নবরূপে খালিফার আবির্ভাব

বিগত কয়েক বছর ধরে ইসলামিক আগ্রাসনের প্রতিভূ হিসাবে আবির্ভুত হয়েছেন তুরস্কের দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।গোটা ইসলামিক দুনিয়ার কাছে তিনি এখন অবিসংবাদিত পোস্টার বয়।মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক এখন তার চরিত্র বদলে অটোমান সাম্রাজ্যবাদের নব সংস্করণ হয়ে উঠতে মরিয়া।এই নব ইসলামিক আগ্রাসনের সাম্প্রতিক সংযোজন ইস্তানাবুল শহরে অবস্থিত হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘরের চরিত্র বদল করে তাকে মসজিদে রূপান্তরিত করা।
কি এই হাজিয়া সোফিয়া?
তুরস্কের ইস্তানাবুল শহরের বসফরাস প্রণালী( যা ইউরোপ ও এশিয়ার সীমানা নির্ধারণ করে )ঘেঁষে ১৪০০ বছরের খ্রিস্টান ও ইসলামিক স্থাপত্যের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এর মান্যতাপ্রাপ্ত এই সুবিশাল ঐতিহাসিক নিদর্শন।বাইজেন্টাইন শাসক প্রথম জাস্টইনিয়ান এর হাতে ২৭ শে ডিসেম্বর ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই স্থাপত্যটির উদ্বোধন হওয়ার পরে পরবর্তী ৯০০ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে পূর্বের সনাতন খ্রিস্টানদের প্রধান উপাসনস্থল হিসাবে এটি গণ্য হয়ে আসে,মাঝে কিছু বছরের জন্য এটি রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়।প্রতিটি বাইজেন্টাইন শাসকের রাজ্যাভিষেক এখানেই অনুষ্ঠিত হত।গোটা পৃথিবীর খ্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপত্য টি ১৪৫৩ সালে অটোমান শাসকের কব্জায় আসে এবং যথারীতি ইসলামিক শাসকদের আগ্রাসনের শিকার হয় এটি।ওই বছর অটোমান শাসক দ্বিতীয় মেহমেদ তদানীন্তন কনস্টান্টিনোপোলের উপর আক্রমণ চালায় এবং তিনদিন ধরে এই শহরে ধ্বংসলীলা চালায়,যার অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই এই হাজিয়া সোফিয়া,যেখানে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার বৃদ্ধ,শিশু,মহিলাদের বেশিরভাগ কে নির্বিচারে হত্যা করা হয় আর বেঁচে যাওয়া অল্পসংখ্যকদের ক্রীতদাস বানিয়ে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হয়।৯০০ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলে হাজিয়া সোফিয়া গির্জা,আয়া সোফিয়া মসজিদে পরিণত হয়।তারপর ১৯৩৫ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের হাতে অটোমান সাম্ব্রজ্যের পতন হলে এই স্থাপত্য টিকে জাদুঘর হিসাবে ঘোষণা করা হয়।সেই থেকে এটি পৃথিবীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল।প্রতিবছর প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মানুষ এখানে আসেন।২০১০ সাল থেকেই তুরস্কের একাধিক কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠন হাজিয়া সোফিয়া কে মসজিদে রূপান্তরিত করার দাবি জানিয়ে আসছে,বিভিন্ন সময়ে সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম রীতি কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই জাদুঘরের ভিতরে নামাজ পড়তে গিয়ে একাধিক জনকে লোকদেখানো গ্রেপ্তার করা হয়েছে।২০১৮ সালের ৩১ শে মার্চ এরদোগান স্বয়ং এখানে কোরান পাঠ করেন,তারপর থেকেই এটি মসজিদে রূপান্তর ছিল সময়ের অপেক্ষা।অবশেষে এই বছর ১০ ই জুলাই তুরস্কের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা হাজিয়া সোফিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ঘোষণা করেন।তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্টার ৫৬৭ তম বর্ষপূর্তি হিসাবে ২৪ শে জুলাই দুনিয়ার তামাম মুসলিম শাসকদের আয়া সোফিয়ার নামাজ পরার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহল এই ঘটনায় আড়াআড়িভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে, একদিকে যেমন ইউরোপের বিশেষত পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অফ চার্চ যাদের সাথে বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি খ্রিস্টান যুক্ত ,তারা সরাসরি একে ক্রিস্টান দের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে দাবি জানিয়েছে, গ্রিস,সাইপ্রাস, আর্মেনিয়ার মতো তুরস্কের প্রতিবেশী ক্রিস্টান জনবহুল দেশগুলি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে তুরস্ক কে বহিষ্কার করে তুরস্কের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি তুলেছে।প্রতিবাদ শোনা গিয়েছে,ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া এমনকি আমেরিকা থেকেও।মনে রাখতে হবে তুরস্ক কিন্তু ন্যাটোর সদস্য এবং আমেরিকা সহ গ্রিস এবং ইউরোপের অন্যান্য যে দেশগুলি তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর তারাও ন্যাটোর সদস্য।অন্যদিকে ইসলামিক দুনিয়া প্রত্যাশিত ভাবেই তুরস্কের এই ঘোষণায় উচ্ছসিত।আরব মাঘরেব ইউনিয়ন থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড,হামাস থেকে বকোহারাম সবাই তুরস্ককে সাধুবাদ জানিয়েছে।ফলে আগামীদিনে খ্রিস্টান ও ইসলামিক দেশগুলির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য।
আমাদের দেশে এর কি প্রভাব পড়বে?
