞ্চাশের বসন্তে ভৈরবসেতুর নারকীয় হত্যালীলা সব ভুলে যাওয়ার দায় কি শুধুই বাঙালিহিন্দুর ? ছেচল্লিশের অক্টোবর থেকে একাত্তরের পঁচিশ মার্চ – পূর্বপাকিস্তানে এমন একটি দিন যায় নি যেদিন বাঙালিহিন্দুর কপালে লাঞ্ছনা জোটে নি । সাত পুরুষের বাস্তুচ্যুত থেকে বেঘোরে প্রাণের বিনাশ , ঠাকুরঘরের সিংহাসন পদাঘাতে উল্টে দিয়ে গৃহদেবতার বিগ্রহ নষ্ট থেকে চোখের সামনেই কূলনারীর ধর্মনাশ – কী ঘটে নি বাঙালি হিন্দুর পোড়া ললাটে ? কারা ঘটিয়েছিল ? যাদের হাতে আমাদের জান গেল । মান গেল । পায়ের তলার মাটি গেল । জননী-জায়া-দুহিতার সম্ভ্রম গেল । তারা না আমাদের ভাই হয় ? এক‌ই বৃন্তে না দুটি কুসুম ? তারপরেও একাত্তরে নয় মাসের যুদ্ধে শেখ মুজিবের জয়বাংলা ডাকে সব তিক্তস্মৃতি ভুলে বাঙালিহিন্দু কিন্তু বাঙালিমুসলমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কম রক্ত দেয় নি।

১৯৭১এর ১৬ই ডিসেম্বর দুই হাজার ভারতীয় জ‌ওয়ানের প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশের মুক্তি । চারদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর জয়বাংলার বিজয়োল্লাস। আর তার ঠিক দশমাস পরেই ভাইভাই একঠাঁই ভুলে শারদীয় দুর্গোৎসবে ঢাকার মন্ডপে মন্ডপে প্রতিমা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল কারা ? পাকিস্তানি আর্মির মর্টারের গোলায় গুড়িয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দির যথাস্থানে পুনর্নির্মাণ করতে দিল না কে ? উনিশশো চুয়াত্তরেও বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল সাড়ে তেরো শতাংশের উপরে। মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দেশে বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে মাত্র আট শতাংশে নামল কীকরে ?

খুব তেতো তেতো সব প্রশ্ন । তাই না লিবেরাল বন্ধুরা ? গিলতে খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি । এক‌ই বৃন্তে দুটি কুসুম নিঃসন্দেহে অতি মহৎ একটি বানী । কিন্তু সেই বানী আত্মস্থ করার সুবাদে শুধু বাঙালিহিন্দুকেই সব ছাড়তে ছাড়তে শেষকালে হরিশ্চন্দ্র হয়ে শ্মশানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে – এই খেলা তো বিলম্বে হলেও বাঙালিহিন্দু জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ বেবাক বুইঝ্যা ল‌ইছে কত্তা। উদারতার বোঝা ব‌ইতে গিয়ে বাঙালিহিন্দুর পায়ের তলার মাটি বহু আগেই আলগা হয়ে গেছে। এক‌ই বৃন্তে দুটি কুসুমের অলীক ভাব বিলাস নয় এখন বৈষয়িক স্বার্থবুদ্ধিতেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিহিন্দুর মঙ্গল। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আধিপত্য খোয়ালে বাঙালিহিন্দুর জন্য পড়ে থাকবে কেবলই বঙ্গোপসাগর । অর্থাৎ স্বখাত সলিল । কোনও লিবেরান্ডু সেদিন বাঙালিহিন্দুকে বাঁচাতে আসবে না । এই কথাটি স্মরণে রেখে আগামীর রণনীতি সাজিয়ে ফেলুন ।

বিবেক দাস (Vivek Das)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.