বিশ্ব সৃষ্টিতে নারী আর পুরুষের সমান হস্তক্ষেপ আছে। ‘নারী‘ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখছেন, “বিশ্বের যা কিছু মহান/সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/ অর্ধেক তার নর।” অপরদিকে ‘মানসী‘ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী –/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/ আপন অন্তর হতে।” কবিতাটির শেষে গিয়ে তিনি বলছেন, “অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।” এখানে পুরুষের চোখে নারী; কবির নিজস্ব মতামত। একটা ‘আমি’ এসে যাচ্ছে। তার মানে নারী কি অন্যের অধীন? সাপেক্ষ হয়েই বেঁচে থাকবে?
মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কবিতা লিখছেন তখন তিনি ৩৪ বছরের যুবক; ১৩০২ বঙ্গাব্দ, ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষে, বঙ্কিমের মৃত্যুর কিছু পরে।
এই রবীন্দ্রনাথই তার দ্বিগুণ বয়সে গিয়ে লিখলেন (১৯২৯) উপন্যাস ‘শেষের কবিতা‘। সেখানে নারীর দুঃসাহসী যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছেন, তাতে ৩৫ বছর আগেকার নারীকে চেনা যায় না, চেনা যায় না আগের রবি-ঠাকুরকেও। লিখছেন,
“কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও। তারি রথ নিত্যই উধাও…./দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে/ তোমা হতে বহুদূরে/ মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম…/ফিরিবার পথ নাহি/ দূর হতে যদি দেখ চাহি/ পারিবে না চিনিতে আমায়।/ হে বন্ধু বিদায়।…”
এরও আট বছর পর ‘কালান্তর‘ প্রবন্ধে (১৯৩৭) তিনি লিখছেন, “নরসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে। প্রাণকে পোষণ করে।”
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘মানসী‘ কবিতা লিখছেন, প্রায় সমসাময়িক কালে স্বামী বিবেকানন্দ সিস্টার নিবেদিতাকে লিখছেন, “ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর — একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখন মহীয়সী মহিলার জন্মদান করতে পারছে না, তাই অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে।” তাতে সাড়া দিয়ে আটাশ বছরের পূর্ণ যুবতী তেত্রিশের এক তরুণ সন্ন্যাসীর কাছে নিজেকে নিবেদন করলেন; বলা ভাল, ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। বঙ্গদেশে নারী জাগরণ ও নবজাগরণে মহতী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
প্রতি বছর ৮ই মার্চ পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস (Women’s Day)। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতো কারখানার নারী শ্রমিকেরা, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এই নিউইয়র্ক (New York) -ই ১৯০৯ সালে অনুষ্ঠিত হতে দেখেছে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন (First International Women’s Conference)। ১৯৭৫ সাল থেকে নারীবাদীদের প্রচেষ্টায় ৮ই মার্চ (March 8th) দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্ব নারী দিবস (World Woman’s Day) হিসাবে পালন করে চলেছে। ২০১৮ সালে নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘Time is now — Rural and Urban activists transforming women’s lives’। ‘অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ‘(ABRSM) ইন্দোর, মধ্যপ্রদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাধারণ সভায় (৭ অক্টোবর, ১০১৮) মাতৃশক্তির উত্থান ও সম্মানের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সংগঠনের প্রথম প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “it is proposed that we should get ready to give appropriate honour to mother power. From family to workplace and in society where we move, our vision towards women should be completely positive, honour-worthy and benchmark for others. This should be reflected in our day to day behaviour towards women. May the upliftment of women-power result into upliftment of society. The objective of this proposal is to make Bharat Vishvaguru through mother power upliftment.” (Abstracted)
বৈদিক যুগ নারীবাদেরও সুবর্ণযুগ। ঘোষা, বিশ্ববারা, অপালা, শাশ্বতী, লোপামুদ্রা,প্রমুখ নারী ঋষির নাম পাওয়া যাচ্ছে; উপনিষদের যুগে সত্যদ্রষ্টা ব্রহ্মবাদিনী নারী গার্গী, মৈত্রেয়ীর নাম জানা যায়; রামায়ণ-মহাভারতের যুগে মহিয়সী নারী সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, গান্ধারী, কুন্তি, দ্রৌপদীর নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শের সন্ধান মেলে।
‘বৃহদারণ্যক‘-এ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের দুই স্ত্রী-র গল্প আছে। ঋষি যাবেন বাণপ্রস্থে, সব সম্পত্তি দুই স্ত্রী কাত্যায়নী আর মৈত্রেয়ীকে ভাগ করে দিতে চান। মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করছেন, নাথ! আপনি কেন যাচ্ছেন?
