বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে বারবার কেন জানি না সোনালী গুহর কথা মনে পড়ছে। একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী, পরবর্তীকালে বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার সোনালীর বিরুদ্ধে বারবার বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, ২০০৬-এর ৩০ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ঢুকে ভাঙচুরে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন্য। বেচারি সোনালী গুহ, একদা তৃণমূলনেত্রীর ছায়াসঙ্গী রাজনীতিতে আগ্রাসী ভূমিকায় থাকলেও সবসময় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সেই কলঙ্কজনক ঘটনার দায় অস্বীকার করেছেন।
কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা হলে নিশ্চয়ই সাঁতগাছিয়ার প্রাক্তন বিধায়ক হেসে হেসে বলতেন, দেখলি তো আমেরিকায় কী কান্ড হল? তাহলে, ওদের দেশেও আইনসভা আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটে।
আমরা যারা আসলে তৃতীয় বিশ্বে থাকি এবং নিজেদের উন্নয়নশীল দেশ বলে ঘোষণা করে কলার তুলে ঘুরে বেড়াই, তারা মনে মনে কিন্তু লজ্জায় থাকি যে আমাদের গণতন্ত্র এখনও ততটা পরিশীলিত নয়। এবং সেই জন্যই গণতন্ত্রের চিহ্নস্বরূপ যে প্রতিষ্ঠানগুলি রয়েছে সেগুলির উপর মাঝে মধ্যে আক্রমণও নেমে আসে।
উত্তরপ্রদেশ কিংবা কর্নাটকের মতো বিধাসভায় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে হাতাহাতি হয়, লোকসভাতেও ঝামেলা করার জন্য সাংসদদের চ্যাংদোলা করে বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে—এই দৃশ্য আমরা দেখেছি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্ররোচনায় ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের উপর হামলা আমাদের সব গ্লানি, সব অপমানকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিল।
আমেরিকার একজন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট যে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর তাঁর সমর্থকদের নিজের দেশের আইনসভাকে আক্রমণে উৎসাহ দিতে পারেন এবং মার্কিন গণতন্ত্রের কলঙ্কিত দিনটিকে ডেকে আনতে পারেন, সেটা বোধহয় তৃতীয় বিশ্বের কোনও রাষ্ট্রনেতার পক্ষেও এতদিন ভাবা মুশকিল ছিলো।
আমেরিকা, ‘লিডার অব দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ যে এইরকম কোনও দৃশ্য তৈরি করতে পারে, এবং টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তা বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা বোধহয় আমেরিকার কোনও রাজানীতিকও এতদিন ভাবেননি। অনেক অসম্ভবের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটাও সম্ভব করে দিয়ে গেলেন, যা এতদিন হলিউডের সিনেমায় আটকে ছিল, তাই এবার দেখা গেল বাস্তবের ওয়াশিংটনে।
দীর্ঘ লকডাউনের সময় অনেকেই হয়তো বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন সিনেমা দেখেছেন, তারমধ্যে একটি জনপ্রিয় সিনেমা ‘হোয়াইট হাউজ ডাউন’। সেই সিনেমায় দেখানো হচ্ছে আমেরিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদীরা চক্রান্ত করছে এবং মার্কিন প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে হোয়াইট হাউজে হামলা চালাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের সেই চক্রান্ত, সেই হামলা ছিল হলিউডের সিনেমার চিত্রনাট্য মেনে। কিন্তু বাস্তবেও যে একদল রে রে করতে করতে মার্কিন আইনসভার আইকনিক ভবন, ক্যাপিটল হিলের দিকে তেড়ে যাবে, সেটা কে কবে ভেবেছিল? একে হলিউডি সমাপতন বলবেন না ইতিহাসের অমোঘ বাণ, তা হয়তো আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস লিখিয়েরা স্থির করবেন।
করোনা যদি ২০২০-র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাস্তব হয়, তাহলে ২০২১-এর শুরুই আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কতটা আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। ৪ জনের মৃত্যু, দুনিয়াজুড়ে সমালোচনার ঝড়, বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রনেতার নিন্দা ইত্যাদির পরেও ট্রাম্প কিন্তু কিছু বলেননি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষই যখন ইলেক্টোরাল কলেজ অনুযায়ী জো বাইডেন-ই যে আগামী প্রেসিডেন্ট সেটা নিশ্চিত করে বলে দেয়, তখন ট্রাম্প জানিয়েছেন সব নিয়ম মেনেই আগামী ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে যাবে। হলিউডের থ্রিলারের মতোই আশ্চর্য রহস্যের বিষয় যে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের এই কথাটা বলতে দু’মাসেরও বেশি সময় লাগলো। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে যেখানে সবাই এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিল, সেখানে তিনি একমাত্র দাবী করে গিয়েছেন যে আসলে ভোটে তিনি জিতেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর নিয়োগ করা সমস্ত সরকারি আধিকারিককে দিয়ে যাবতীয় ভাবে ভাবী প্রেসিডেন্টের কাজকর্মে বাধা দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত যে ডোনাল্ড ট্রাম্প থামলেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হলেন, সেটা মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই সুখের বিষয়। কিন্তু তাঁর চার বছরের শাসন আমেরিকাকে বিভিন্ন দিক থেকে যতটা অস্বস্তিতে ফেলেছিল, সম্ভবত এই শেষ দু’মাসে তিনি সেই অস্বস্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন। মার্কিন গণতন্ত্রের যে মডেল এতদিন ধরে গোটা বিশ্ব শ্রদ্ধা করতো, তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতো, ট্রাম্প সেটাকেই ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে গেলেন। জো বাইডেনের জন্য যদি পয়লা নম্বর চ্যালেঞ্জ হয় কোভিডের মোকাবিলা, তাহলে ঠিক তার পরেই থাকবে আমেরিকার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করা।