১৫১৭ সালে সুন্নি মুসলিমদের যে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয়েছিল যেখানে অটোমান শাসক কে খলিফা ঘোষণা করে গোটা এশিয়ার ও পূর্ব ইউরোপের সুন্নি মুসলিমরা সংগঠিত হয়েছিল,প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সেই অটোমান শাসনের পতন ঘটে অক্ষ শক্তির হাতে খলিফা পদের অবলুপ্তি হয়,যার প্রতিবাদে তৎকালীন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এদেশীয় মুসলিমরা খিলাফত আন্দোলন করে,যাকে কংগ্রেস সমর্থন শুধু করে নি,অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন কে একসাথে এক ছাতার তলায় পরিচালিত করেছিল।একপক্ষ লড়ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আর এক পক্ষ লড়ছিল ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য!কি আশ্চর্য দ্বিচারিতা।হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘরের এই আয়া সোফিয়া মসজিদ রূপে আবির্ভাব যে এদেশের প্রচুর মুসলিম কে উল্লসিত করেছে,তা বলাই বাহুল্য।এমনিতেই মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে তুরস্কই সর্বপ্রথম ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ নিয়ে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতের দিকে আঙ্গুল তুলেছিল।তুরস্কের এই কট্টর ইসলামিকতা পাকিস্তানি মদতপুষ্ট এদেশের বিচ্ছিতবাদীদের নতুন উৎসাহ যোগাবে।
এবার একটা অন্য আঙ্গিকে পুরো ঘটনার বিশ্লেষণ করা যাক।তুরস্কে এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আছে রাস্ট্রপতি এরদোগানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি,আর বিরোধী দল হল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।২০১৮ সালে সেদেশের সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে,আর তার ঠিক পরের বছরই অর্থাৎ ২০১৯ সালে আঙ্কারা ও ইস্তানাবুল শহরের পুরসভা ১৫ বছর পরে শাসক দলের হাতছাড়া হয়েছে।ধীরে ধীরে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নিজেদের মাটি মজবুত করছে,কিন্তু হাজিয়া সোফিয়ার ক্ষেত্রে তারা শাসক দলের অবস্থান কে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে,কারণ এটা তাদের মতে তুরস্কের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন,তাই বিরোধিতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।আমাদের দেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে এইটা অনেক বড় বার্তা যারা ভগবান শ্রীরাম কে কাল্পনিক চরিত্র মনে করে,যারা রাম মন্দিরের বিরোধিতায় সুপ্রিম কোর্টে যায়,তারা ধর্মনিরপেক্ষতার চশমা পরে ভোটব্যাংকের স্বার্থে ঐতিহ্য কে অস্বীকার করে আর যে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ অন্তর্জাতিকতাবাদীরা প্রতি বছর নিয়ম করে ৬ই ডিসেম্বর মিছিলে হাঁটেন, তারা ইসলামিক আগ্রাসনের এই আস্ফালন দেখে কতদিন নীরব থাকেন সেটার উপর দৃষ্টি থাকবে।

সোমনাথ গোস্বামী
যোগাযোগ-৯৮০৪৯৭৩৯৯৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.