ঋষি: অমৃতের সন্ধানে।
মৈত্রেয়ী: এ সব সম্পদ দিয়ে কি লাভ করা যাবে সেই পরম শ্রেয়কে?
ঋষি: সম্ভব নয়।
মৈত্রেয়ী: যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্য্যাম্? (যা আমায় অমৃতত্বে সহায়তা করবেই না, তা আমার কী প্রয়োজন?) প্রাচীন ভারতীয় নারী জানতেন জীবনের পরম লক্ষ্য কী!
স্মৃতির যুগে কেন নারীর অবনতি হল তার সামাজিক–রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ জরুরী, বামৈস্লামিক ইতিহাসকাররা সেই ইতিহাস সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেন নি। বিদেশী শক্তির কাছে ভারতীয় সম্পদ কী শুধুই ধন-দৌলত আর মসলা-পাতি ছিল? অবশ্যই ছিল ভারতীয় নারীর সুললিত দেহটাও। মুসলমানি আগ্রাসনে নারী লুণ্ঠনের ভয়ঙ্কর প্রবণতার জন্য যদি হিন্দু্-সমাজপতিরা বাধ্য হয়ে থাকেন নারীকে পর্দানশীন করে রাখতে, তারজন্য হিন্দুধর্মকে এত গালমন্দ করার প্রয়োজন থাকে না। এই পরিবেশের মধ্যে থেকেও হিন্দু-সমাজ যখনই সুযোগ পেয়েছে নারীর যথার্থ রূপ ফুটিয়ে তুলেছে; তাই দেখি বাঙ্গালার মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারী চরিত্রের অলোক-বন্দন।
মুসলমানি অন্ধকার যুগেও যখন সুযোগ ঘটেছে কোথাও কোথাও ঐশি সাধিকার আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে ‘ভক্তি-আন্দোলন‘-কে কেন্দ্র করে। মীরাবাই, অহল্যাবাই, মুক্তাবাই, আক্কা মহাদেবী, রানি ভবানী, খনা, লীলাবতীর মত বিদূষী নারীরা জন্মেছেন ভারতবর্ষে।
এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ; স্বামীজি বলছেন, “He was the saviour of women.” তিনি নারীদের পরিত্রাতা; মাতৃভাবের পূজারী তিনি, মা ভবতারিণী তাঁর আরাধ্যা আর নারীরা সেই জগজ্জননীর প্রতিভূ। রানী রাসমণির প্রতিষ্ঠিত দেবালয়কে তিনি সাধনভূম বানালেন; তন্ত্র সাধিকা ভৈরবী ব্রাহ্মণী হলেন তাঁর গুরু। সাগ্রহে সারদাদেবীকে গ্রহণ করে সাধনার জপমালা অর্পণ করলেন তাঁকে; কৃপা করলেন নটি বিনোদিনী, গৌরী মা, গোপাল মা-কে।
আমাদের সমাজে যেটা দরকার মেয়ে মানুষ থেকে মানুষ হওয়া, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নয়, সামনের সারিতে উঠে আসা। মনে করানোর এই সংকল্প; নারীকে খাঁচা বন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব। পরিবারে নারীর উন্নতি না হলে পরিবারের উন্নতি হবে না; পরিবারের উন্নতি ব্যতিরেকে সমাজের উন্নতি কিছুতেই সম্ভব নয়; সমাজের উন্নতি বিনা জাতির উন্নতি অসম্ভব। যারা ভূমির চাইতে নারীর হাট বেশি বিস্তৃত করতে চান, তারা সাবধান! লাভ-জেহাদীদের ছোবল থেকে ভারতীয় নারীকে বাঁচতে সহায়তা করুন; তাদের শারীরিক প্রশিক্ষণ দিতে বাবা-মা সহায়তা করুন; সর্বত্র ভারতীয় কন্যার মানসিক শক্তি বাড়াতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক-অধ্যাপকেরা এগিয়ে আসুন।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।